বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভুলে যাও সব ভণ্ডনীতি ঐশী আলোয় খুঁজতে হবে আলোকের পথ

আবুল হাসান জারজিস : একটি দেশের রাজনৈতিক নিয়ম-পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আদর্শ এমন একটা জিনিস যা পুরো পৃথিবীতে এক ও অভিন্ন থাকে। আদর্শ সেই বিষয় যেটা সকলের কাছে স্বীকৃত ও প্রত্যেকেই মনস্তাত্বিকভাবে যাকে পছন্দ করে কিন্তু স্বার্থের কারণে অধিকাংশই বিরোধিতা করে এই আদর্শকে। আদর্শ হল সততা, উত্তম চরিত্র, নৈতিকতা, নিষ্ঠা, পরোপকারিতা প্রভৃতি সৎ গুণাবলি। এই আদর্শবাদী সংগঠন ধর্মভিত্তিকও হতে পারে আবার ধর্মহীনও হতে পারে। এরা কোন একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। আদর্শবাদী সংগঠনগুলো সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে এক একজন আদর্শরূপে তৈরি করতে চায়। যারা হবে সৎ, চরিত্রবান, নৈতিকতা সম্পন্ন, নিষ্ঠাবান ও পরোপকারী। কে আছে একজন সৎ মানুষকে অপছন্দ করে? বাস্তবতা হলো অধিকাংশই সৎ মানুষগুলোর বিরোধিতা করে। কারণ, মানুষ সাধারণভাবে অসৎপ্রবণ। কোথাও একজন সৎ মানুষ থাকলে তার সততার কারণে অসৎ ও দুশ্চরিত্রবান মানুষগুলো তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে বাধাগ্রস্ত হয়। একারণেই অসৎ মানুষগুলো শত্রুতা ভাব পোষণ করে। বস্তুত চরিত্রবান, নৈতিকতাসম্পন্ন, নিষ্ঠাবান, পরোপকারী মানুষগুলোকে শুধু সকলে পছন্দই করে না বরং অসৎ লোকগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কথা বলার সময় এই গুনসম্পন্ন মানুষগুলোকেই উদাহরণ হিসাবে পেশ করে। এই গুনসম্পন্ন লোকগুলোর সমাগম যেই সংগঠন করতে চায় অথবা সাধারণ লোকদেও এই গুণে গুণান্বিত করতে চায় তাদেরকেই এই প্রবন্ধে আদর্শবাদী সংগঠন হিসাবে অবহিত করা হবে। তবে আজকের বিষয়ে শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীরাই অন্তর্ভুক্ত হবে।
একটি আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের মুল উদ্দেশ্য থাকে আগামী প্রজন্মের কাছে এমন একটি নজির স্থাপন করা যেখানে কোন দুর্নীতিবাজ থাকবে না, থাকবে না কোন দুশ্চরিত্রবান, ফাঁকিবাজ কিংবা স্বার্থপর। প্রত্যেকেই হবে কর্মঠ, যোগ্য, দক্ষ ও মানসম্মত। যাতে করে আগামি প্রজন্মের কাছে একটা নজীর স্থাপন করা যায়। পড়া-লেখায় এরা থাকবে সবার শীর্ষে। বিভিন্ন সময় স্ব-জাতির জন্য দাবি আদায়ের আন্দোলন করবে। তবে মুল কাজ থাকবে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করা। এই ঘুনেধরা, চরিত্রহীন, লম্পটদের রাজনীতির সাথে কোন আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের ন্যূনতম সম্পর্ক থাকতে পারে না।
আজকের এই প্রবন্ধটা যেহেতু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ একটু করা দরকার। উল্লেখ্য, একটি আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠন শুধু কোন দেশের নয় পুরো পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতির কোন গতিপথ নাই। কারণ অংকের সঠিক উত্তর একটাই হয় আর ভুল উত্তরের কোন ঠিক নাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কোন রাষ্ট্র প্রধান আসে নি যাকে মানুষ আদর্শ হিসাবে মেনে নেবে। সততা, চরিত্রবান, নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়ে কেউই কোন নজির স্থাপন করতে পারে নি। রাষ্ট্র প্রধান যেই আসুক প্রত্যেকেই তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, এবং দলের জন্য কাজ করেছেন। যেহেতু দলে দেশের একটা অংশ জনগোষ্ঠী থাকে তাই তাদের উন্নয়ন মাধ্যমে দেশের কিছু উন্নয়ন হয়।“আমি কোন প্রকার দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না” বিবেকের সাথে কোন রাষ্ট্র প্রধানই এ কথা বলতে পারবে না। বরং তারা এমন সব দুর্নীতি করেছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। অন্যান্য এম.পি, মন্ত্রীদের অবস্থা একই। এটা কোন নির্দিষ্ট দলের কথা বলছি না। গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অসচ্ছতা,নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির প্রবণতা সেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচন আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না।
বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ ও রাজনৈতিক পন্থা হল গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র যে স্পষ্ট একটি ধোঁকা তা অনেকেই জানে না বা বোঝে না। যারা জানে বা বোঝে তারা বিষয়টি স্পষ্ট করে না। সর্বপ্রথম গণতন্ত্রের উদ্ভব হয় গ্রিকে। গ্রিকের একজন দার্শনিক বলেছিলেন, গণতন্ত্রের একটি প্রধান সমস্যা হল, গণতন্ত্রের নেতারা সবসময় জনগনের খেয়াল-খুশির কাছে নতি স্বীকার করতে হয় যাতে তাদের সমর্থন পাওয়া যায়। আর এভাবেই নেতা কখনো অবিচল, সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। নীতিগতভাবে একজন নেতার এরূপ করলে সে জনমত হারাবে। এর ফলে তার অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হবে না। বস্তুত গণতন্ত্র নিজেই অগণতান্ত্রিক। আমি এ ব্যাপারে মাত্র দুটি যুক্তি উপস্থাপন করবো। বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে প্রবন্ধটি পুস্তিকা হয়ে যাবে। প্রথমত, ভোট ভাগাভাগি হয়ে স্বল্প সংখ্যক ভোটে প্রার্থী নির্বাচিত হয় আর অধিকাংশ ভোটই নষ্ট হয়। গণতন্ত্র নাকি অধিকাংশের মতকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু বাস্তবতা কতটুকু? আমি বিশ্লষণ করে দেখলাম, ধরুন, কোন একটি আসনে  মোট ভোট আছে ৮ লক্ষ। সেখানে প্রার্থী আছে  মোট ৫ জন। সেখানে ক পেল ২ লক্ষ ১০ হাজার, খ পেল ২ লক্ষ, গ পেল ১.৫ লক্ষ, ঘ পেল ১.৫ লক্ষ, ঙ পেল ৯০ হাজার। এখন বিজয়ী হবে কে? অবশ্যই ক। ক মাত্র ২৬.২৫% ভোট পেয়ে বিজয়ী হবে আর ৭৩.৭৫% ভোটই পুরো নষ্ট হবে। আর যদি জাতীয় নির্বাচনের কথা চিন্তা করেন তাহলে আরো অবাক হবেন। ধরুন, সারাদেশে  মোট ভোট আছে ১০ কোটি আর সিট আছে ৩০০টি। সেখানে ১৩৫ সিটে ক জোট ভোট পেল ৬ কোটি আর ১৬৫ সিটে খ জোট ভোট পেল ৪ কোটি। কারণ সকল আসনে জনসংখ্যার ঘনত্ব সমান নয়। কোন জোট ক্ষমতায় যাবে? অবশ্যই খ জোট। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র মানবজীবনের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। এই পৃথিবীতে কোন গণতান্ত্রীক নেতা বা সরকার তার স্বদেশে বা তার কর্তৃত্বাধীন সীমানার মধ্যে বলতে পারি নাই। “আমি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বা আমি যা করি তাই গণতন্ত্র” সে যখনই এ ধরনের কোন কথা বলেছে সাথে সাথেই তারই সীমানার মধ্যে একটি বড় অংশ তাকে গণতন্ত্রের হত্যাকারী বলে অবহিত করেছে। এই সংখ্যাটা তার ভোটের সংখ্যার চেয়ে বেশী। যখন কোন দেশের ৫০% এর বেশী জনগণ পদত্যাগ দাবি করে সে কি পদত্যাগ করে? জর্জ বুশ যখন ইরাক অবরোধ করেছিল তখন তার দেশের অধিকাংশ জনগণ ইরাক অবরোধের বিরোধিতা করলেও সে অবরোধ তুলে নেই নি। যে গণতন্ত্রের কোন বাস্তবায়ন কেউ দেখাতে পারে নাই সেটা কিভাবে মানব জীবনের সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে পারে?
বাংলাদেশের গণতন্ত্রটা কেমন সেটা একটু দেখা দরকার। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে মাত্র ১৩ মিনিটে গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের রূপ নিল। পাকিস্তান আমলে  শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গণতন্ত্রের অগ্রপথিক। সবসময়ই দাবি আদায়ের আন্দোলন করেছেন। সব সময়ই জনগণের পক্ষে কাজ করার কথা বলেছেন। জনগণের জন্য লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন। ১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনে গিয়ে ৯৮% ভাগ আসন পেয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে ক্ষমতায় এলে সারাজীবনের গণতন্ত্র ৭৫ সালে সংসদে মাত্র ১৩ মিনিটের একটি বক্তব্যতেই পরিবর্তন হয়ে গেল। এভাবেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রবক্তা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে গঠন করলো বাকশাল। এ ইতিহাস কারো কাছেই গোপন নেই। গণতন্ত্রের পরবর্তী রূপই হল স্বৈরতন্ত্র ,নিজতন্ত্র বা ইচ্ছাতন্ত্র। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ গণতন্ত্র ধ্বংস করে ক্ষমতা দখল করে পরদিনই ঘোষণা দিল, আমি গণতন্ত্র দেব। আমার প্রশ্ন হল, যদি তিনি গণতন্ত্র দেবেন তাহলে কেন তিনি গণতন্ত্র হত্যা করলেন। মুলত গণতন্ত্রের কোন বাপ-মা নাই। এটি হল রাজনৈতিক মতবাদের পিতৃ পরিচয়হীন অবৈধ সন্তান। যেই ক্ষমতায় আসে সেই গণতন্ত্রের জনক বা গণতন্ত্রের মাতা বলে দাবি করে। মুজিব, জিয়া, সাত্তার আর এরশাদের শাসন পরিচালনার কোন পার্থক্য নাই। ফাঁকা বুলি সবাই দেয়। ১৯৯৬ সালে বি.এন.পি. তত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলো তখন আ’লীগ বললো বি.এন.পি. গণতন্ত্র হত্যা করেছে। কালের বিবর্তনে আজও বাংলাদেশে ঠিক একই অবস্থা। পার্থক্য শুধু, তখন বি.এন.পি. ছিল সরকারি দল আর আ’লীগ বিরোধী দল আর এখন আ’লীগ সরকারী দল আর বি.এন.পি বিরোধী দল। বি.এন.পি. সরকারি দলে থেকে প্রশাসনকে বিরোধী দল দমন করার জন্য ব্যবহার করেছে আর আ’লীগ জ্বালাও পোড়াও করেছে। আজ আ’লীগ ঠিক তাই করছে যা বি.এন.পি করেছিল বি.এন.পি ঠিক তাই করতেছে যা আ’লীগ করেছিল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা এবং বৈষয়িক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে বর্তমান বিরোধী দলের উত্থানটা খুব সহজে হচ্ছে না। মূলত বাংলাদেশের প্রধান দুটি দল হল টাকার এপিঠ ওপিঠ। শতকরা হারে কিছুটা কম বেশী থাকতে পারে। নচিকতার ‘আমি মূখ্য শুখ্য মানুষ বাবু এবং ভয়’ গান দুটিতে এই গণতন্ত্র নামক ভ-তন্ত্রের আসল রূপটি প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশে নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সদস্যদের মধ্যে কিছু লোককে মনোনয়ন দিয়ে প্রার্থী রূপে দাঁড় করায়। এরপর তাকে বিজয়ী করার জন্য শুরু হয় সর্বাত্মক চেষ্টা। অসংখ্য কর্মী কাজ করে। শুরু হয় চা-বিস্কুট, পান-সিগারেট, মদ-গাঁজা আর টাকাপয়সার ছড়াছড়ি। নির্বাচনের দিন কেন্দ্র দখল আর বুথ লুটপাটের মাধ্যমেই বিজয়ী হয় একজন প্রার্থী। সাধারণত নৈতিকতার মানে উত্তীর্ণ কোন ব্যক্তিই প্রার্থী হয় না। প্রার্থী হয় তারা যাদের আছে অঢেল টাকা-পয়সা, গুণ্ডা বাহিনী, কর্তৃত্ব ও ভোটকেন্দ্র দখল করার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশী; যারা জনগণের সাথে আকাশের চাঁদ হাতে তুলে দেওয়ার মত মিথ্যা ওয়াদা করতে পারে। প্রার্থীকে রাশি রাশি টাকা ব্যয় করতে হয় যার কোন সীমা পরিসীমা নাই। বস্তুতঃ যে প্রার্থী বস্তা ভরে টাকা ঢালতে পারে না তার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ পদ্ধতিতে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য বা অন্য কোন বিজয়ী ব্যক্তির প্রধান লক্ষ্য থাকে ব্যয়িত অর্থ উদ্ধার করা আর পরবর্তী নির্বাচনের অর্থ যোগান দেওয়া।
এই পদ্ধতিতে নির্বাচিত ব্যক্তি কখনো সর্বমোট ভোট দাতাদের প্রতিনিধি হতে পারে না। অনেকে এক-চতুর্থাংশ ভোটেও নির্বাচিত হয়। এই কমসংখ্যক ভোটে নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি সংসদে গিয়ে জাতীয় জীবনের গতিপথের নির্ধারক হয়ে যায়। ফলে তারা জাতীয় জীবনের কোন সমস্যাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করে না বা করতে পারে না। কারণ তাদের তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হয় না। তাদের একদেশদর্শী চিন্তা, একগুঁয়েমী মনোভাব, অপরিণত,অনবহিত ও অদূরদর্শী জ্ঞানের ভিত্তিতে যে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাই পরবর্তীতে আইন হিসাবে পাস হয়। জাতীয় সমস্যাগুলো আরো জটিল হয়ে ওঠে। যেখানে এমন একটি ঘুণেধরা নির্বাচনি পন্থা আর ভিত্তিহীন মতবাদের সাথে কোন আদর্শবাদী সংগঠনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না সেখানে কিভাবে একটি আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের সাথে কিভাবে এদের সম্পর্ক থাকে? নচিকতার সেই কালজয়ী গানটি পাঠক সমাজকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। “বসতি আবার উঠবে গড়ে/আকাশ আলোয় উঠবে ভরে/জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে/পৃথিবী আবার শান্ত হবে।”
সর্বশেষ বলতে চাই,
ভুলে যাও সব ভণ্ডনীতি মানব রচিত মত
ঐশি আলোয় খুঁজতে হবে আলোকিত সেই পথ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ