বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শহীদ জিয়ার অর্থনৈতিক মুক্তির সনদের মনোরম নিদর্শন ‘সার্ক ফোয়ারা’

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : সার্ক বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির একটি নাম, একটি ইতিহাস। আর সার্ককে স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানীতে যে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয় তার নাম ‘সার্ক ফোয়ারা’। (SAARC- South Asian Association for Regional Cooperation)। শহীদ জিয়ার চিন্তায় অর্থনৈতিক মুক্তির সনদের নাম সার্ক। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠিত হয়। উন্নয়ন আঞ্চলিক কৌশলের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত। এটি মূলত একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতার আঞ্চলিক সংগঠন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে পূর্ণতা প্রদানই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এই দর্শনকে সামনে রেখেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৫ সালের ৭-৮ ডিসেম্বর ঢাকা সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদন এবং যাত্রা শুরু হয়। আর সেই স্মৃতি ধরে রাখতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে সার্ক ফোয়ারাটি ১৯৮৫ সালে প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ স্টিলের তৈরি এ ফোয়ারাটির নির্মাতা শিল্পী নিতুন কুন্ডু। দৃষ্টিনন্দন এ ফোয়ারাটি নজর কাড়ে সবার।
দৃষ্টিনন্দন সার্ক ফোয়ারা: সার্ক ফোয়ারার দিকে তাকালেই মনে পড়ে অতীত ইতিহাস। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অর্থ ছাড়া অভুক্ত জাতির খাবার জুটবে না। কিভাবে, কোথা থেকে আসবে সেই অর্থ। জাতি কিভাবে স্বাবলম্বী হবে। দেশের মানুষ কাজ চায়। কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে চায়। কর্মসংস্থানের অভাব দূর করে কাজের পথ বের করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেই চ্যালেঞ্জ থেকেই সার্ক প্রতিষ্ঠার চিন্তা মাথায় আসে শহীদ জিয়ার। গড়ে তোলেন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। সেই স্মৃতি বহন করে আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে সার্ক ফোয়ারা। সার্ক ফোয়ারা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কারওয়ান বাজারে অবস্থিত একটি ফোয়ারা। এটি প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অবস্থিত। পানি ছাড়া যেমন ফসল উৎপাদন হয় না। চৈত্রের খরতাপে যখন সবকিছু পুড়িয়ে দিতে চায় সেই সময়ের এক পশলা বৃষ্টি যেমন জমিনকে সতেজ করে দেয়। গাছ-পালা পুনর্জীবন পাওয়ার মতো শাখা পল্লবে ভরে ওঠে। আবার পানি ছাড়া প্রাণির তৃষ্ণা নিবারণ হয় না। তাইতো পানির অপর নাম জীবন। সেই জীবন দানকারী পানির কথা মাথায় রেখেই সার্ক ফোয়ারা নির্মাণের চিন্তা। ইট-পাথরের শহরে সর্বত্র যেন অসহনীয় গরম। সেই গরমে শান্তির পরশ দিতে পারে পানি। নগর জীবনের ব্যস্ততায় মানুষের ঠাসাঠাসিতে যাত্রীবাহী গাড়ীগুলো যখন সার্ক ফোয়ারার কাছে এসে দাঁড়ায় তখন ফোয়ার পানি ভেদ করে আসা বাতাস যে যাত্রীদের গায়ে একটু শান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। যাত্রীরা এখানে আসলেই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সার্ক ফোয়ারার দিকে। ফোয়ারা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস মনে করতে করতে কখন যে তা পিছনে ফেলে এসেছে তা ভুলে যায়। রাতের সার্ক ফোয়ার দৃশ্য আরো মনোরম। রাতে ফোয়ারার আকর্ষণে মুগ্ধ হতেই হবে যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী ও সৌন্দর্যপিপাসুদের। রাজধানীর আলোর ঝলকানি যেন ফোয়ারার পানির সাথে আঁছড়ে পড়ছে। দেখে মনে হবে যেন ফোয়ারার প্রতি ফোটা পানি এক একটি মুক্তার দানা। এ দৃশ্য আপনার নজর কাড়বেই। আপনাকে ভাবনার জগতে ঠেলে দিবে। আর কবি নজরুলে সেই গানের কথায় মনে করিয়ে দেবে- এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরুনু পল্লী-জননী। ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি।      
সার্ক ও সার্ক ফোয়ারার নির্মাণ ইতিহাস: যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠিত হয়। এটি মূলত একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতার আঞ্চলিক সংগঠন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে পূর্ণতা প্রদানই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এই দর্শনকে সামনে রেখেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৮০ সালের মে মাসে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এ মর্মে বাংলাদেশের একটি আনুষ্ঠিানিক প্রস্তাব পেশ করেন। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে অর্থনীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কারিগরি, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহজ ও স্বাভাবিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন ও সম্ভাবনা দৃঢ় হোক। দক্ষিণ এশীয় সাতটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানরা এ প্রস্তাবে প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সাড়া দেন। ১৯৮১ সালের ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল কলম্বোতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রথম পররাষ্ট্র সচিব সম্মেলনে কাক্সিক্ষত সংগঠন গঠনের ব্যাপারে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। এরপরই ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে এ অঞ্চলের সাতটি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা দিল্লীতে তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে মন্ত্রীবর্গ একীভূত বা একটি সমন্বিত কর্মসূচী বা Integrated Programme of Action (IPA) নামে একটি কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এ কর্মসূচীর আওতায় সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য নয়টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। অতঃপর ১৯৮৫ সালের ৭-৮ ডিসেম্বর ঢাকা সম্মেলনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদিত হয় এবং তার যাত্রা শুরু হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া সার্ক ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সার্কে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তির ফলে বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ৮টি। এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে : বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান। চীন ও জাপানের মতো উন্নত রাষ্ট্র সার্কের পর্যবেক্ষক। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান ও মরিশাসকে সার্কের পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়।
সার্ক সনদ: ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই অনুমোদিত হয় সার্ক সনদ। এ সনদের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে- ১. দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণ সাধন এবং তাদের উৎকর্ষ বৃদ্ধি। ২. এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি  এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ দ্রুততর করা। ৩. দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যৌথভাবে আত্মনির্ভরশীলতার প্রসার ও শক্তিবর্ধনে সাহায্য করা। ৪. পরস্পরের সমস্যা অনুধাবন, পারস্পরিক বিশ্বাস ও বুঝাপড়ায় সাহায্য করা। ৫. অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সাহায্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি। ৬. অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি। ৭. সমস্বার্থ বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের  মোকাবিলায় নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার প্রসার। ৮. অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা। সেই উদ্যোগকে স্মরণীয় করে রাখতেই ১৯৮৫ সালে প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ স্টিলের তৈরি এ ফোয়ারাটির নির্মাতা ছিলেন শিল্পী নিতুন কুন্ডু।
নতুন রূপে সার্ক ফোয়ারা: সার্কের এই বাস্তবসম্মত উন্নয়ন সহযোগিতা স্মরণীয় করে রাখতে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংস্থা বা সার্কের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ১৯৮৫ সালে একটি ফোয়ারা নির্মাণ করা হয়। শিল্পি নিতুন কুণ্ডুর নকশায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নির্মিত হয় দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারাটি। নির্মাণের তিন দশকেরও বেশি সময় পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন রাজধানীর কারওয়ানবাজার মোড়ের সার্ক ফোয়ারার সংস্কারকাজ করা হাতে নেয়া হয়। পাঁচ তারকা সোনারগাঁও প্যান প্যাসিফিক হোটেল সংলগ্ন এ ফোয়ারাটি একসময় পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অযত্ন ও অবহেলায় এটি শুধু নামেই সার্ক ফোয়ারা হয়েছিল। নগরবাসী শেষ কবে সার্ক ফোয়ারাটি চালু দেখেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারতেন না।
ডিএনসিসি সূত্র জানায় ৩৩ বছর আগে নির্মিত সার্ক ফোয়ারাটির সংস্কারকাজ গত বছর করা হয়। ফোয়ারাটির চৌহদ্দিতে চওড়া সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। ভেতরে গোলাকার ফুলের বিছানা তৈরি করা হয়েছে। বছরের ৩৬৫ দিনই মৌসুমি ফুল ফুটে এখানে। লাইটিংসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর ফোয়ারাটি প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় চালু করা ব্যবস্থা করা হয়েছে। সূত্র জানায়, গত বছরের ১২ জুন ভোরে একটি দ্রুতগামী ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফোয়ারার বেদি ভেঙে ফেলে। এরপর ডিএনসিসি সার্ক ফোয়ারাটির সংস্কারকাজের পরিকল্পনা শুরু করে। নির্মাণ শেষে রাজধানীবাসী নবরুপে সজ্জিত এই ফোয়ারাটি দেখতে পাচ্ছেন। আকর্ষণীয়, সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন এই ফোয়ারাটি পথচারী শুরু করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ