শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চৌগাছার ১২ জন ইউপি চেয়ারম্যান ১২৫টি নাশকতা মামলার ফেরারী আসামী!

চৌগাছা (যশোর) সংবাদদাতা : বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁসে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার অবস্থান। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালিন যশোর জেলার ঝিকরগাছা, কালিগঞ্জ ও মহেশপুর থানা ভেঙ্গে চৌগাছা থানা গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে চৌগাছাকে উপজেলায় পরিণত করা হয়। বর্তমানে ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে এ উপজেলা গঠিত। নতুন উপজেলা হওয়ার কারণে এ উপজেলা ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। অবহেলিত এই উপজেলাকে এগিয়ে নিতে নিরলস পরিশ্রম করেন এখানকার রাজনীতিবিদরা। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের ভুমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যেসব চেয়ারম্যানরা চৌগাছা গঠনে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রেখেছেন, যারা ছিল চৌগাছা উন্নয়নের কারিগর তারা আজ ১২৫টি নাশকতা মামলার ফেরারী আসামী। পুলিশের ভয়ে বছরের পর বছর তারা বাড়িঘর ছেড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউবা অর্থনৈতিকভাবে হয়ে পড়েছেন দেউলিয়া। একদিকে পরিবারের ভোরণপোষণ, নিজের চলা খরচ আর অন্যদিকে মামলার খরচ যোগাতে গিয়ে অনেকে জমাজমি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এদের সবাই মাসের পর মাস কারাগারে নি:সঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। মানসিক যন্ত্রণার স্বীকার হয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে জীবন হারিয়েছেন ধুলিয়ানী ইউনিয়নের তৎকালিন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম শান্তি। এসব জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে পুলিশের নাশকতা মামলা দেয়া শুরু হয় ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে। এ মামলায় আসামী করা হয় ২ নং পাশাপোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা আবু সাঈদকে। মাওলানা আবু সাঈদ ছাত্রজীবন শেষ করে মৌলভী শিক্ষক পদে যোগ দেন ধুলিয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেই সাথে এলাকার মসজিদে বিনা পয়সায় ইমামতিসহ নানা সামাজিক কাজ করতে থাকেন। এলাকার মানুষ ১৯৮৭ সালের স্থানীয় নির্বাচনে মেম্বর পদে মনোনয়ন দিয়ে পাশ করান। তারপর জনগণের দাবীর মুখে ১৯৯২ সালে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পাশাপোল ইউনিয়নবাসীর সুখদু:খের সাথী মাওলানা আবু সাঈদ। হজ্ব করে আসা এই মানুষটাকে পাশাপোল ইউনিয়নের জনগণ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। অথচ সেই আবু সাঈদ আজ নাশকতা, বিস্ফোরকসহ পাঁচ মামলার আসামী হয়ে এক প্রকার ফেরারী জীবনযাপন করছেন। পুলিশের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারেননা। বৃদ্ধ বয়সে বেশ কয়েক মাস জেলও খেটেছেন। কথা বললে বলেন শেষ বয়সে এতটা বিপদে পড়বো কোনদিন ভাবিনি। ঐ একই মামলায় মামলায় তার আপন ভাই মাওলানা আব্দুল কাদেরকেও আসামী করে পুলিশ। তিনিও ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৮ বছর ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। সুঠাম দেহের অধিকারী মাওলানা কাদের দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। তারপরও পুলিশ তার নামে ৮টিরও বেশি গায়েবী মামলা দিয়েছে। তিনি এখন ফেরারী জীবনযাপন করছেন। আসামী করা হয় হাকিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফেজ মাওলানা আমিন উদ্দিন খানকে। তার সততার দৃষ্টান্ত এখনো মানুষের মুখে মুখে। চেয়ারম্যান হলেও তিনি পরিষদ থেকে কোন ভাতা নিতেননা। হজ্ব করে আসা শুভ্র শশ্রুমন্ডিত মানুষটার দিকে তাকালে শ্রদ্ধায় যে কারো মাথা নুয়ে আসে। চৌগাছা উপজেলার আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবার এক আদর্শ মানুষ হাফেজ আমিন উদ্দিন খান। অথচ এই মানুষটার হাতেও হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দিল পুলিশ। ছয় মামলার আসামী হয়ে তিনিও আজ বাড়ি ছাড়া। ঐ মামলায় আরো আসামী করা হয় চৌগাছা পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মাস্টার কামাল আহমেদকে। বয়সে তরুণ এই জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসছেন।। এলাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান নিজে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি চৌগাছা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে পুলিশ অন্তত ১৩টির বেশি নাশকতা পরিকল্পনার মামলা দায়ের করেছেন। অন্তত ১৫টি নাশকতা পরিকল্পনা মামলার আর এক আসামী হলেন ৩ নং সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুচ আলী দফাদার। প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ইউনুচ আলী যেন কোন কিছুতেই ভয় পাননা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একের পর এক মিথ্যা মামলা তাকে কাবু করে ফেলল। এই বৃদ্ধ বয়সে যে কতবার জেলে যেতে হলো তাকে তার কোন হিসাব নেই। পুলিশের খাতায় তিনি এখন পলাতক আসামী। প্রতি মাসের বেশির ভাগ দিনগুলো তার কেটে যায় কোর্টের বারান্দায়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি নিজে জমি দান করে যে ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবন তৈরি করেছেন সেই ভবনে কল্পিত বোমা হামলার অভিযোগে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ৪ নং ধুলিয়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম শান্তি। প্রচলিত আছে তার ইউনিয়নের যে মানুষটাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবে তাকে একবার চেয়ারম্যান শান্তি ভাত খাওয়াবেই। এই মানুষটাকে পুলিশ বারবার আটক করে জেলখানায় পাঠাতে লাগলো। এক সময় মানসিক যন্ত্রনায় হার্টএটাকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ৫নং চৌগাছা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান ছিলেন কয়ারপাড়া গ্রামের এমএ সালাম। ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবন তৈরি করতে নিজে জমি দান করেন। অথচ তিনিও অর্ধডজন মামলার আসামী হয়ে ফেরারী জীবনযাপন করছেন। ৬ নং জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহমান। ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়ে চেয়ারম্যান থাকাকালে কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, কার্লভাটসহ হাজারো জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। শিশুর মত সহজ সরল নিরহংকার এই মানুষটাকেও ৫টি মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করে কারাগারে পাঠায়। এখনো অজ্ঞাত মামলার আসামী হিসেবে আটক হওয়ার ভয়ে ফেরারী জীবনযাপন করছেন। ৭নং পাতিবিলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন জহুরুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে উপজেলা বিএনপির সভাপতি। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এক নাগাড়ে ১১ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এলাকার এমন কোন উন্নয়নমুলক কাজ নেই যেখানে জহুরুল ইসলামের হাতের ছোঁয়া নেই। সারা উপজেলার সকল মানুষ এক নামে যাকে চেনে। কিন্তু একের পর এক মামলা হতেহতে তিনি এখন ১৩টি মামলার আসামী। সহজসরল হাসিমাখা মুখের এই মানুষটা আজ বড় অসহায়। মামলা মোকদ্দমার কারণে ঠিকমত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সময় দিতে না পারার কারণে প্রায় তিন কোটি টাকার ইটভাটা ধ্বংস হয়ে গেছে। তার কথা বললে তিনি বলেন আমি জ্ঞানত কারো কোন ক্ষতি করিনি আমি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করি। এ উপজেলার কেউ বলতে পারবেনা আমি পটকাবাজি ফুটিয়েছি অথচ পুলিশ আমার নামে একের পর এক বোমাবাজের মিথ্যা মামলা দিয়ে যাচ্ছে। এই ইউনিয়নের আরএকজন চেয়ারম্যান হলেন আতাউর রহমান লাল। চেয়ারম্যান হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছেন। ছিমছাম এই মানুষটাও নিজের অসুস্থতা ভুলে সারাক্ষণ জনগণের সেবাই লেগে থাকেন। অথচ তিনিও বেশ কয়েকবার জেল খেটে এখন ক্লান্তশ্রান্ত তার নামে পুলিশ চারটি মামলা দায়ের করেছে। ৮ নং হাকিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হলেন মাসুদুল হাসান। এবার তিনি দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছেন। উপজেলার সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান হলেন মাসুদুল হাসান। তার নিজের বলে কোন কাজ নেই সারাক্ষণ জনগণের সেবা করা তার নেশা। অথচ সমাজসেবক এই তরুণের নামে এখন পর্যন্ত ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একজন চেয়ারম্যান হিসেবে সবচেয়ে বেশি মামলার আসামী তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন ভাই এখন প্রতিদিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আর নতুনভাবে আটক হওয়ার ভয়ে বলাযায় একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছি। ৯নং স্বরূপদাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মাওলানা আব্দুল লতিফ। চৌগাছা উপজেলার সর্ববৃহৎ এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়ে মানুষকে সেবা দিতে ছুটে বেড়িয়েছেন একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। কিন্তু সেই নরম স্বভাবের মানুষটার বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ আনলো যে তিনি চৌগাছার লোহার ব্রীজের কাছে বোমা নিয়ে বসে ছিলেন। কথা হলে তিনি বলেন আমি চৌগাছা উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের খতিব। আমার পিছনে ডিসি, ইউএনও সাহেবরা নামাজ আদায় করেন আর পুলিশ বলল আমি বোমাবাজ খুবই খারাপ লাগে এসব চিন্তা করলে। ১১ নং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন কাজী আব্দুল হামিদ। পরপোকারী এই মানুষটার নামেও পুলিশ ৫টি নাশকতার মামলা দিয়েছে। তিনিও এখন পুলিশের ভয়ে ফেরারী জীবনযাপন করছেন। এছাড়া চৌগাছা পৌরসভার সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়র হলেন সেলিম রেজা আওলিয়ার। পৌর এলাকার মানুষের সাথে যার রয়েছে হৃদয়ের বন্ধন। যিনি প্রতিদিন পৌরসভার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে হাসিমুখে মানুষের সাথে কুশল বিনিময় করেন। কেউ বলতে পারবেনা আওলিয়ার কখনও কারো সাথে গোমড়া মুখে কথা বলেছেন। অথচ তিনিও ৪টি নাশকতা মামলার আসামী। এছাড়া পৌর কাউন্সিলার সাইদুল ইসলাম ১০টি, নাজমুজ্জান খোকন ৫টিসহ উপজেলার আরো অনেক জনপ্রতিনিধিরা পুলিশের কল্পিত নাশকতা মামলার আসামী হয়ে ফেরারী জীবনযাপন করছেন। এসব জনপ্রতিনিধিদের মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে চৌগাছা থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আকিকুল ইসলাম বলেন আইনের চোখে সবাই সমান , অপরাধীর ক্ষেত্রে কে জনপ্রতিনিধি আর কে সাধারণ মানুষ তা দেখার কোন সুযোগ নেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ