শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবি

সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচনের তারিখ এক মাস পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। ১৩ নভেম্বর ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সভাশেষে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের যে তারিখে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে, সে সময় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের ছুটি থাকবে। তাছাড়া খ্রিস্টীয় নতুন বছর এবং তার প্রাক্কালে বছরের শেষ দিন তথা থার্টি ফার্স্টের আনন্দ অনুষ্ঠান ও ছুটির আমেজে শুধু খ্রিস্টানরা নয়, এদেশের সাধারণ মানুষও মেতে ওঠে।
পাশাপাশি রয়েছে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আসতে পারা-না পারার বিষয়টি। কারণ, বড়দিন এবং বর্ষশুরুর উৎসব ও আনন্দ অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন বলে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশে আসতে পারবেন না। ফলে তাদের পক্ষে সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব হবে না। এই সুযোগে ক্ষমতাসীনদের জালিয়াতি করার আশংকা রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রসঙ্গত বলেছেন, সরকার চুরি করে নির্বাচনে জিততে চায় বলেই সারা দুনিয়ার মানুষ যখন উৎসবের ছুটিতে থাকবে তখন নির্বাচনের তারিখ দেয়া হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে তারিখ পেছানোর দাবি জানানোর উদ্দেশ্যে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গতকাল দুপুরে নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন আর পেছানোর উপায় নেই। নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বরই অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, গত ১৩ নভেম্বর রিটার্নিং অফিসারদের সমাবেশে দেয়া বক্তৃতায়ও সিইসি ‘স্পষ্ট’ ভাষায় একই ঘোষণা শুনিয়েছিলেন। তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অঘোষিতভাবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে দাঁড়িয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য জাতীয় নির্বাচনের তারিখ পেছাতে হবেÑ এর চেয়ে হাস্যকর, অবান্তর, অবাস্তব, ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক দাবি আর হতে পারে না!
লক্ষণীয় যে, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুধু বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কথা বলেছেন। তিনি খ্রিস্টানদের বড়দিন এবং নববর্ষ উপলক্ষ্যে উৎসব-আনন্দের বিষয়ে পাশ কাটিয়ে গেছেন। এদিকে ‘স্পষ্ট’ ভাষায় না পেছানোর ঘোষণা দিলেও সিইসি আবার জানাননি, কেন নির্বাচন পেছানোর আর কোনো উপায় নেই। কথাটা বলার কারণ, নির্বাচন পেছানোর বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন পেছানোর নজীর রয়েছে। যেমন ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় দু’বার তারিখ পরিবর্তন করে নির্বাচন পেছানো হয়েছিল। কাজেই আর পেছানো সম্ভব নয় বলে যে সিদ্ধান্ত সিইসি ঘোষণা করেছেন তা রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো সমর্থন পায়নি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বরং এর যুৎসই জবাব দেয়া হয়েছে। সিইসির সিদ্ধান্তমূলক ঘোষণার জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেছেন, সিইসি তো একাই সবকিছু বলে চলেছেন। কিন্তু তিনি বললেই তো হবে না। আমরা অবশ্যই আমাদের দাবি জানাবো এবং সিইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি মানতে হবে।
অন্য অনেকের সঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বিএনপির মহাসচিবের দাবিকে সমর্থন করেছেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা উচিত। অনেক রাজনৈতিক দল যেহেতু দাবি জানাচ্ছে সেহেতু ইসির উচিত দাবিটি মেনে নেয়া। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনও মনে করেন, খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উৎসব ও অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলো দাবি জানিয়েছে বলে কমিশনের উচিত তা বিবেচনা করা। তার মতে ৩ থেকে ১০ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
আমরাও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবিকে বাস্তবসম্মত মনে করি। কারণ, সংখ্যায় স্বল্প হলেও খ্রিস্টানরা বাংলাদেশেরই নাগরিক। সুতরাং তাদের বাৎসরিক প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিন তথা ২৫ ডিসেম্বরের পরপর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের পক্ষে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া এর পরপর রয়েছে থার্টিফার্স্ট ও নববর্ষ উদযাপনের উপলক্ষ। এ দুটি উৎসবের কারণে বিশেষ করে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পর্যবেক্ষকরা আসতে পারবেন না বললেই চলে। বিষয়টিকে আমরা স্বাভাবিক ভাবতে পারি না। কারণ, ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এবং এই অভিমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও যে, ক্ষমতাসীনরা চুরি করে নির্বাচনে জিততে চান বলেই এমন এক সময়ে নির্বাচনের তারিখ দেয়া হয়েছে যখন সারা দুনিয়ার মানুষ উৎসবের ছুটিতে থাকবে।
বলা দরকার, তারিখের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন প্রথম থেকেই নেতিবাচক উদ্দেশ্য ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে এসেছে। কারণ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দাবি জানিয়েছিল, সরকারের সঙ্গে সংলাপ শেষ হওয়ার আগে যাতে নির্বাচনের তারিখ তথা তফসিল ঘোষণা না করা হয়। ঐক্যফ্রন্ট তফসিলের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার জন্যও দাবি জানিয়েছিল। অন্যদিকে সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার একদিনের মধ্যেই তফসিল ঘোষণা করেছিল কমিশন। তারও আগে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন সিইসি। বলা হয়েছে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সামান্য গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে কমিশন শুধু ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন।
সিইসির সর্বশেষ সিদ্ধান্তের পেছনেও যে একই ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই কাজ করেছে সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেছে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যে। এরই পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে বাধাহীনভাবে ফর্ম বিক্রির উৎসব করতে দেয়ার পর বিএনপির বেলায় নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ তুলে পুলিশকে মাঠে নামানোর এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোর মধ্য দিয়েও নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা খুইয়েছে। আমরা মনে করি, এসবের কোনো একটিও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুকূল নয়। কমিশনের উচিত এমন পদক্ষেপ নেয়া, যাতে ঘটনাপ্রবাহে অশুভ কিছু ঘটতে না পারে এবং নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এজন্যই নির্বাচনের তারিখ এক মাস পিছিয়ে দেয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ