বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

একটানা দুই বার ক্ষমতায় থাকার টার্গেট পূরণ হয়েছে -প্রধানমন্ত্রী

* অন্যায়টা কি করেছি এখনই পদত্যাগ করতে হবে
* নোংরামি করে বেড়ায়, তাদের ঠেকাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
* আমি ইভিএমের পক্ষে
* নির্বাচনে আসা না আসা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত
* সবাই উইশ করেছে আমি যেন আবার ফিরে আসি
* হেফাজতে ইসলাম কখনো আমাদের শত্রু ছিল না
* এসকে সিনহা সম্মান রাখতে পারেন নি
স্টাফ রিপোর্টার : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, সাংবাদিকরা খুব উদ্বিগ্ন, আমি বুঝলাম। কিন্তু আমাদের উদ্বেগটা দেখবে কে? বা যারা ভিকটিমাইজ হচ্ছে, তাদের উদ্বেগটা কে দেখবে? আর তাদের কীভাবে কম্পোনসেট করবেন। ওই জায়গায় একটু কমতি আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারও যদি অপরাধী মন না থাকে, বা ভবিষ্যতে কিছু অপরাধ করবে এরকম পরিকল্পনা না থাকে এ আইন নিয়ে তার উদ্বেগ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, যেসব সাংবাদিক মিথ্যে কথা লেখেন না, তাদের উদ্বেগের কিছু নেই। তিনি মিথ্যে সংবাদ পরিবেশন করার জন্য সম্প্রতি পাশ হওয়া এই আইনে শাস্তির ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা নোংরামি করে বেড়ায়, তাদের ঠেকাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
নিউইয়র্কে ছয় দিনের সফরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে ভাষণ ও অভিজ্ঞতা জানাতে গতকাল বুধবার গণভবনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের শুরুতেই নিউইয়র্কে তাঁর সফরের বিষয়ে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সফরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। লিখিত বক্তব্যের পর তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ আইনে উদ্বিগ্ন তারা বেশি হবে, যারা এত দিন ধরে খুব তৈরি-টরি হয়ে আছে। নির্বাচনের শিডিউল এলে যারা আমাদেরকে ভালো করে ঘায়েল করার জন্য ডকুমেন্ট তৈরি করে বসে আছে। তারা উদ্বিগ্ন হতে পারে। তারা ভাবছে যে এরকম একটা মিথ্যা নিউজ করবো। এখন তো মাঠে মারা যাবে। ওখানে (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) একটা জিনিসের ল্যাপস আছে। একটা জিনিস ওখানে ঢোকানো উচিত আমি মনে করি। সেটা হলো- ‘যদি কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা তথ্য দেয়, তাহলে সেই মিথ্যা তথ্যটা তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, এটা সত্য। যদি সে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। যে সাংবাদিক লেখবে। যে পত্রিকা বা মিডিয়া। ইলেট্রনিক বা ডিজিটাল ডিভাইস হোক। যে ব্যবহার করবে বা যে এটা প্রকাশ করবে। তাদের সবাইকে শাস্তি পেতে হবে। এবং যার বিরুদ্ধে লেখবে, তার যে ক্ষতিপূরণ হবে সেটার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটা ইংল্যান্ডে আছে।’
লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের  বৈঠকে অংশ নিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকার ও তিনি নিজে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোট নেওয়ার পক্ষে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি কিন্তু ইভিএমের পক্ষে। আজ পর্যন্ত নির্বাচন ব্যবস্থার যতটুকু পরিবর্তন বা আধুনিকায়ন, তা কিন্তু আমরা করেছি। এখন তো ডিজিটাল বাংলাদেশ। এই যে আপনি আজ টাকা পাঠাচ্ছেন মোবাইলে। এই টাকা তো সবার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। সেই টাকা পাঠাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে। ভোটটাও আপনার প্রিয় জিনিস। তা আপনি ভোটটাই (ডিজিটাল উপায়ে) দিতে পারবেন না কেন?
কেবল ইভিএম নয়, ভোট দেওয়ার জন্য আরও আধুনিক ব্যবস্থা তৈরির পক্ষে মত দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বরং এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত যে মোবাইল থেকেও যেন আপনারা ভোট দিতে পারেন। কষ্ট করে আর যাওয়া (ভোটকেন্দ্রে) লাগবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চেয়েছি, আগে ইভিএমটা হোক। সেজন্য আমরা একনেকে প্রজেক্ট পাস করে দিয়েছি। যেহেতু প্রজেক্ট করে দিয়েছি, সেহেতু বুঝতেই পারেন, আমাদের মানসিকতা কী। আমরা চাই (ইভিএম)। কারণ জনগণের ওপর আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস আছে। জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে।
তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমার একটা আকাক্ষা ছিল, একসময় অন্তত একটানা যদি দুই বার ক্ষমতায় থাকতে পারি, অন্তত উন্নয়নগুলো দৃশ্যমান হবে। মানুষ তার সুফলটা পাবে। আমার দুই টার্ম হয়ে গেছে। টার্গেট পূরণ হয়েছে। এখন আমার কাছে ক্ষমতা থাকলেও কী গেলেও কী! আমার আর কোনো চিন্তা নাই। এটা আমার পরিষ্কার কথা।
সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে তার বিরুদ্ধে অসংখ্য দুর্নীতির তথ্য রয়েছে। তার বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ল’ উইল টেক ইটস ওন কোর্স।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মাইনোরিটি থেকে আমরাই প্রথম তাঁকে বানিয়েছি প্রধান বিচারপতি। তিনি সেটির সম্মান রাখতে পারেননি। এটি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু তাঁর আপিল ডিভিশনের কয়েকজন সহকর্মী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, তিনি এজলাসে বসলে তাঁরা বসবেন না। সেটি নিয়েই সমস্যা তৈরি। এখানে আমাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
 প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমরা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে রাজনীতি করি না। এস কে সিনহা কেন বিএনপি ও ভারতের  প্রধানমন্ত্রীকে বলেছে আমাকে যেন সমর্থন না দেয়, আমি জানি না। আমি কারো সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাই না। আমার সমর্থন জনগণ। সেটি নিয়ে থাকতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তবে আমাকে কেউ পরামর্শ দেয়নি। যার সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা সবাই আমাকে উইশ করেছে আমি যেন আবার ফিরে আসি। তবে জনগণ ভোট দিলে আছি, না দিলে নাই। আগামীতে যেন আবার দেখা হয় (প্রধানমন্ত্রী হিসেবে), এই কথা সবাই বলেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন তারা অপেক্ষা করছে, সরকার চলে যাবে। এমন একজন আসবে যাদের চাল নাই, চুলা নাই; কিন্তু ক্ষমতায় আসার খায়েস আছে। তাদের খায়েস পূরণ করতে গিয়ে তো খেসারত দিতে হয় জনগণকে। ১০ বছর ক্ষমতায় আছি, দেশের মানুষ শান্তিতে আছে। অন্যায়টা কি করেছি এখনই পদত্যাগ করতে হবে। আমাদের তরুণদের জন্য শিক্ষা-গবেষণার সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। চাকরির জন্য যেন মুখাপেক্ষী না হতে হয়, সে জন্য তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও পত্রিকায় লেখা হয়, সরকার এইখানে ফেল করেছে।
দেশে আওয়ামী লীগের ভোটের বাইরে কেবল আওয়ামীবিরোধী ভোট আছে বলে মন্তব্য করেছেন   প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন জোট গঠন হলেও তারা সেই আওয়ামীবিরোধী ভোট পেতে নির্বাচনে আসবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এত এত জোট হচ্ছে, আমি খুশি। কিন্তু বাংলাদেশের ভোট হচ্ছে দু’রকম। আওয়ামী লীগ আর অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ। আমার কথা হলো শত ফুল ফুটতে দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে আসবেন কি না, সেই সাহস তাদের আছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা কর্নার করে দেন, যত খুশি বক্তব্য দিয়ে যাক। তবে মেইনটেন্যান্স চার্জ নিতে হবে। একেকটা প্রোগ্রাম করে, আর এত নোংরা করে যায়! এখন আরও জায়গা খুঁজছি তাদের দেওয়ার জন্য।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা সম্পূর্ণভাবে বাতিলের সিদ্ধান্তের পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাও কিছু কিছু কোটা রাখার পক্ষে মত দিচ্ছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, কোটা প্রয়োজন হলে বলতে হবে। আন্দোলন ছাড়া কোটা দেওয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটা বিষয়টা আমাদের নজরে আগে থেকেই ছিল। প্রতিবছরই বিষয়টি আমি মনিটরিং করছিলাম। কোনো সরকারি চাকরিতে যদি কোটা পূরণ না হয়, তাহলে মেধাতালিকা থেকে সেই পদ পূরণ করার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। এর মধ্যে আন্দোলন শুরু হলো, ভিসির বাড়িতে হামলা হলো। আমি সারারাত জেগে ছিলাম। মেয়েরা হল থেকে বের হয়ে আসছে, মিছিল করছে, সব দেখলাম। কিন্তু অনেক ধরনের মানুষ তো আছে। এই রাতে মেয়েদের যদি কিছু হয়ে যায়? আমি সবাইকে নির্দেশ দিলাম, মেয়েরা যেন নিরাপদে হলে ফেরে।
কোন দল নির্বাচনে অংশ নেবে, আর কোন দল নির্বাচনে অংশ নেবে না সেটা ওই দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সব দলই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে বলে আশাবাদী বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যথাসময়েই নির্বাচন হবে। দেশের মানুষ ভোটও দেবে। এই দেশে তো অনেক রাজনৈতিক দল। নির্বাচনে কোন দল আসবে, আর কোন দল আসবে না, সেটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্ত তো আমরা নিতে পারি না। তবে আমাদের আশা, সব দলই নির্বাচনে আসবে।’
নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, এর আগে প্রধান বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে চেয়েছিলাম। তখন তার সাড়া দেয়নি। যারা সাড়া দিয়েছিল, তাদের নিয়ে আমরা সরকার গঠন করি।
এ প্রসঙ্গে আরেক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের জোট তো আছে। আর যারা আসতে চায় (সরকারে), আসবে। যেসব দেশে সংসদীয় সরকার আছে, তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। সেসব দেশে নির্বাচনের সময়ও সরকারই ক্ষমতায় থাকে। সব দেশের আইনেই তাই আছে। তবে আমরা কেবিনেট ছোট করে নিয়ে করতে পারি।
শেখ হাসিনা বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কখনো আমাদের শত্রু ছিল না। কওমি মাদরাসার মান দিয়ে তাদের উপকার করেছি। তাই তাঁরা দোয়া করছে। তাঁরা যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও সমস্যা নেই বলে থাকে, তাহলে তাদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনাদের শত্রু হেফাজতের প্রধান আল্লামা শফি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু কেউ কওমি মাদরাসার মান দেওয়ার বিষয়ে বাস্তবায়ন করেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করেছেন। তাই আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও সমস্যা নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ধর্মকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আবার ধর্মকে অপব্যবহার করাও উচিত হবে না। আমি চাই না শাপলা চত্বরের মতো কোনো ভয়াবহ চিত্র দেশে ফিরে আসুক। আমি মনে করি, সেই পরিস্থিতি দেশে আসবেও না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ