বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সোনা চোরাচালানের মূল হোতার বিরুদ্ধে মামলা হয় না ॥ শাস্তি পান বহনকারীরা

সংগ্রাম ডেস্ক : সোনা চোরাচালান মামলায় ২০১৭ সালের ২ মার্চ বেলাল উদ্দিন নামের এক প্রবাসী শ্রমিককে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত। একইসঙ্গে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলা ট্রিবিউন
২০১৫ সালের ৩১ মার্চ দুবাই থেকে একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন বেলাল উদ্দিন। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর র্যাবের মুখোমুখি হয়ে দৌড়ে পালানোর সময় গ্রেফতার করা হয় তাকে। তার শরীর তল্লাশি করে পাওয়া যায় ১৯ পিস সোনার বার, যার বাজার মূল্য ৮৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরে তার বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। একই বছরের ২৬ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ১ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন হয়। বিচার শুরু হলে ১৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
চোরাকারবারি হিসেবে সাজা পাওয়া বেলালের পরিচয় দুবাই প্রবাসী। কর্মসূত্রে তিনি একজন শ্রমিক। দেশে আসার টিকিট আর নগদ অর্থের প্রলোভনে পড়ে চোরাকারবারি হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়েছে তাকে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত দু’বছরে (২০১৬-২০১৭) নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ১১টি মামলায় সাজা হওয়া অন্য ১০ জনের পরিচয়ও প্রবাসী শ্রমিক, লাগেজ ব্যবসায়ী বা বিদেশী নাগরিক। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া এসব মামলায় সাজা হয়েছে ১১ জনের। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর মতে তারা কেউই মূলহোতা নন। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অন্য আট জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদেরকে আর্থিক দণ্ডও দিয়েছেন আদালত। যাদের সাজা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন মাত্র বিদেশি নাগরিক।
চট্টগ্রাম ও সিলেটের আদালত ও কারাগার সূত্র জানায়, বিদেশী নাগরিক ছাড়া অন্য ১০ জনই জামিনে বের হওয়ার পর পলাতক রয়েছেন।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা
মামলার নথিপত্রপর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদেশী নাগরিকসহ ১১ জনই ‘গডফাদার’দের নির্দেশে বিদেশ থেকে সোনার বার বহন করে এনে দেশে গ্রেফতার হন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোনার চালান যার বা যাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, তাদের খুঁজে পাননি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে বহনকারীরা বলেছেন, উড়োজাহাজে যাতায়াতের টিকিট আর নগদ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সোনার বার বহন করে বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে আনেন তারা। বিদেশ থেকে যার নির্দেশে সোনা বহন করা হয়, তারও বিস্তারিত পরিচয় জানাতে পারেননি বহনকারীরা। দেশে যোগাযোগের জন্য বহনকারীদের যে মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল, তার রেজিস্ট্রেশন ছিল না।
আসামীপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য
সোনা চোরাচালানের একাধিক মামলায় আসামীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন অ্যাডভোকেট জহুরুল ইসলাম। তিনি জানান, মামলার তদন্তকালে অনেক আসামীর জামিন হয়। আবার সাজা হওয়ার পরও জামিন হয় অনেকের। জামিন পাওয়ার অধিকার সব আসামীরই থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসামীরা উধাও হয়ে যান। তারা আর আইনজীবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন না।
গত বছর ছয় মামলার রায়, পাঁচটিই চট্টগ্রামের
গত বছরের ২ মার্চ সোনা চোরাচালান মামলায় দুবাই প্রবাসী বেলাল উদ্দিনের ছয় বছরের সাজা হয়। ৬ মার্চ (২০১৭) জামাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. শাহে নূর। দুবাই প্রবাসী জামাল ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭৫টি সোনার বারসহ গ্রেফতার হন। পরে এ বিষয়ে মামলা হয় পতেঙ্গা থানায়।
৫ এপ্রিল (২০১৭) চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ মো. শাহে নূর সোনা চোরাচালান মামলায় আফসার মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট দুবাই থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৫টি সোনার বারসহ গ্রেফতার হন আফসার।
৫ জুলাই (২০১৭) সোনার চোরাচালান মামলায় মোহাম্মদ বদিউল আলম এক ব্যক্তিকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত। একইসঙ্গে বদিউলকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৪৫টি সোনার বারসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন বদিউল।
১৬ আগস্ট (২০১৭) স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় কাতার প্রবাসী কাতারুজ্জামানকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। একইসঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ২০১৪ সালে ১ মে সিলেট এম. এ. জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছয়টি সোনার বারসহ গ্রেফতার হন কাতারুজ্জামান।
১৯ নভেম্বর (২০১৭) সোনা চোরাচালান মামলায় আব্দুল করিম নামে এক ব্যক্তিকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। একই রায়ে করিমকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ের আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর দুবাই প্রবাসী করিম ১৫টি সোনার বারসহ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন। নিম্ন আদালতে সর্বশেষ নিষ্পত্তি হওয়া সোনা চোরাচালান মামলা এটি।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত তিন চোরাচালানিই চট্টগ্রামের
সোনা চোরাচালানের মামলায় প্রথম কোনও আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. শাহে নূর। ২০১৬ সালের ১৬ মে এই রায় ঘোষণা করেন তিনি। আসামির নাম আব্দুস শুক্কুর। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল মাসকাট থেকে আসা শুক্কুর ৪০টি সোনার বারসহ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন।
২০১৬ সালের ৩০ মে সোনা চোরাচালান মামলায় আব্দুল্লাহ আল আমিন নামে আরেকজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল সেশন জজ আদালত। একইসঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ২০১৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর দুবাই প্রবাসী আল আমিন ৫৮টি সোনার বারসহ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন।
৫ সেপ্টেম্বর (২০১৬) সোনা চোরাচালান মামলায় সরওয়ার নামে এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত। ২০১৪ সালের ১৪ জুন ১৩৮টি সোনার বারসহ গ্রেফতার হন সরওয়ার।
আরও দুই মামলার রায় হয় ২০১৬ সালে
২৬ জুন (২০১৬) সোনা চোরাচালান মামলায় মো. সেলিম উদ্দিনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রামের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। একইসঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
২ কেজি ওজনের ২৪টি সোনার বারসহ দুবাই প্রবাসী সেলিম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি।
২ নভেম্বর (২০১৬) বাসলিনা বিনতে রাজা মালেক নামে মালয়েশিয়ান এক নারীকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ডও দেওয়া হয় তাকে। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর বিমানে করে মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় আসা বাসলিনা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছয়টি সোনার বারসহ গ্রেফতার হন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ