শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

তড়িঘড়ি আরপিও সংশোধন করে সরকার আইনকে অস্ত্রে পরিণত করছে

# তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় ---এম হাফিজ উদ্দিন
# আইনকে অস্ত্রে পরিণত করতে ইভিএম ---বদিউল আলম
# নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা নেই ---সি আর আবরার
স্টাফ রিপোর্টার: তড়িঘড়ি করে আরপিও সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার আইনকে অস্ত্রে পরিণত করতে চাচ্ছে বলে সন্দেহ পোষণ করছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা মনে করছেন, বিদ্যমান আইন প্রয়োগের প্রতি নির্বাচন কমিশনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার ওপর ইভিএম ব্যবহারের প্রতি নির্বাচন কমিশন উৎসাহ দেখাচ্ছে। এজন্য তারা দ্রুত আইন সংশোধন করছে। এতে করে মনে হচ্ছে আইনটি অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলছে।
গতকাল রোববার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিকরা এসব কথা বলেন। সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
তড়িঘড়ি করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যে সংশোধনী প্রস্তাব ভেটিং এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তার সমালোচনা করে সুষ্ঠু ও কার্যকর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মূল প্রবন্ধে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরে সুজন। প্রস্তাবে বলা হয়, আইনে না ভোটের বিধানের পুন প্রবর্তন করতে হবে, মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিলের বিধান সংযোজন করতে হবে, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান সংযোজন করতে হবে।
এছাড়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিটি দলের তৃণমূল পর্যায়ের সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীকে দিয়ে একটি প্যানেল তৈরি এবং এই প্যানেলের মধ্য থেকেই কেন্দ্র কর্তৃক মনোনয়ন চূড়ান্তকরণের বিধান সংযোজন করতে হবে, রাজনৈতিক দলের সকল স্তরের কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত অপডেট করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে।
লিখিত প্রবন্ধে সুজন আরো জানায়, রাজনৈতিক দলের সকল কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধানটি বিবেচনায় রেখে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে, হলফনামার ছকে পরিবর্তন আনতে হবে, হলফনামার তথ্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যাচাই বাচাই এর বিধান বাধ্যতামূলক করা এবং অসত্য ও বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রাদনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার বিধানটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি নির্বাচনী ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থীদের পোস্টার ছাপানো, হলফনামার তথ্য ভোটারদের মাঝে বিতরণ, প্রার্থী পরিচিতি সভা আয়োজন ইত্যাদি বিধান সংযোজনসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতি জোর দেয় সুজন।
২০১৭ সালের এসব প্রস্তাবসহ নতুন আরো কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে সুজন। সংস্থাটি জানায়, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করে গড়ে তুলতে কমিশনারদের নিয়োগে আইন প্রণয়ন করতে হবে, ভোটার তালিকা প্রণয়নে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে, সীমানা পুনঃর্নিধারণে নির্বাচন কমিশনকে ভূমিকা পালন করতে হবে বলে সুজনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই তা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। বর্তমান সরকার বহাল রেখে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ইসির আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো ইভিএম থেকে সরে আসছে। সেখানে আমরা তড়িঘড়ি করে রকেট গতিতে আরপিও সংশোধন করে ইভিএম ব্যবহার করার প্রস্তাব রহস্যজনক।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, পাকিস্তান আমলে বেসিক ডেমোক্রেসির কথা বলা হত, এখন বলা হচ্ছে কন্ট্রোল ডেমোক্রেসির কথা। তিনি বলেন, আমাদের অনেক অর্জন ছিল। গত ১০ বছরে সরকার সব অর্জন নষ্ট করে দিয়েছে। সরকার যতই আইন করুক না কেন , এই সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে না। তাই, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে নির্বাচন কমিশন পূনর্গঠন করার পর নির্বাচন দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সিআর আবরার বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে সবাই শংকিত। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কোনো আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আমরা চাই জনগণ যেন তার ভোট দিতে পারে। সেই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনী মাঠে সমান সুযোগ পায়।
জুনায়েদ সাকি বলেন, কোনো দল নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, সেটা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দুইটি সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থাকবে না। এটা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। তিনি বলেন, ইসির সংলাপে অংশ নেয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত কমিশন আমলে নিচ্ছে না। বিপরীতে ইসি সরকারি দল কি কি প্রস্তাবনা দিয়েছে সেগুলো খুঁজে খুঁজে বাস্তবায়ন করছে। তাই এই কমিশনের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। তিনি বলেন, প্রশাসন আইনকে অস্ত্রে পরিনত করতে ইভিএম ব্যবহার করতে চাচ্ছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বর্তমান চাইলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হইলে তারা কতটা চাইবে সেটাই বড় প্রশ্ন । তিনি বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর লাগবে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ এক শতাংশ লোকের মধ্য থেকে কেউ যদি বলেন আমি স্বাক্ষর দেইনি। তাহলে তার প্রার্থী পদ অবৈধ হয়ে যাবে। এটি এক ধরনের হয়রানি। এ হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
বেলার নির্বাহী পরিচালক, সৈয়দা রেজোয়ানা হাসান বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলাম, এখন ২০১৮ সাল চলে। এই সময়ের মধ্যে কোনো নির্বাচনে আর ভোট দিতে পারি নাই। কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। ভোট এখন চুরি হয় না, ভোট এখন ডাকাতির মধ্যে চলে গেছে।
ব্যারিষ্টার জোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, বর্তমান অবস্থায় আমরা কোনটা সরকার আর কোনটা রাষ্ট্র আমরা গুলিয়ে ফেলছি। এই অবস্থা চলতে পারে না। জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। তাদের ক্ষমতা তাদেরকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।
সভায় সুজনের পক্ষ থেকে ১২ দফার একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে, সেগুলো হলো, সংশোধিত আরপিওতে না ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা, মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের সকল স্তরের কমিটির তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা, দ্রত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী বিরোধ নিস্পত্তি করা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ