শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এরদোগানের নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর অবস্থানে তুর্কী জনগণের উল্লাস

গণসমাবেশে রজব তৈয়ব এরদোগান

৯ আগস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ন্যাটোর একটি বৈঠকে পরস্পরকে অচমকা টোকা দিয়েছেন।  ট্রাম্প এরদোগানকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করেন ‘আমি তাকে পছন্দ করি, আমি তাকে ভালবাসি করি।’ এসময় তাদেরকে বেশ অন্তরঙ্গ পরিবেশে হাত মিলাতেও দেখা যায়। এমন কি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্েয তরস্কের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তবে তাদের এরকম খুনশুটি স্বল্প সময় স্থায়ী হয়। এর কয়েকদিন পরেই ট্রাম্প প্রশাসন এরদোগানের মন্ত্রীসভার দুইজন মন্ত্রীর উপর নিষেদ্ধাজ্ঞা আরোপ করে, তুরস্কের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো শীশা পিন্ডের মত এব্যাপারে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করে।

ইটের বদলে পাটকেলের যে ধারা শুরু হয়েছে তাতে এই দুই মিত্র দেশের দীর্ঘ দিনের মিত্রতাতে বড় ফাঁটল সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।  এই ধারা শুরু করেছেন দুই দেশের দুই নেতৃত্বের কারণে যারা দুইজনই তুরস্কে আটক যুক্তরাষ্ট্রের ধর্ম যাজক এন্ড্রু ব্র্যানসনকে মুক্তি দেয়ার জন্য দর কষাকষিতে নিজেদের গরিমা প্রকাশ করছেন।  এন্ড্রু ব্র্যানসন যাকে এরদোগান ২০১৬ সালে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানকারীদের সাথে আঁতাত রাখার দায়ে অভিযুক্ত করে আটক রেখেছেন।

তুরস্কের একজন কলামিস্ট বলেন, যুদ্ধের রাজনীতি এরদোগানের রক্তে মিশে গেছে এবং ব্র্যানসনের বিষয়টি নিয়ে এটা ট্রাম্পেরও সেরকমটি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তথাপিও অনেক কূটনৈতিকের বরাত দিয়ে বলা যাচ্ছে যে, এই দুই নেতার মধ্যে ব্র্যানসনের বিষয়টি নিয়ে এবছরে অনেকবার টেলিফোনে আলোচনার ঝড় উঠেছে।

তুরস্কের জাতীয়তাবাদের জাগরণের এই সময়ে অনেক তুর্কিই এরদোগানের এই ক্ষিপ্রতাকে প্রশংসা করেছেন।

গত সপ্তাহে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ এবং বিচার মন্ত্রীর সম্পদ বাজেয়াপ্তির যে আদেশ যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে তাতে তুরস্কের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিভাজন থাকা সত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের এরকম আচরণের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদরা ঐক্যের বর্ণালি তুলে ধরেছেন। তুরস্কের আইনসভার বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছে এবং দেশটির চেম্বার অব কমার্সসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী গ্রুপ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এহেন নিষেধাজ্ঞার কঠোর সমালোচনা করেছে।

তুরস্কের দক্ষিনাঞ্চলীয় রাজ্যের আদানা শহরের চেহান মিউনিসিপাল কাউন্সিল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফ্রিস্কো শহরের সাথে তাদের যে অভ্যন্তরীণ সমভাবাপন্ন শহরের চুক্তি তা ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে।

এরদোগানের সমর্থক গোষ্ঠী টুইটারে একটি হ্যাশ ট্যাগ চালু করেছে, যার অর্থ হচ্ছে, (আমরা কখনো সাম্রাজ্যবাদের দাস হবো না), যদিও তারা মনে করেন এই সরকার তাদের দেশের চলমান অর্থনৈতিক দৈন্যদশার অবসান ঘটাতে পারবে না।

কৃষ্ণ সাগরের তীরের স্থানীয় ডানপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের কার্যকরী পরিষদের সদস্য ইনজ্ঞিনিয়ার এরকান বাবুর তার টুইটার একাউন্টে টুইট করেন, ‘আমার নিজের কোম্পানির ডলার এবং আমাদের পুরো ব্যবসায় এর প্রভাব পড়ছে। কিন্তু আমরা অন্য মায়ের সন্তানের মোড়লিপনা সহ্য করার জন্য জন্ম নেই নাই, এবং ডলারের কারণে আমরা বসে পরিণত হইনি।’

 ‘প্রয়োজনে আমরা আমাদের কোম্পানি বন্ধ করে দিব এবং আমাদের জুতো রঙ করাও বন্ধ করে দিব, আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করবো কিন্তু আমরা কখনো তুরস্ককে কাঁমড় দিতে দিবনা।’

তুরস্কের দৈনিক খবরের কাগজগুলোর বেশির ভাগই প্রেসিডেন্টের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে অতিমাত্রায় প্রচার করছে।

 দৈনিক মিলিয়েত নামের একটি দৈনিক হেডলাইন করে ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের সীমা সম্পর্কে ধারণা রাখা। এমনকি এরদোগানের শক্তিশালী একটি বিরোধী পত্রিকা সোজকু সরকারকে তার মাথা না নোয়াতে আহ্বান জানিয়েছে। পত্রিকাটি তার একটি সংখ্যায় প্রধান শিরোনাম করে-‘নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকো, এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’

এমনকি এরদোগান শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তার উপর নিয়েধাজ্ঞা আরোপের আদেশ দেয়ার পর কিছু বিশ্লেষক ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে এরদোগান চলমান সমস্যাকে সামনের দিকে নিয়ে যাবেন।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের তুর্কি গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক কাগাপ্তাই বলেন, ‘আঙ্কারা অযৌক্তিকভাবে প্রতিউত্তর করেছে।’

 ‘এরদোগানের নিকটস্থগণ এবং অর্ধেকের বেশি তুর্কি বিশ্বাস করে যে এরদোগান আক্রমণের শিকার হচ্ছেন (তার নিজ দেশের এবং বিদেশি শত্রুদের দ্বারা) কারণ তিনি তুরস্ককে পূনঃরায় মহান করতে চাচ্ছেন।’- কাগাপ্তাই এক বার্তায় এমনটি বলেন। কামাল চান নামের একজন একটি বিরোধী পত্রিকায় লিখেন, এরদোগান তার নিজস্ব রীতিতেই এই সমস্যার বেশিরভাগকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

 ‘কোন সময় ব্যবসায়ীর মত, কোন সময় রুঢ় ব্যক্তির মত, কোন সময় নত হওয়ার মত আচরণ করে শেষ পর্যন্ত তিনি তার পুরো আতœবিশ্বাসে থাকেন যে তিনি সবকিছুকেই ঠিক করে ফেলবেন।।’-চান এমনটি লিখেন। ‘এরদোগানের নিকটস্থদের মানসিকতায় এরকমই বার্তা সবসময় ঘুরপাক খায়।’

এরদোগানকে সবসময় ঘিরে থাকা ব্যক্তিগণ যারা সবমসয় হ্যাঁ বলতে অভ্যস্থ তারা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে ভুল বিচার করার দিকে নিয়ে যায় এবং ওয়াশিংটনকে কতটা চাপ দিতে হবে সে ব্যপারে ভুল তথ্য দেয়। এটা এমন চিন্তা করা যে, ‘আমরা খুবই দামী যেটাকে ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র দূরে কোথাও যাবে না।’-ইস্তাম্বুলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ কাশিম হান এমনটি বলেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের আসলি আইদিনাটসবাস নামের একজন নারী গবেষক তাদের ওয়েব সাইটে বলেন, ‘সম্ভবত আগামী সাত-আট মাসের মধ্যে যাজক ব্র্যানসনকে নর্থ ক্যরোলিনায় তার বাড়িতে তুরস্ক ফেরত পাঠাবে এবং আতালিয়া(যিনি যুক্তরাষ্ট্রে আটক রয়েছেন) তাকে তুরস্কে পাঠানো হবে এবং ট্রাম্প আবারো এরদোগান সম্পর্কে পাগলাটে প্রলাপ সমৃদ্ধ টুইট করবেন।’

‘কিন্তু তুরস্কের পরবর্তী ভেনিজুয়েলা হবার সম্ভাবনা থেকে যায়, পশ্চিমের সাথে বাকযুদ্ধে জড়ানো এবং ভয়ানকভাবে নিমজ্জিত অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হতে পারে।’-বলে মিস আসলি আইদিনাটসবাস জানান। ‘কেউই এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়।’ বলে তিনি যোগ করেন।

এত কিছুর পরও কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যখন এরদোগান এসবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারা শিখে গিয়েছেন তিনি নতুন কোনো পরিকল্পনা করবেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাগসোগলু বারবারই বলে আসছেন যে, দরকষাকষি চলমান এবং তুরস্কের কর্মকর্তারা কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়াশিংটন সফর করবেন।

তুরস্কের অর্থমন্ত্র্রী এবং এরদোগানের জামাতা বেরেত আলবাইরাক শুক্রবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এব্যাপারে আশাবাদী মনোভাব ব্যক্ত করে বলেন, ‘মিত্রতা কখনো শেষ হবার নয়।’ বেরেত আলবাইরাক বলেন, এটা অনেকটা পরিবারের সদস্যদের সাথে মনমালিন্য হওয়ার মত ব্যাপার।

তিনি আরো জানান, ‘এমনকি একই বাড়িতে বসবাসকারী দুই সহোদরও একই বিষয়ে সমানভাবে একমত নাও থাকতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরে তুরেস্কর নিমজ্জিত অর্থনীতি বেরেত আলবাইরাকের মন্তব্যের পর পূনরায় চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত হুররিয়েত নিউজের প্রতিনিধি সেদাত এরগিন মনে করেন অর্থনীতিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করাই হচ্ছে এরদোগানের প্রধান লক্ষ্য। তিনি হুররিয়েত ডেইলি নিউজের এক কলামে লিখেন, ‘এটা অনেকটা সময়ে ফিরে যাওয়ার মত অনুভূতি তৈরী করে।’

উভয় পক্ষই উপহাসের যোগ্য। তুরস্ক ব্র্যানসনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের মত উপলব্ধি নাও করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ফেতুল্লা গুলেনকে তুরস্কে পাঠানোর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখায়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের নিরাপত্তা নিয়ে সিরিয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়াটাকে গুরুত্ব দেয়নি বলে সেদাত এরগিন মনে করেন।

তিনি আরো বলেন, ‘এখানে কোন জাদু নেই যে হুট করে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলবে, অন্যদিকে উভয় পক্ষের জন্য ভালো হবে তাদের চলমান তিক্ত সম্পর্কে এখন কিছুটা বরফ ঢালা।’

যদিও তিনি এরদোগানের এই বিষয়ে একটা সমাধা করার মত চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, এরদোগানের ভাষায় পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি সিরিয়ার শহর মানবিজকে তার স্বস্থানে বহাল রাখার ব্যাপারে একটি ঐক্যমতে পৌছতে চান এবং তার এই আবেদন ব্যবসায়ী মনোভাবের ট্রাম্পের জন্য একটি পরিষ্কার বার্তা। এরদোগান অভিযোগ করে বলেন, ট্রাম্প নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং অন্যদিকে তিনি আঙ্গুরের স্বাদ যাতে উভয় পক্ষ নিতে পারে তার জন্য সহযোগী মনোভাব দেখাচ্ছেন।

 ‘সবসময় সবখানে, আমরা রাজনীতির ‘জেতা জেতা’ পক্ষেই আছি থাকি’ বলে এরদোগান ঘোষণা করেন। ‘আমরা আঙ্গুরের স্বাদ আস্বাদনের জন্য সকল প্রকার সহোযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমরা তাদেরকে সুযোগ দেব না যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আঙ্গুর গাছের বেড়ে উঠায় হস্তক্ষেপ করা।’-শেষে এরদোগান এমনটি বলেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ