শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সুখ

আব্দুস সালাম : সগির মিয়া একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। চাকুরি জীবনে তিনি একজন সফল কর্মকতা ছিলেন। একটি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হলেও চাকুরির সুবাদে তিনি অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তিনি জায়গা কিনেছেন। দুই জায়গাতে দুটি বাড়িও বানিয়েছেন। তিনি বর্তমানে যে বাড়িতে থাকেন সে বাড়িটি দশ তলা। আর অন্য বাড়িটি আটতলা। আটতলা বাড়িটি তিনি সম্পূর্ণ ভাড়া দিয়েছেন। প্রতিমাসে বাড়ি দুটির ঘরভাড়া বাবদ তিনি মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করেন। তার এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেমেয়ে দু’জনায় প্রতিষ্ঠিত। ছেলে আমেরিকায় থাকেন আর মেয়ে থাকেন কানাডায়। তারাও যথেষ্ট টাকা-পয়সার মালিক। সগির মিয়ার কোন কিছুর অভাব নেই। চাকুরি পাওয়ার পর থেকে আর্থিক অভাব অনটনের দুঃখ জ্বালা তাকে আর সইতে হয়নি।    

এত ধন-সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সগির মিয়ার মনে কোন সুখ নেই। অতীতের অনেক স্মৃতি তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। তিনি যখন চাকরি করতেন তখন তার বাবা-মা থাকতো গ্রামে। মা-বাবার সঙ্গে থাকতো তার তিন বোন আর এক ভাই। পাঁচ ভাইবোনদের মধ্যে সগির মিয়া ছিলেন সবার বড়। সংসারে যথেষ্ট অভাব অনটন ছিল। সামান্য কিছু কৃষিজমি ছিল বাবার একমাত্র আয়ের উৎস। কৃষিকাজ করে তিনি কোনরকমে সংসার চালাতেন। বড় ছেলে চাকরি পাওয়ার পর বাবা খুব খুশি হয়েছিল। বাবা সগিরের কাছে অনেক কিছু আশা করতেন। তার বিশ্বাস ছিল ছেলের আর্থিক সহযোগিতায় সংসারের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। কিন্তু সগির বাবাকে তেমন করে কোন আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করতো না। তিনি সবসময় বাবা-মার কাছে অভাবী সেজে থাকতেন। কালে-ভদ্রে তিনি টাকা-পয়সা দিয়ে বাবাকে সাহায্য করতেন। অথচ তখনও তিনি বৈধ ও অবৈধ উপায়ে যথেষ্ট টাকা-পয়সা আয় করতেন। আজ তার বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। ভাই-বোনেরা এখনও গ্রামে থাকেন। তবে তাদের সঙ্গে সগিরের তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে।  

সগির মিয়া আজ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য তাকে অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। ইচ্ছে করলেই তিনি যেকোন খাবার খেতে পারে না। আর যেসব খাবার খাওয়ার অনুমতি রয়েছে তাও তাকে পরিমাণ মতো খেতে হয়। ইচ্ছে করলেই তিনি বেশি খেতে পারেন না। কারণ ডাক্তার তাকে পরিমাণ মতো খাওয়ার জন্য একটি মেনু তৈরি করে দিয়েছে। এর বাইরে তার বেশি কিছু খাওয়া সম্ভব নয়। তার স্ত্রীও নানান রোগে ভুগছেন। এমনসময় ছেলেমেয়েরাও কাছে থাকে না। সংসারের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন গৃহকর্মী ও কাজের ছেলে রয়েছে। তারাই মূলত সগির মিয়ার দেখাশুনা করে।

সগির মিয়ার এত সম্পত্তি কে ভোগ করবেন? আর তিনি মারা গেলে এগুলো কে দেখাশুনা করবে? এগুলোর কী হবে? এসব নানান প্রশ্ন তাকে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা দেয়। তার এখন বারবার মনে পড়ে তার বাবা-মায়ের কথা। বাবা-মাকে আর্থিক সাহায্য না করার জন্য তিনি কী কী অজুহাত দেখাতেন সে কথাও তার মনে পড়ে। তিনি কখনও ভাই-বোনদের দেখা শুনা করেননি। তাদের পড়ালেখার খোঁজ-খবর নেননি। সগির মিয়া এখন বুঝতে পারছেন- বাবাকে আর্থিক সাহায্য না করা তার মোটেই ঠিক হয়নি। সামান্য কিছু টাকা-পয়সা খরচ করলেই বাবা-মা খুব ভালো থাকতেন। ভাই-বোনরা ভালোভাবে পড়াশুনা করতে পারতো। তারা খুশি হতো। কিন্তু সগির মিয়া তা করেননি। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে চাকুরি করেছেন। অথচ তিনি কখনও বাবা-মা, ভাই-বোনকে তার বাড়িতে বেড়াতে আসার সুযোগ দেননি। তিনি সবসময় বিলাসী জীবন-যাপন করেছেন। অথচ মা-বাবা কষ্ট করতে করতেই ইহজগত ত্যাগ করেছেন। সগির মনে মনে ভাবছেন- আপনজনদের কষ্ট দেয়া তার মোটেও ঠিক হয়নি। তার এসব কথা মনে হলেই কপোল বেয়ে অশ্রুঝরে। 

এছাড়াও মাঝেমাঝে তার দীর্ঘ কর্মজীবনের কথাও খুব মনে পড়ে। কর্মস্থলে কোন কাজই তিনি ঠিকমতো করতেন না। যেসব কাজের জন্য তাকে খুশি করা হতো কেবলমাত্র সে কাজই তিনি ঠিকঠাক করতেন। কত লোককে যে তিনি ঠকিয়েছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। সেবা প্রত্যাশীরা তার কাছে ছিল জিম্মি। শুধু তা-ই নয়, তার অধিনস্ত কর্মচারীদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতো না। এসব স্মৃতিগুলো তার অবসরের দিনগুলোকে বিষিয়ে তুলছে। সুরম্য অট্টালিকার সুসজ্জিত গৃহের মধ্যে তিনি এখন সুখ খোঁজেন। সে সুখ এখন তার কাছে অধরা। মাঝেমাঝে বারান্দার জানালা ধরে দূর আকাশের পানে চেয়ে থাকেন। তিনি যেন বন্দী হয়ে আছেন। মুক্ত বিহঙ্গের মতো খোলা আকাশে ঘুরে বেড়াতে চান। কিন্তু তিনি মুক্ত নন। কারণ ধন-সম্পদ আর চার দেয়ালের মাঝে তিনি বন্দী।

সগির মিয়ার ছেলেমেয়েরাও খুব ব্যস্ত। দেশে আসার সময় যেন তাদের মোটেই নেই। দুই এক বছর পর পর তারা মাত্র কয়েকদিনের জন্য দেশে বেড়াতে আসে। সগির মিয়ার প্রিয় সন্তানদেরকে তিনি খুব মিস করেন। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। এভাবে জীবনযাপন করতে সগিরের আর মোটেও ভালো লাগে না। সবকিছু তার কাছে অসহ্য লাগছে। এত কিছু পেয়েও তিনি এখন হতাশায় ভুগছেন। ধনসম্পদই তার জীবনের সব সুখকে কেড়ে নিয়েছে। সবকিছুর বিনিময়ে তিনি এখন একটু ভালো থাকতে চান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ