শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

‘ব’-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০

এ এম ইমদাদুল ইসলাম : নদী বিধৌত বাংলাদেশ মূলত একটি পলি ভরা ব-দ্বীপ। পদ্মা, মেঘনা আর যমুনা নদীর মিলনস্থলে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম গতিশীল এ ব-দ্বীপ। এদেশে রয়েছে ছোটো-বড়ো প্রায় ৭০০ নদ-নদী। যার মধ্যে ৫৭টি আন্তঃদেশীয় নদী (৫৪টি ভারতের সাথে, ৩টি মায়ানমারের সাথে)। প্রতিবছর প্রবাহিত এসব নদীতে পলির পরিমাণ হয় প্রায় ১.০-১.৪ বিলিয়ন টন। ফলে, বর্ষা মৌসুমে দেখা দেয় পানির আধিক্য আর শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বল্পতা। এছাড়াও বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা এবং ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালের ভয়াবহ বন্যা, এ দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ৬টি জেলায় ২০১৭ সালে আগাম বন্যায় হাওরের ফসল নষ্ট হলে চরম দুর্দশায় পড়ে হাওরের মানুষ।
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির একটি। ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল এ দেশে বিগত এক দশকে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অর্জন করেছে নিম্ন আয়ের দেশ হতে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি। বিস্তৃত হয়েছে উন্নয়ন সম্ভাবনা। কিন্তু এসব অর্জন টেকসই হবে কী না তা নিয়ে সচেতন মহলের প্রশ্ন রয়েছে। এর অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব। এ প্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্তৃত দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত, কারিগরি ও আর্থসামাজিক দলিল ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনার রূপকল্প, অভীষ্ট এবং কৌশলসমূহ বাস্তবে রূপায়নের জন্য এ মহাপরিকল্পনার একটি সমন্বিত ও সুসংহত ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত প্রকল্পসমূহ বাংলাদেশের পানি বিষয়ক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত মোকাবিলা, টেকসই পরিবেশ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে।
এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতি সুপ্রাচীনকাল থেকে পানির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দেশের ইতিহাসে এ মহাপরিকল্পনায়েই সর্বপ্রথম সবচেয়ে বড়ো সম্পদ পানিসম্পদ খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বন্যা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, খরা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত ব্যবস্থাপনা, জনস্বাস্থ্য, পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনাকে পানি বিষয়ক নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বনায়ন, পরিবেশ দূষণরোধ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। শুধু প্রাকৃতিক বিষয়ই নয় এ মহাপরিকল্পনায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সমন্বিত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিরাপত্তায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নেও জোর দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্ঞানের বিকাশ। আর তাই এ মহাপরিকল্পনায় তথ্য, জ্ঞান ব্যবস্থাপনা, তথ্য হালনাগাদকরণ এসব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে দেশের আটটি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে একই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির সম্মুখীন জেলাসমূহকে একেকটি গ্রুপের আওতায় আনা হয়েছে যাকে ‘হটস্পট’ (পানি ও জলবায়ু উদ্ভূত প্রায় অভিন্ন সমস্যাবহুল অঞ্চল) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এসব স্পটগুলো হলো উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী অঞ্চল ও মোহনা এবং নগরাঞ্চল।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, নদী ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং দেশের অভ্যন্তরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, পলি জমা ইত্যাদি মোকাবিলা এখন বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করবে। মূলত তিনধাপে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে ২০৩০ সালের মধ্যে চরমদারিদ্র্য দূরীকরণ। প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং গবেষণা বিষয়ক প্রকল্প। দ্বিতীয় ধাপে ২০৫০ এবং তৃতীয় ধাপে ২১০০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত রাখতে হবে। দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী পরিচিত। গত দুই দশকে দেশে প্রায় সাড়ে তের কোটি মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে ভূমির ব্যাপক ক্ষয় হচ্ছে। প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার পরিবার নদী ভাঙনের কারণে গৃহহীন হচ্ছে। বিশেষ করে বাসস্থান, সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, বর্জ্য ও আবর্জনা ব্যবস্থা, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অন্যান্য সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। এ সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ৯ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভের পর বাংলাদেশ এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃঢ় প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করেছে। সীমিত সম্পদ এবং সীমাবদ্ধ সরকারি খাতের সাথে অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে দৃঢ় সংকল্প ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে সুখী সমৃদ্ধিশালী এক উন্নত বাংলাদেশ। -পিআইডি প্রবন্ধ

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ