বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সড়ক-মহাসড়কে বিপুল অপচয়

মেয়াদের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ক্ষমতাসীনরা যখন ভোটারদের মন জয় ও আকর্ষণ করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নসহ লোক দেখানো কর্মকান্ডে ব্যস্ত তখন একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষতিকর ব্যর্থতা নিয়েও জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। এরকম একটি বিষয় হিসেবে প্রাধান্যে এসেছে সড়ক-মহাসড়কের শোচনীয় অবস্থা। দেশের কোনো এলাকার সড়ক-মহাসড়কই যে নিরাপদে চলাচলের উপযোগী নয় সে কথা জানা যায় নিয়মিতভাবেই। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে শুধু অভিযোগের সত্যতাই অস্বীকার করা হয় না, মেরামত ও সংস্কারের পাশাপাশি নতুন পর্যায়ে নির্মাণ ও উন্নয়নের গালগল্পও শোনানো হয়। এ ব্যাপারে এগিয়ে থাকেন বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পবিত্র দুই ঈদের ছুটির সময় তো বটেই, বৃষ্টি-বাদলের দিনগুলোতেও তিনি নাওয়া-খাওয়া ভুলে যান। টিভি ক্যামেরা ও সাংবাদিকদের নিয়ে ছুটে বেড়ান বিভিন্ন অঞ্চলে। গালগল্প শোনানোতেও জুড়ি নেই তার।

অন্যদিকে বাস্তবে সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় ও ভয়ংকর হয়ে পড়েছে তার বিবরণসহ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবারের দৈনিক সংগ্রামে। এতে শুধু বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বাস্তব চিত্রই তুলে ধরা হয়নি, বিশেষজ্ঞদের অভিমত উদ্ধৃত করে একথারও উল্লেখ রয়েছে যে, বিগত নয় বছরে নির্মাণ ও সংস্কারসহ সড়ক-মহাসড়কের জন্য ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হলেও সে অর্থের বেশির ভাগই অপচয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কারণ, ‘রোড পেভমেন্ট ডিজাইন গাইডÑ২০০৫’ অনুযায়ী প্রতিটি সড়ক-মহাসড়কের আয়ুষ্কাল গড়ে যেখানে ২০ বছর হওয়ার কথা সেখানে প্রায় সবগুলোই এক-দেড় বছরের মধ্যেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এখনো পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

কেন এমন অবস্থা হয়েছে ও হচ্ছে এবং নির্ধারিত আয়ুষ্কালের অনেক আগেই সড়ক-মহাসড়কগুলো কেন চলাচলের অনুপযোগী ও বিপদজনক হয়ে পড়ছে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা ছয়টি প্রধান কারণের কথা জানিয়েছেনÑ ১. সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং অবকাঠামোর ব্যাপারে অবহেলা; ২. পানি নিষ্কাশনে নালা বা ড্রেনের ব্যবহার না করা; ৩. নকশার ক্ষেত্রে মূল নকশা অনুসরণ না করে ইচ্ছামতো এদিক-সেদিক পরিবর্তন করা; ৪. আমদানিকৃত নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা; ৫. ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টজনদের মধ্যে মানসম্মত কাজ করার অভ্যাস ও সংস্কৃতি গড়ে না ওঠা এবং ৬. নির্মাণকাজে সীমাহীন দুর্নীতি। 

উদাহরণ দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, অতি নি¤œমানের বিটুমিন তো ব্যবহার করা হচ্ছেই, একই সঙ্গে সড়ক নির্মাণে যে কিউরিং পিরিয়ড থাকে তাও মানা হচ্ছে না। পাশাপাশি রয়েছে সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি ওজনের ভারী যানবাহন চলাচলের বিষয়টি। এসব কারণেই নির্মাণ বা সংস্কার করার পর কয়েক মাস না যেতেই সড়ক-মহাসড়কগুলোর বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে খানাখন্দকের। সেই সাথে প্রতিটির আয়ুষ্কালও কমে যাচ্ছে। 

এমন অবস্থায় সংস্কার বা মেরামতের যে কাজ করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও নির্মাণ আইনের বিধান ও নীতিমালা অনুসরণ না করার ফলে কোনোটিই টেকসই হতে পারছে না। মাঝখান দিয়ে সরকারের ব্যয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এভাবে সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ১৩ হাজার ৭০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে সংস্কার তথা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এক হাজার ৭০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি কিলোমিটার সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গড়ে ব্যয় হয়েছে সাত লাখ ৯৩ হাজার ৪৮২ টাকা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সড়ক-মহাসড়কের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার এই অপচয়ের খবর নিঃসন্দেহে আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য। আপত্তির প্রধান কারণ হলো, সংস্কার বা মেরামত থেকে নতুন সড়ক নির্মাণ পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মেরামতের ক্ষেত্রে কেবলই দায়সারা ‘মেরামত’ করা হচ্ছে, যাতে অদূর ভবিষ্যতেই আবারও ‘মেরামত’ করার সুযোগ মিলে যায়! শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটাকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সব ধরনের গবেষণা ও পর্যালোচনায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে, সওজসহ সংশ্লি¬ষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঠিকাদারদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকেন মন্ত্রী-এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এখানে তাই ‘এক শ্রেণীর’ ঠিকাদার বা ‘এক শ্রেণীর’ কর্মকর্তা বলে কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। ঘুষ ও অবৈধ অর্থের লোভে সবাই আসলে পচে গেছে। 

এজন্যই কোনো কাজই ১০০ ভাগ দূরে থাকুক, ৫০/৬০ ভাগও নির্মাণ কাজের নীতিমালা অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। ইট-বালু-সিমেন্ট-রড এবং বিটুমিনের মতো নির্মাণ সামগ্রীরও যথাযথ ব্যবহার হয় না। কিন্তু এসব দোষ ও অপরাধ ধরার এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই। কারণ, ব্যবস্থা নেয়া যাদের দায়িত্ব তারা নিজেরাই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকেন। কোটি টাকার অংকে ঘুষ লোনদেন হয়। এখানেও ‘এক শ্রেণীর’ বলার সুযোগ নেই। দুর্নীতি আসলে সবাইকে গিলে খেয়েছে। প্রত্যেকে শুধু টাকাই চেনে, দেশ ও জাতির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই তাদের। ঠিকাদারদের তো বটেই, মন্ত্রী-এমপিসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সম্পর্কেও কথা না বাড়ানো ভালো। 

আমরা মনে করি, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর ব্যাপারে সরকারের উচিত জরুরিভিত্তিতে তৎপর হয়ে ওঠা। শুধু সড়ক-মহাসড়কগুলোর সংস্কার কাজে হাত দিলে চলবে না, একই সঙ্গে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য অর্থ অবশ্যই  সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, সব জেনে-বুঝেও যে সরকার ৪৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ‘পানিতে’ ফেলে দিতে পারে, সে সরকারের জন্য আরো কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবস্থা করা মোটেই অসম্ভব হতে পারে না। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে, সেই অর্থ যাতে আবারও ‘পানিতে’ তথা ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপি এবং দলীয় নেতাদের পকেটে না যেতে পারে। যাতে যথাযথ নিয়ম ও আইন মেনে সকল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ