রাজশাহীর জ্ঞান সাধনার পীঠস্থান ঐতিহ্যবাহী শাহ্ মখদুম লাইব্রেরি
সরদার আবদুর রহমান : রাজশাহী নগরীর ঐতিহ্যবাহী শাহ মখদুম ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরী স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পটভূমি রয়েছে। এখানে শিক্ষা বিস্তার, জ্ঞান সাধনা, মনন চর্চা ও সমাজ গঠনে রাজশাহীর তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ‘আঞ্জুমান-ই-ইসলাম’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিলো বিশেষত স্থানীয় মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সামাজিক, বৈষয়িক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান-গবেষণার প্রচার ও প্রসার। নগরীর পাঠানপাড়া এলাকায় হাই মাদ্রাসার পূর্ব-দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের নান পরিবর্তন করে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে রাখা হয় ‘রাজশাহী মুসলিম ক্লাব’। ১৯২৮-২৯ সালে স্থানীয় মখদুম এস্টেট অর্থাৎ হযরত শাহ্ মখদুম রূপোশ (রহ.) দরগাহ পাবলিক ওয়াক্ফ এস্টেট ক্লাবটিকে কিছু জমি দান করে। এ বিষয় সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয়ে ইমারত নির্মাণ করে এর নাম রাখা হয় মুসলিম ইনস্টিটিউট। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জিন্নাহ্ ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ইনস্টিটিউটের নাম রাখা হয় শাহ্ মখদুম ইনস্টিটিউট ও এর অডিটোরিয়ামের নাম রাখা হয় মাদার বখশ হল।
এর বর্তমান অবস্থান রাজশাহী সরকারি মাদ্রসার দক্ষিণ পাশের শাহ্ মখদুম রাস্তার দক্ষিণ পাশে, হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্র উত্তরে ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব পাশে অবস্থিত। শুরুতে আনজুমান-ই-ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি ও সেবামূলক কাজে উৎসাহিতকরণের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে সভার আয়োজন করে। ফলে রাজশাহী মোহামেডান এসোসিয়েশন বা রাজশাহী মোহামেডান সমিতি, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম ও পরবর্তীতে দি রাজশাহী মুসলিম ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দি রাজশাহী মুসলিম ক্লাবই তৎকালীন মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত প্রথম গণপাঠাগার। প্রকৃতপক্ষে এ ক্লাব প্রতিষ্ঠার পূর্বে রাজশাহী শহরে মুসলমানদের কোন পাবলিক লাইব্রেরী বা গণগ্রন্থাগারের তথ্য পাওয়া যায় না। রাজশাহী মুসলিম ক্লাব নাম থাকাকালে এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯২৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজশাহী আগমন করেন। কবির আগমন উপলক্ষে বাগধানীর কাচারী প্রাঙ্গণে রাজশাহীর তৎকালীন জেলা জজ চৌধুরী টিআইএম নূরুন্নবীর সভাপতিত্বে একটি সুসজ্জিত সভা মঞ্চের আয়োজন করা হয়। মুসলিম ক্লবের সদস্য ছিলো দু’শতাধিক। তৎকালীন রাজশাহীর মুন্সেফ ওবায়দুল সোবহান সভাপতি, আব্দুল হাকিম সম্পাদক ও চৌধুরী নুরুন্নবী এর পৃষ্ঠপোষক মনোনীত হন। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের দক্ষিণে টিবি ক্লিনিক সেন্টারে একখ- জমির ওপর এ ক্লাবের একটি গৃহ নির্মিত হলে ক্লাবটি সেখানে স্থানান্তর হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ২৯ জুন মুসলিম অফিসার ক্লাবে আসে এবং এডিপি আব্দুল জব্বারের উদ্যোগে ও জেলা প্রশাসক আব্দুল মজিদের প্রচেষ্টায় মুসলিম ক্লাবে মেডিকেল স্কুল স্থাপিত হয়।
পরবর্তীকালে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক আব্দুল মজিদ প্রচেষ্টা চালিয়ে অফিসার্স ক্লাব ও মুসলিম ক্লাবকে একত্রিত করে জিন্নাহ্ ইসলামিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ‘দি মুসলিম ক্লাব’ স্থাপনের দু’বছর পরই নাম পরিবর্তন করে মুসলিম ইনস্টিটিউট রাখা হয়। আব্দুল মজিদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইনস্টিটিউটের বৃহৎ কলেবর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দানশীল ব্যক্তিরা সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগার ও পাঠাগার, পাঁচ শতাধিক আসন বিশিষ্ট জিন্নাহ্ হল, সাত কামরার এমদাদুল উলম মাদ্রাসা, কোরআন ও হাদিস ক্লাসের একটি কামরা ও খেলাধুলার জন্য দুই কামরার প্যাভিলিয়ন গড়ে ওঠে। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের নেতৃত্বে ১৯৫০ সালে এখানে একটি সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫১ সালে ইনস্টিটিউটের সাহিত্য পত্র নামে একটি বার্ষিকী প্রকাশিত হয়। রাজশাহী জেলার ডেপুটি কমিশনার পদাধিকার বলে এর সভাপতি থাকতেন।
গ্রন্থাগার পরিচালনা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, পত্রিকা প্রকাশনা, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, সামাজিক কাজ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রভৃতি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এ ইনস্টিটিউট পরিচালনা করতো। ইনস্টিটিউটের আয় সদস্যগণের চাঁদা, সরকারি অনুদান ও নিজস্ব সম্পত্তি।
১৯৯৭-২০০০ সালে পুরনো ইনস্টিটিউট ভবন ভেঙ্গে বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে লাইর্রেরীর বইয়ের সংখ্যা ১৬ হাজার, দৈনিক পত্রিকা ২৬টি, সাপ্তাহিক পত্রিকা ৩টি। এখানে পত্রিকার সৌজন্য কপি আসে। দৈনিক গড় পাঠক সংখ্যা প্রায় ১০০ জন। লাইব্রেরীটি ২৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক কমিটির সভাপতি। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুল করিম সম্রাট ও গ্রন্থাগারিক কামারা রহিম।