শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সরকারের এলসিভিত্তিক স্বস্তির প্রবৃদ্ধিতে শুভংকরের ফাঁকি

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : দেশে এলসি খোলায় একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকার বলছে বড় বড় প্রকল্পের জন্যে যন্ত্রপাতি ও ম্যাশিনারিজ আমদানি হওয়ায় এলসির পরিমাণ বেড়েছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। দেশে কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা হবে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অর্থনীতিদিরাও আমদানি বাড়াকে ইতিবাচক হিসাবে দেখলেও নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়াকে নেতিবাচক হিসাবে দেখছেন। তারা বলছেন, কারখানার জন্য যন্ত্রপাতি আনতে যে বিপুল পরিমাণ এলসি খোলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে তাতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কোনো প্রমাণ মিলছে না। হচ্ছে না কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাদের প্রশ্ন তাহলে এতো টাকা কোথায় যাচ্ছে। এদিকে সরকার দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির তথ্য দেখাচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থানে মন্থর গতি নেমে এসেছে। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধিকে বড় সমস্যা উল্লেখ করে বলেছেন, দেশে একটা বড় ধরনের সমস্যা হলো (জবলেস গ্রোথ) কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। ফলে সরকারের স্বস্তির প্রবৃদ্ধিতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে কি-না এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। 
জানা গেছে, বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। এর মধ্যে আমদানি অর্থায়নেও বড় অঙ্কের ঋণ গেছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাংকের অর্থায়ন বেড়েছে। এতে প্রতি মাসেই আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এলসি খোলার পরিমান ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা শিল্প-কারখানার যন্ত্রপাতি কাঁচামাল আমদানির কথা বলে এলসি খুলছেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো কারখানা গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে কর্মসংস্থান না হওয়ায় বেকারত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। অন্যদিকে নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে না ওঠায় উৎপাদনও বাড়ছে না। আর শিল্প উৎপাদন না বাড়াই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও স্থবির পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে চলতি বছরের মার্চে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমোরোস জবস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কলেজগুলো থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ৭০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং প্রতি বছর ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানে প্রবেশ করতে পারছে পাঁচ লাখের কিছু বেশি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক সমীক্ষা মতে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের (অনার্স-মাস্টার্স) মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এ হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ইকোনমিস্ট এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। জনসংখ্যার ক্রমাগত বিস্ফোরণ এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দিন দিন বেকার সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি উদ্বেগের। গড়ে উঠছেছ না শিল্প কারখানা। বাড়ছে না কর্মসংস্থান, বাড়ছে না আয়। তারপরও বাড়ছে প্রবৃদ্ধি। সরকারের প্রবৃদ্ধির তথ্য ও বাস্তবতার সঙ্গে অনেক ফারাক থেকে যাচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর গত দুই অর্থবছর ধরেই প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তাও সরকারি বিনিয়োগের কারণে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ গত তিন বছর ধরে প্রায় একই জায়গাতে স্থবির। তাহলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ যে বাড়ছে, সেই অর্থ কোথায় যাচ্ছে। আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে (জবলেস গ্রোথ) কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। এবিষয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে অসামঞ্জস্য তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে যে কৃষি কাজ বা অন্যান্য সময়ে আবার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে হচ্ছে সবাই ব্যস্ত আছে। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখছি যে, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হয়েছে; বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
সিপিডি জানায়, বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাই অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। এখন যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, তা মূলত সরকারি বিনিয়োগ-নির্ভর। বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা না হওয়ায় কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বাড়তি ৬৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বেসরকারি বিনিয়োগ লাগবে। অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগ দরকার ৫০ হাজার কোটি টাকা। সিপিডি আরও বলেছে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় কর্মসংস্থানের গতি কমেছে। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে এখন ৪ লাখ ৭০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, আমাদের কোনো কর্মসংস্থান নীতি নেই। অথচ এই দেশে মানবসম্পদ হলো বড় শক্তি। সরকারি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকা উচিত।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৫৪০ কোটি ৪৬ লাখ (৬৪.৪০ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হারে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা; যা চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়েও প্রায় লাখ কোটি টাকা বেশি। এলসি খোলার এই পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে পণ্য আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে এমন উল্লম্ফন আগে কখনো দেখা যায়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৪ হাজার ৪১১ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল; প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশের মত।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের আমদানি বাড়ায় এলসি খোলার পরিমাণ বাড়া স্বাভাবিক। কিন্তু খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যের এলাসি খোলার পরিমাণ যে ‘অস্বাভাবিক’ হারে বেড়েছে তাতে ভোটের বছরে বিদেশে অর্থ পাচারের সন্দেহও জোরালো হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে শিল্পের কাঁচামালের আমদানি ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ২৮ ও ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে এক হাজার ১৪০ কোটি ৯১ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯৮১ কোটি ১৮ লাখ ডলার। আর এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে এক হাজার ৩১ কোটি ৩২ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯৫৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এছাড়া এ সময়ে অন্যান্য পণ্য আমদানির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে ১০৮ দশমিক ৮০ ও ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পের জন্য সরঞ্জাম আমদানি সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির উল্লম্ফনে ভূমিকা রেখেছে। স্বাভাবিকভাবে আমদানি বাড়াকে অর্থনীতিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক সময়ই আমরা শুনি যে, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। অনেক সময় শূন্য কন্টেইনারও আসছে।
তিনি বলেন, আমদানি বাড়ার পাশাপাশি ‘প্রচুর অর্থ’ বিদেশে পাচার হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই এটা হয়ে আসছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ কারণে এটা আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সজাগ দৃষ্টি দরকার। কেননা কোনো কারণে অনিশ্চয়তা বাড়লে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। রাজনৈতিক দলের নেতারা যেমন পাচার করেন, তেমনি ব্যবসায়ী বা আমলারাও অর্থ বাইরে নিয়ে যান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ