প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ ৮ দফা দাবি
চট্টগ্রাম ব্যুরো : প্যারিস চুক্তির আওতায় জলবায়ু অর্থায়নে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য আইনী বাধ্যতামূলক একটি ‘‘স্বচ্ছতা কাঠামো” অবলম্বন করে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের শুদ্ধাচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং দূষণকারী কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদান নীতি বিবেচনা করে ঋণের পরিবর্তে শুধু অনুদান, যা উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ এবং ‘নতুন’ প্রতিশ্রুতি হবে- এমন স্বীকৃতি দিয়ে জলবায়ু অর্থায়নের সংজ্ঞায়ন করাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগর।
আসন্ন কপ-২৪ উপলক্ষে গতকাল চট্টগ্রাম মহানগরীর ইস্পাহানী মোড়, লালখান বাজারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এসব দাবি তুলে ধরে সনাক-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগর।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী, সভাপতি, সনাক-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগর, প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, সাধারন পর্ষদ সদস্য টিআইবি, সদস্য সনাক ও বিশিষ্ট নারী নেত্রী ও সনাক সদস্য জেসমিন সুলতানা পারু ও স্বচ্ছতার জন্য নাগরিক (স্বজন) চট্টগ্রাম মহানগরের সমন্বয়ক এসএম ফরহাদ উল্লাহ। জেবুন নাহার শারমিন ইয়েস সহ দলনেতা সম্মেলন উপলক্ষে মনাক-টিআইবি’র ধারণাপত্র পাঠ করেন। মানবন্ধনে সনাক-টিআইবি, স্বজন, ইয়েস, ইয়েস ফ্রেন্ডস সদস্যবৃন্দ, টিআইবি কর্মকর্তাবৃন্দ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ সহ শতাধিক লোক অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “আসন্ন কপ ২৪ সম্মেলনে জলবায়ু স্বচ্ছতা কাঠামোসহ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে চূড়ান্ত রূপরেখা গৃহীত হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা যা বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল প্রদান, জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সহায়ক হবে। জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না থাকায় স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য অনুদানভিত্তিক অর্থায়নে তীব্র অনিশ্চয়তা পরীলক্ষিত হয়েছে। যেমন সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশসহ ৭টি দেশকে সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) সহ আন্তর্জাতিক উৎস হতে প্রদত্ত সর্বমোট অভিযোজন অর্থায়নের মাত্র ৭% প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া এই স্বচ্ছতা কাঠামো দূষণকারী কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদান নীতি বিবেচনা করে ঋণের পরিবর্তে উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ এবং ‘নতুন’ প্রতিশ্রুতি হিসেবে শুধু সরকারি অনুদান হিসেবে অর্থায়ন নিশ্চিতের পথ সুগম করবে। পাশাপাশি, চরম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো জিসিএফ থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল পাবার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় জলবায়ু অর্থায়ন ছাড়ে বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে।”
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতীয় বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপকে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি উল্লেখ করে প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখাসহ এ অর্থায়ন এর সদ্বব্যবহার নিশ্চিতে সময়াবদ্ধ কার্য-পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। নারী নেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, ‘‘জাতীয় বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান (এনআইই) হিসাবে বাংলাদেশের ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ইডকল) এবং পিকেএসএফ জিসিএফ হতে সরাসরি তহবিল সংগ্রহে যোগ্যতা অর্জন করলেও কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রয়োজনীয় আর্থিক, পরিবেশগত ও সুশাসন সংশ্লিষ্ট মানদন্ড অর্জন নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই এ অবস্থা নিরসনে প্রকল্প অনুমোদন ও তহবিল বরাদ্দে স্থানীয় ঝূঁকিকে প্রাধান্য দিয়ে তহবিল ব্যবহারে নাগরিক অংশগ্রহণ, তথ্যের উন্মুক্ততা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচারের নিশ্চিত করাসহ বাস্তবায়নে নিরপেক্ষ তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু অর্থায়নের সাথে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে দর-কষাকষির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি, একে অপরকে প্রতিপক্ষ ভাবার মানসিকতা পরিহার করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পূরক ভূমিকা পালনে সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। এর পাশাপাশি অভিযোজন অর্থায়নের সদ্বব্যবহার তথা জলবায়ু সংশ্লিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে উপযোগী দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে বাংলাদেশ সরকারকে অধিকতর সচেষ্ট হতে হবে।”
টিআইবি’র পক্ষ থেকে উপস্থাপিত দাবিগুলোর মধ্যে আছে: উন্নত দেশগুলো থেকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও সম্পদ সরবরাহের জোর দাবি উত্থাপন করা; উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ জলবায়ু তহবিল যোগানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে জলবায়ু তহবিল প্রদানে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করা; ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত দেশসমূহের পরিকল্পিত অভিযোজনের জন্য সঠিক প্রয়োজন নির্ধারণপূর্বক জিসিএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল যথাসময়ে ও সহজে সরবরাহের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সাথে সমন্বিতভাবে দাবি উপস্থাপন করা এবং তা আদায়ে দর-কষাকষিতে দক্ষতা প্রদর্শন করা; স্বল্পোন্নত দেশসমূহে অভিযোজন বাবদ অর্থায়নের অতিরিক্ত হিসেবে ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায় বিশেষ তহবিল গঠন এবং তার জন্য দ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সোচ্চার হওয়া; জলবায়ু-তাড়িত বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসন, কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতে জিসিএফ ও অভিযোজন তহবিল থেকে বিশেষ তহবিল বরাদ্দ নিশ্চিত করা; জিসিএফ এর ট্রাস্টি বোর্ডের কাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি সমতা-ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক এবং কার্যকর ট্রাস্টি বোর্ড গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের অভিযোজন কার্যক্রমে অনুদানকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।
উল্লেখ্য, জলবায়ু অর্থায়ন এবং তার ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতে টিআইবি ২০১১ সাল হতে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অংশীজনের সাথে গবেষণা-ভিত্তিক সুপারিশ বাস্তবায়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর ফলে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন নিশ্চিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যেমন হয়েছে পাশাপাশি টিআইবি প্রণীত জলবায়ু প্রকল্প তদারকি কৌশল ও সামাজিক নিরীক্ষা টুল কেনিয়া, রুয়ান্ডা, মালদ্বীপ, নেপাল ও মেক্সিকোতে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতি বছর কপ সম্মেলনের প্রাক্কালে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণালব্ধ সুপারিশ সম্মেলনের অংশীজনের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হয়।