বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সড়ক-মহাসড়কের অবিরাম ভাঙ্গাগড়া

সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থার আওতাভুক্ত দেশের হাজার হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কে বেহালদশা বিরাজ করছে। মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে তড়িঘড়ি করে খানাখন্দে ভরা সড়ক-মহাসড়কগুলো সংস্কার, মেরামতের উদ্যোগে নেয়া হয়। জনগণের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এসব মেরামতি কাজ আসলে যে সংশ্লিষ্ট লোকদের লুটপাট ও ভাগবাটোয়ারার উপলক্ষ হয় তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, সংস্কারে শুভংকরের ফাঁক, ভাগ-বাটোয়ারায় লুটপাটের ফল হচ্ছে লোক দেখানো সংস্কারের কয়েক দিন যেতে না যেতেই রাস্তাগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে বটে কিন্তু জালিয়াতি, দুর্নীতি, লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাচ্ছে না। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ যেন লুটপাটের ভেল্কিবাজি। মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে ৪২ কিলোমিটার রাস্তায় খানাখন্দকের কারণে বছরজুড়েই যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ মাঝেমধ্যেই সংস্কারের আয়োজন করে রাস্তা বন্ধ করে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে তুললেও মেরামতের কাজ শেষ হতে না হতেই তা ভেঙ্গে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ভাঙ্গা ও ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ। একটি অংশে গত ২০ জুলাই সংস্কারের কাজ শেষ হওয়ার এক দিন পরেই বিটুমিন খোয়া উঠে গিয়ে তা আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
কয়েক দিন আগে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায় যে, লালমনিরহাটে দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়কের নির্মাণ শেষ হওয়ার পর উদ্বোধনের আগেই বিভিন্ন জায়গায় ধসে পড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে ২০১২ সালের প্রথমদিকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ২০১৪ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও দুই দফায় সময় বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ শেষ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। শুরুতে সংযোজ সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে এক কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হলেও দুই দফা সময় বাড়ানোর সাথে সাথে নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়। পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে ১৬ কোটি টাকা ব্যয় করার পর সড়কের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই তা বিভিন্ন জায়গায় ধসে পড়েছে। এখানে সাম্প্রতিক দুটি রাস্তার উদাহরণ তুলে ধরা হলো মাত্র। সারাদেশে শত শত রাস্তা সংস্কারের ক্ষেত্রে অভিন্ন অবস্থা দেখা যাবে। আমাদের বাংলাদেশে সড়ক-মহাসড়ক ও সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, চীনের চাইতে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ গুণ বেশি। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও অনেক বেশি। বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়ে এ দেশের রাষ্ট্র পরিচালকরা সর্বনি¤œ মানের অবকাঠামো নির্মাণ করে আসছে এমনকি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পেও অনিয়ন-দুর্নীতি ও লুটপাটের বিস্তর ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। ঠিকাদারী চুুক্তি মোতাবেক সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করা, নির্মাণ সামগ্রীর মান, নির্মাণ ব্যয় এবং ব্যবস্থাপনা, কোন ক্ষেত্রেই নির্ধারিত মান বজায় রাখতে পারছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এভাবে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি-অপচয়ে লোপাট  হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের তেমন কোন জবাবদিহিতা নেই।
আমরা সব সময় বলে আসছি, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের নামে চলছে যথেচ্ছ লুটপাট। বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ চলে যায় সড়ক-মহাসড়ক,  সেতু নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে। এসব খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরও হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তার বেহালদশা দূর করা যাচ্ছে না। এর মূলে রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাযথ মান বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্তৃপক্ষের সার্বক্ষণিক নজরদারি ও জবাবদিহিতা না থাকা। রড, ইট-পাথর, বারিল-সিমেন্ট ও বিটুমিনের মতো নির্মাণ সামগ্রীর সঠিক মান বজায় রাখা দূরের কথা, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা জায়গায় সরকারি স্থাপনায় রডের বদলে বাঁশ, পাথরের বদলে অতি নি¤œমানের ইটের খোয়া এবং অত্যন্ত নি¤œমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। সংস্কারের একদিন পরই দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক আগের মতো বেহাল দশায় উপনীত হওয়া তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন রোধের কাজগুলো যথাসময়ে এবং যথাযথ মানে বাস্তবায়ন করতে না পারায় প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ অস্বাভাবিক বন্যা, ফসলহানি, মৎস্যহানি ও নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। একদিকে এসব খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে। অন্যদিকে এসব উন্নয়ন প্রকল্প যথানিয়মে বাস্তবায়ন না হওয়ায় অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হচ্ছে তা অনেক বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন থেকে শুরু করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক, সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ ব্যয় এবং সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রায় একই বাস্তবতা বিদ্যমান। দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী ব্যবস্থাপনার মতো খাতে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ও বেপরোয়া লুটপাটের জোয়ার জিইয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন কী আশা করা যায় না?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ