শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে হাইকোর্ট তদন্ত কমিটির ১৮ দফা সুপারিশ

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীতে দুই বাসের চাপায় তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের হাত হারানোর ঘটনায় গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ১৮টি সুপারিশসহ হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
গণকাল সোমবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলার রুলের ওপর আগামী ১৪ নভেম্বর শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
এ সময় আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। বিআরটিসি’র পক্ষে শুনানি করেন মুনিরুজ্জামান। স্বজন পরিবহনের পক্ষে শুনানি করেন এসএম শফিকুল ইসলাম বাবুল। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
গণ ৩০ মে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের হাত হারানো এবং এর জের পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যুর ঘটনায় দুই বাস কর্তৃপক্ষের (বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন) দায় নির্ধারণ ও দায়ীদের ক্ষতিপূরণ নিরূপণ করতে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন হাইকোর্ট।
ওই অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হিসেবে ছিলেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ও পরিচালক ড. মো. মিজানুর রহমান। কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান এবং নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
অনুসন্ধান কমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বিভাগটি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা, বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান, কার্যকরী প্রশিক্ষণ ও এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা সীমি সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। সরকারের এই বিভাগটির উন্নয়নে জোর দেওয়া উচিত।
১. বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বিভাগটির উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রাংশ, সফটওয়্যারসহ সম্পর্কিত বিষয়টি বৃদ্ধিতে সরকারের জোর দিতে হবে এবং এ জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
২. সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, পুলিশ, বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, নিরাপদ সড়ক চাইসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি কারিগরি টিম গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। বড় দুর্ঘটনাগুলো অনুসন্ধানে এই টিম কাজ করবে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই টিম ঘটনাস্থলে চলে যাবে এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য ধংস হওয়ার আগে তা উদ্ধার করবে।
৩. দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে সিসিটিভি বসাতে হবে। এতে শুধু দুর্ঘটনা অনুসন্ধানই নয় বরং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে।
৪. দুর্ঘটনাগুলোর নথিভুক্ত করা হয় না, তাই প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা নথিভুক্ত করতে হবে। এতে দুর্ঘটনার বিষয়টি নথিভুক্তকরণ এবং গবেষণায় পুলিশের সক্ষমুা বৃদ্ধি পাবে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশকে অবশ্যই দুর্ঘটনার বিষয়ে নথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, অনুসন্ধান এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৫. রাজধানীর বাসগুলোর ভেতর ও বাইরের অবস্থা করুণ। তা সত্ত্বেও বাসগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকাটা ভয়ঙ্কর বিষয়। বাসগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত সেফটি ফিচার (সাইড লাইট, হুইপার, হেড লাইট, টায়ার, প্রবেশের দরজা এবং জানালা) খুবই নিম্ন মানের। তাই কোনও বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হলে সেটি সুন্দর রঙ এবং সেফটি ফিচারগুলো ঠিক আছে কিনা তা দেখতে হবে। নয়তো সেগুলোকে চলতে দেওয়া যাবে না।
৬. বিআরটিসি বাসগুলো দৈনিক লিজ ভিত্তিতে ভাড়ায় চালিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বাসের ক্ষেত্রের এমন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে।
৭. চলন্ত অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখতে হবে। বাসের দরজার কাছে কোনও যাত্রীকে দাঁড়িয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট বাসস্টপেজ বা বে’তে বাস থামার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. বাস বে বা স্টপেজগুলো সব রুটে নির্দিষ্টভাবে পরিচিত থাকবে। কর্তৃপক্ষ সেখানে যাত্রী ছাউনি তৈরি করবে। কোনও চলন্ত বাস ব্যস্ত সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করতে পারবে না। ট্রাফিক পুলিশকে এই নিয়মগুলো কঠিনভাবে মেনে চলতে হবে।
৯. বিআরটিএ কর্তৃক বাধ্যতামূলক একটি ড্রাইভিং স্কুল থাকতে হবে, যেখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইতে হবে। এই স্কুলের সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স টেস্ট করার জন্য আনা হবে না।
১০. থিওরি টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন টপিকের দ্বারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তার দায়-দায়িত্ব, নিয়ম-কানুন শেখাতে হবে।
১১. ড্রাইভারদের থিওরি টেষ্ট হবে বুয়েটের এআরআই দ্বারা। এবং বিআরটিএ প্রাকটিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা করবে।
১২. কোনও রকম দেরি না করে হাসপাতালগুলোকে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি রুল হাইকোর্টে পর্যবেক্ষণে রয়েছে। পাশাপাশি এসব রোগীদের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত চিকিৎসা এবং আর্থিক দিকগুলো বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে ট্রমা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
১৩. ট্রিপ প্রতি বা দৈনিক ভিত্তিতে ড্রাইভার নিয়োগ পদ্ধতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে।
১৪. ড্রাইভারদের বাস কোম্পানি মালিক কর্তৃক মাসিক বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
১৫. দুর্ঘটনা পুনরাবৃত্তির রোধে ও বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধে রাজধানীতে বাস রুটগুলোকে ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিতে চলার পদ্ধতি চালু করতে হবে।
১৬. বৈধ লাইসেন্সের ভিত্তিতে একটি রুটে মাত্র একটি কোম্পানির বাস চলবে।
১৭. ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধিতিটি হবে রুট বা শহরভিত্তিক। তাই প্রতিটি রুট ভিন্ন ভিন্ন রঙিন কোডের দ্বারা আলাদা করা থাকবে।
১৮. এই পদ্ধতিগুলোর ফলে যাত্রীদের আর্থিক সুবিধা হবে এবং বাস কোম্পানিগুলোর ড্রাইভারদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিণা রোধ হবে।
প্রতিবেদনটির আরেকটি অংশে পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, রাজধানীতে মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ। ২০১৮ সালের আগস্টের বিআরটিএ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে মোট যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১১.৭ লাখ। এর মধ্যে প্রাইভেট যানের সংখ্যা ৮.৬ লাখ, যা মোট যানবাহনের ৭৪ শতাংশ। আর পাবলিক যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। শহরের মধ্যে বাস রুট রয়েছে ৩০০টি। গড়ে একটি বাসে ১ হাজার ৫০০ মানুষ চলাচল করতে পারে। রাজধানীর প্রায় ৩ হাজার ৮০০ মানুষ এই ৫ হাজার ও ১১.৭ লাখ যানবাহনের মালিক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ