শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতারকৃত বহু আসামী জামিনে

শাহজাহান  তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ): দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অন্যতম এজেন্ডা হল-ফাঁদ পেতে ঘুষখোরদের হাতেনাতে ধরা এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তা পরিচালনা করা। এভাবেই দুদক ‘ঘুষের লাগাম’ টেনে ধরতে চায়। তবে দিন দিন ‘ফাঁদ মামলার’ সংখ্যা বাড়লেও এতে তেমন সুফল আসছে না। মামলা দায়েরের কিছুদিনের মধ্যেই আসামীরা জামিনে মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। গত বছর রাজধানীতে ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার ৮ মামলায় সব আসামীই জামিনে আছেন। এসব মামলার মধ্যে দুটি মামলার তদন্তও শেষ করতে পারেনি দুদক। তদন্তে ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতাই ‘ফাঁদ মামলায়’ সুফল না আসার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল অনুবিভাগ) মো. মঈদুল ইসলাম (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) জানান, মামলায় আসামীদের জামিন প্রাপ্তি অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন কিংবা তদন্তাধীন মামলায় আসামীদের জামিন পাওয়া অনেকটা সহজ। তিনি বলেন, ঘুষখোর কর্মকর্তাকে হাতেনাতে গ্রেতারের পর আইন অনুযায়ী ‘ফাঁদ মামলা’ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যেদিন ঘুষসহ গ্রেতার করা হয়, সেই দিনই তদন্তের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তদন্তের আর তেমন কিছু বাকি থাকার কথা নয়। বড়জোড় দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে এসব মামলার চার্জশিট দাখিল করা উচিত। কারণ এসব মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে শুধু চার্জশিটের ফরম পূরণ করাই অন্যতম কাজ।
এক প্রশ্নের জবাবে দুদক মহাপরিচালক বলেন, ২০১৭ সালে ঘুষসহ গ্রেফতার মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া অপ্রত্যাশিত। আর ঘুষসহ গ্রেফতার মামলাগুলোর মধ্যে যেগুলোর চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়েছে, সেগুলোর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। তবে সেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়াও দুঃখজনক।
এতে আসামীরা সত্যিকারের দোষী হলে সাজা হবে, আর যদি নির্দোষ হয় তবে ভোগান্তি থেকে বাঁচবে। তবে এ ক্ষেত্রে দুদকের কর্মকর্তাদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এসব মামলা দ্রুত তদন্তে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হবে। তদন্তে কর্মকর্তাদের গাফিলতি থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, ‘এসব মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামিরা আদালতে সময় চেয়ে কালক্ষেপণ করেন। চার্জ (অভিযোগ) গঠন শুনানির আগে ও পরে আসামীরা নানা অজুহাতে উচ্চ আদালতের কথা বলে সময় নেন। আসামীরা মনে করেন, এসব মামলায় সময়ক্ষেপণ করতে পারলে মামলাগুলো আলোচনায় থাকবে না এবং এক সময় সাক্ষ্য-প্রমাণও পাওয়া যাবে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১০ জুলাই ঘুষের ৬২ হাজার টাকাসহ পাবনার আটঘরিয়া সাব-রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহান এবং ওই অফিসেরে মহরার আশরাফুল আলম দুদকের হাতে গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক শেখ গোলাম মাওলা বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আটঘরিয়া থানায় একটি মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামীরা জামিনে আছেন। এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত/সেখান থেকে প্রত্যাহারও করা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর রাজধানীতে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতারের ঘটনায় ৮টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে ৬টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে দুদক। আর বাকি দুটি মামলার তদন্ত অদ্যাবধি শেষ করতে পারেনি কমিশন। আর চার্জশিট দাখিল করা মামলাগুলোরও বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। এসব মামলায় সব আসামিই উচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে রয়েছেন। আটটি মামলার মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে সওজর অ্যাস্টেট ও আইন কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত বছরের ২ নভেম্বর এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার সাত নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তেজগাঁও খাদ্য অধিদফতরের রেশনিং কর্মকর্তা বিউটি বেগম ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই বছরের ১৮ এপ্রিল এ মামলায় চার্জশিট দখিল করা হয়। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামিও জামিনে আছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উপ-কর কর্মকর্তা তো. তোফাজ্জল হোসেন জমাদ্দার ঘুষের ২০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই বছরের ২২ আগস্ট এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামি জামিনে আছেন। গত বছরের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা বিভাগের সহকারী পরিদর্শক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঘুষের ২ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নূর-ই-আলম বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা করেন। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামি জামিনে আছেন। গত বছরের জুলাই মাসে নৌ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলাম ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামী জামিনে আছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অফিস সহায়ক মো. সুলতান হোসেন তালুকদার ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে শাহ আলী থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত অদ্যাবধি শেষ হয়নি। এ মামলার আসামী জামিনে আছেন। গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টারের উচ্চমান সহকারী মো. শহীদ উল্লাহ ঘুষের ২০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত অদ্যাবধি শেষ হয়নি। এ মামলার আসামী জামিনে আছেন। গত বছরের নভেম্বরে ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী ওয়াকফ প্রশাসক মো. মোতাহার হোসেন ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামী জামিনে আছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চলতি বছর ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতারের ঘটনায় মোট ৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ দুটি ও দুদক তিনটি মামলা করে। বর্তমানে ৫টি মামলাই দুদকের তদন্তাধীন রয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে ৩ মামলায় ৩ আসামী জামিনে রয়েছেন। পাঁচ মামলার মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে তিন আসামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলাটি দুদকের সিডিউলভুক্ত হওয়ায় বর্তমানে তা দুদক তদন্ত করছে। এ মামলায় আসামী লেকহেড গ্রামার স্কুলের এমডি খালেদা হাসান মতিন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এও মো. নাসির উদ্দিন হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। আর শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. মোতালেব হোসেনের আত্মসমর্পণপূর্বক চাওয়া জামিন নাকচ করে বৃহস্পতিবার তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। চলতি বছরের এপ্রিলে নৌ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ড. এসএম নাজমুল হক ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত অদ্যাবধি শেষ হয়নি। এ মামলার আসামী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে ৯ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে মো. ইলিয়াছ হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। বর্তমানে মামলাটি দুদক তদন্ত করছে। এ মামলায় আসামী ইতিমধ্যে হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। চলতি বছরের জুনে ঘুষের ২ লাখ টাকাসহ মো. তরুণ প্রামাণিক গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। এ মামলার আসামী জামিনে আছেন। চলতি বছরের জুনে ঢাকা ওয়াসার ফিল্ড অফিসার খন্দকার জাহিদুর রহমান ঘুষের ২ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। এ মামলায় আসামী কারাগারে রয়েছেন।
দিন দিন বাড়ছে ফাঁদ মামলা : ২০১৪ সালে ফাঁদ মামলা পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে সে কার্যক্রম দীর্ঘদিন কচ্ছপ গতিতে চলছিল।
গত বছরের শুরুর দিকে দুদক চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের প্রতি ঘুষ গ্রহণ না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান। ‘তা না হলে কঠিন পরিণতির জন্য অপেক্ষা করুন’- বলে হুশিয়ারি দেন।
সেই সঙ্গে সরকারি দুর্নীতিপ্রবণ অফিসগুলোর কর্মকর্তাদের ফাঁদ পেতে গ্রেফতারের জন্য কমিশনের প্রতিটি কর্মকর্তার প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেন। সেই নির্দেশনার পর থেকেই ফাঁদ মামলার সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। দুদক চেয়ারম্যানের কঠোর নির্দেশে বর্তমানে ‘ফাঁদ মামলার’ সংখ্যা প্রায় অর্ধশতকের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। দুদক ও আদালত সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে দুদক ৫টি ফাঁদ মামলা করে। আর ২০১৫ সালে ফাঁদ মামলা হয় তিনটি।
এরপর ফাঁদ মামলার ওপর কমিশনের গুরুত্বারোপের ফলে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ১৩টি ফাঁদ মামলা হয়। গত বছর মোট ২০টি ফাঁদ মামলা করা হয়েছে। চলতি বছরও উল্লেখযোগ্য হারে ফাঁদ মামলা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ