বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পথের শেষ প্রান্ত

রহমান মাজিদ : আজ রবিবার। মাসের পাঁচ তারিখ। মাত্র ১ ঘন্টা হল মূল গেটের দরজা খুলে দিয়ে ফটকের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে নিরাপওা প্রহরী। কাঁধে তার অত্যাধুনিক চকচকে শর্টগান। তাতে চার রাউন্ড গুলি লোড করা। সকালে ব্যাংকের ভোল্ট খুলেই শক্তিশালী আয়রন সেফে চেইন আপ করা বিধ্বংসী এই অস্ত্রটি তালা মুক্ত করে দায়িত্ব পালন শুরু করে দারোয়ান হালিম। তার আগে চেম্বারে বুলেট ঢুকিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা সেরে নেয় সে। অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার সময়  ট্রিগার চাপলেই যাতে টাঁ টাঁ শব্দে তাজা কার্তুজগুলো বেড়িয়ে এসে লক্ষভেদ হয় তার পূর্ব মহড়া হিসেবে শর্টগানটির নলের মাথায় ঘোড়ার উপরে দৃষ্টি স্থির রেখে নির্দিষ্ট লক্ষের দিকে তাক করে এম ঠিক করে নেয়। সঠিক দায়িত্ব পালনের এটি প্রাথমিক প্রস্তুতি। সাধারণত মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রচন্ড গ্রাহক সমাগম ঘটে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে। এর মধ্যে আবার বিশেষভাবে দেশের শীর্ষ একটি শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকে ভিড়ের পরিমাণটা সীমাহীন। দেশের যত মানুষ তাদের দৈনিন্দন কার্যাবলী সমাপ্ত করার জন্য ব্যাংকের সাথে সম্পৃক্ত তার শতকরা আশি ভাগের মতো সম্পৃক্ততা এই ব্যাংকের সাথে। ব্যাংকটির কর্মককর্তা কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রম আর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারাই এই সাফল্যের অন্যতম কারণ বলে অনেক বিদগ্ধ গ্রাহকগণ বাজারে মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। সপ্তাহের রবিবার এবং বৃহস্পতিবার এই দুই দিন ভিড়টা সবচেয়ে বেশি হয়। কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকে সন্ধ্যা  ছয়টা পর্যন্ত চলে বিরামহীন জ্যামযুক্ত গ্রাহক সেবা। এরপর বাকি কাজ শেষ করতে রাত আটটা অবধি বেজে যায়। এমনই একটি ভিড়ের দিনে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন থাকায় মাথা নিচু করে ক্যাশিয়ারের ডেবিট করা চেক অথোরাইজ করছে ক্যাশ ইনচার্জ। মানুষের শরীরের গরমে এসির ঠান্ডা বাতাসও যেন ভাঁপাপিঠার ধোয়ার মত গরম হয়ে বের হচ্ছে। মাথার উপরে ফিটিং করা ফ্যানের বাতাসে পাতলা চুলগুলো তার ছনের মতো উড়ছে। ছয়জন ক্যাশিয়ারের রিসিভ করা ভাউচার এবং পেমেন্ট  দেবার চেক একজন পাসিং অফিসারকে অথোরাইজ করতে হয়। যা তার একারপক্ষে অস¤ভব হয়ে দাঁড়ালেও নতুন জনশক্তি রিক্রুইট না করার কারণে বাড়তি চাপ সামলাতে হয় প্রত্যহ। তাই অন্য শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও পাসিং অফিসারকে সহযোগিতা করেন ইনচার্জ। আজও তেমনি গদিআটা ইজি চেয়ারে বসে সামনের কম্পিউটারে সংরক্ষিত গ্রাহকের সাইন কার্ড বের করে চেকের সাথে মিলাচ্ছেন ইনচার্জ। নিবিষ্ট মনে ঘাড় নিচু করে মনিটরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ইঁদুরের মতো কুট কুট করে কেটে যাচ্ছে একটির পর একটি কমান্ড। যেন স্বচ্ছ পুকুরের স্ফটিক পানির বাঁধা সরিয়ে লেজ নেড়ে সাঁতার কাটছে জাপানি রুই। এরই মধ্যে একটি এম.আই.সি.আর চেক হাতে অথোরাইজের জন্য ইনচার্জের পিছনে এসে দাঁড়ালো নূরী। মেয়েটি এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে, তার এবং ইনচার্জের মাঝখানে চেয়ারের পিছনে দন্ডায়মান কাল ফোমের হাতল ছাড়া আর কোন বেড়া ছিল না। তার দ্রুত নি:শ্বাস পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ইনচার্জ। সেই সাথে ইমামি হেলদি নারিকেলের তেলের সাথে আধুনিক প্রসাধন সামগ্রীর মিশ্রণে এক অদ্ভুত নাক জ্বলানো গন্ধ এসে মস্তিস্কে প্রচন্ড ঝাকুনি দিল ইনচার্জের। নূরী আজই  জয়েন করেছে এই শাখায় । হালকা পাতলা গড়নের বেশ লম্বা মতো মেয়েটি। মুখের উপর ছড়িয়ে আছে লাবণ্যের দীপ্তি । জড়ির কাজ করা কালো বোরখায় আবৃত তার পুরো শরীর। তবে অন্য মেয়েদের মতো নেকাব দিয়ে মুখ বাধা নয়। সাদা হিজাবে আবৃত পুরো মাথায় শুধু তার মুখমন্ডল অনাবৃত। এতে অবশ্য তার সৌন্দর্য অনেকখানি বেড়ে গিয়ে খসে পড়েছে সহকর্মীদের কাছে। ইনচার্জের সাথে তার এখনও পরিচয় ঘটে নাই। ম্যানেজার অপারেশন সাথে করে নিয়ে ছয় নাম্বার কাউন্টারে বসিয়ে গেছে। হাতের চেকটি অথোরাইজ করে পিছনে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে নূরীর কাছ থেকে চেকটি টেনে নিল ইনচার্জ। নূরীর হাতের সাথে সামান্য ছোঁয়া লাগতেই বরফের মতো ঠান্ডা একটা শীতলতা রক্তের বেগে প্রবাহিত হল তার  সমস্ত শিরায় উপশিরায়। কাঁপা কাঁপা শরীর তার উপলব্ধি করল নারীর শরীর সাপের মতই ঠান্ডা। আদিষ্ট চেকটি বাহক চেক হওয়ায় গ্রাহকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে চেকের সমুদয় অর্থ বাহককে প্রদানের কনফারমেশন নিয়ে পাশ করে হাতে দিলেন নূরীর। চেকটি হাতে নিয়ে কাউন্টারে ফিরে যেতে উদ্যত নূরী মুখে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করল অস্পষ্ট অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে “আবিদ ভাই আপনার সাথে আমার কথা আছে”। ঘাড় বাঁকা করে নূরীর দিকে তাকালো আবিদ। সাদা ভালুকের চামড়ার মতো উলের পশমে তৈরি হিজাবে আবৃত মুখমন্ডল থেকে একটা হালকা হাসির আস্তরণ তীরের ফলার মতো এসে বিধলো আবিদের বুকে। যেন লালের মাঝে সাদা গোলাপের কুঁড়িগুলো পাপড়ি মেলে ফুটে উঠলো স্বমহিমায়। পুরো শরীর জুড়ে একটা কম্পমান শিহরণ তরুণ নদীর ঢেউয়ের মত দোলা দিয়ে গেল তার রক্ত নালীর প্রতিটি নার্ভে। “আপনার সাথে আমার কথা আছে আবিদ ভাই’’ এই শব্দটি বার বার কাঁসার ঘন্টা ধ্বনির মতো তরঙ্গায়িত হয়ে কানে বাজতে লাগল তার। নূরীর সাথে তো আমার ইতি পূর্বে কখনো দেখা হয় নাই। একসাথে একই শাখায় কাজ করার অভিজ্ঞতাও নাই। তাহলে সে আমাকে চিনল কি করে?। নাকি অন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনে মুখস্থ করেছে আমার নামটি। এই চরম ভিড়ের মাঝেও ক্ষণিকের জন্য ভাবনার দরিয়ায় চিৎসাঁতার কাটতে শুরু করলো আবিদ। হাঙর মাছের মতো খুঁজতে লাগলো “আপনার সাথে আমার কথা আছে আবিদ ভাই” বাক্যটির উৎস। একটি মাত্র বাক্য তাকে ডলফিনের মতো ভাবনার সাগরে লাফালাফি করতে প্ররোচিত করছে। শ্রুত বাক্যটির কোন কূল কিনার না পেয়ে আবার কাজে মন দিল সে। ব্যাংকিং কার্যক্রমটা এতই সেনসেটিভ বিষয় যে, এখানে সামান্য অমনোযোগী হলেই ঘটে যেতে পারে মহা বিপর্যয়। একটা ভুল পেমেন্ট বা ওভার পেমেন্ট হলেই নির্ঘাত নিজের গাঁটির থেকে তা পূরণ করে অফিস ত্যাগ করতে হয়। দুই একবার যে এমন ঘটে নাই এমন নয়। এর আগেও দশ বিশ হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে। পাঁচশত বা হাজার টাকা যে কতবার কাল চামড়ার মানিব্যাগ থেকে বের করতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। সুতরাং এখন কাজে মনোযোগ দেয়াই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় আবিদের। কিন্তু পূবের প্রতি দিল দরিয়া আত্মা চাইলেই কী আর পশ্চিমের দিকে রুজু করা যায়? আবার কানে বেজে ওঠে সেই সুর। আধার ঘরে সাপ ঢুকলে যেমন পুরো ঘরই সাপের আকার ধারণ করে তেমনি আবিদের মনের অন্ধকার কুঠুরিতে “আপনার সাথে আমার কথা আছে আবিদ ভাই” শব্দের সাপটি লেজ নেড়ে খেলা করতে থাকে। স্মৃতির বিলে ডুব দিয়ে সুজি ড্যাপ আর শ্যাওলার ভিতরে দারকে, পুঁটি, খলসে ধরার মতো হাতড়াতে থাকে। কিন্তুু না! নিকট অতীতের দেয়ালে ঝোলানো ক্যানভাসে কোন নূরীর মুখ খুঁজে পায় না সে। একবার ভাবে হয়তো সকালে ম্যানেজার স্যার নূরীকে বলেছে আমার কথা। ম্যানেজার স্যারের কয়েকটি বিশেষ গুনের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়েছে ইদানিং আবিদ। বিশেষ করে স্যারের প্যারেন্টিং এর উপর মাঝে মঝে বিস্তর আলোচনা বেশ উপভোগ করে আবিদ। অতিশয় ভদ্র ও মার্জিত রুচির অধিকারী এই ব্যবস্থাপক যখন দাঁড়িয়ে কথা বলেন তখন তার বাচনভঙ্গি এবং বাধাহীন কথার জোয়ারে প্রায়ই ভেসে যায় সে কর্তব্যের নিষ্ঠাপুরে। অফিস কক্ষের ফাঁকা জায়গাগুলোতে বাইরের প্রকৃতি তুলে এনে বনসাই করা ঝাউগাছের পাতা আর দিপদল গাছের ডালপালা কেঁপে কেঁপে ওঠে স্যারের সেই বক্তব্যের সাবলীলতায়।

একবিংশ শতাব্দীর শূন্য দশক থেকে যখন তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সহজলভ্যতায় সন্তানদের বখে যাওয়ার সকল উপকরণ আঙ্গুলের ডগায়। মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের সস্তাবাজারে যখন শহর ও গ্রামের অলি গলি সয়লাব, তখন ম্যানেজার স্যারের সময়োপযোগী এই সাবজেক্ট ডিসকাশন এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করে আবিদ। তার উপর স্যারের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব এবং আকর্ষণীয় চেহারার কারণে অন্য আর সব সমপদের সহকর্মীদের থেকে তাকে আলাদা করা যায় খুব সহজেই। কালারফুল ড্রেস আর ম্যাচিং করা টাইয়ের উপর গলায় ঝুলে থাকা সোনালী চেইন সংযুক্ত চশমায় তাকে প্রথম সাক্ষাতেই বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান বলে ঠাওর করতে কষ্ট হয় না কারোরই। গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকরা যখন তাদের প্রয়োজনে চৌকোনা কাঁচ ঘেরা সুসজ্জিত চেম্বারে প্রবেশ করে তখন সময় সুযোগ বুঝে সন্তান লালন পালনের উপর একটা নাতিদীর্ঘ পরামর্শ উপস্থাপনকালে বুদ্ধিদীপ্ত এক প্রবল ব্যক্তিত্বের চিহ্ন ফুটে ওঠে তার চেহারায়। বাচ্চাদের প্রতি এটি তার অকৃত্রিম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মৃদু গুঞ্জরণ ছড়িয়ে আছে সহকর্মীদের মাঝে। আবিদের চিন্তার বৃক্ষ আরো বিস্তৃত হতে থাকে। পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে দিগন্তরেখায় ডালাপালা মেলতে শুরুু করে। এমনিতেই বয়সের উদ্দামতায় নারী কেশে ব্যবহৃত কুমারিকা তৈলের চাপা গন্ধ উপেক্ষা করার মতো বার্ধক্য স্পর্শ করে নাই আবিদের যুবক মনকে, তারপরে কোন সুসজ্জিত নারীর চিকন কন্ঠে নাকি সুরে “আপনার সাথে আমার কথা আছে আবিদ ভাই” শব্দটি পিয়ানোর টুংটাং আওয়াজের মতো বেজে চলে তার হৃদয়ের তবলায়। বাতাসের প্রচন্ডতায় আছড়ে পড়া ঢেউয়ের তীব্রতা নদী পাড়ের বসতিগুলো যে ভাবে  ভেঙ্গে চলে তেমনি আবিদের হার্টের ধুকধুকানিতে দুর্বল হয়ে ভাঙ্গতে থাকে তার সকল শক্তিমান সত্তা। ঢেউয়ের উৎসস্থল খুঁজতে গিয়ে আবিদের মনে পড়ে বেটার কাষ্টমার সার্ভিস সংক্রান্ত একটি ট্রেনিং এর কথা। যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুই বছর আগে ব্যাংকের ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে কয়েকজন নারী ট্রেইনির সাথে পরিচয় হয়েছিল তার। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সকল সূচকে এই ব্যাংক প্রথম সারির প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেও শ্রমিকদের বেতন ভাতা প্রদানে তলানিতে অবস্থান করায় ফ্রিজে রক্ষিত মাংসের গায়ে জমে থাকা বরফের মতো শ্রমিক কর্মচারীদের মনের মধ্যে চাপা অসন্তোষের তুষারখন্ড জমাট বেঁধেছে। একজন ট্রেইনারের এরুপ আলোচনায় ডান দিকের মেয়েটি বাম হাতের কনুই দিয়ে আবিদের পাজরে হালকা গুঁতো মেরে বলেছিল ‘‘আবিদ ভাই স্যার কিন্তুু কথাটি সত্যই বলেছেন। সেই মুখটি একবার মনের ¯্র‹িনে ভাসানোর বৃথা চেষ্টা করল আবিদ। কিন্তুু ওই মুখের সাথে বর্তমান মুখটির স্কিন ম্যাচ না হওয়ায় চিন্তা নদীর ডুবসাঁতার থেকে ডাঙ্গায় উঠে এল সে। নূরী ও মাঝে মাঝে ঘাড় বাঁকা করে আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করছে আবিদকে। কখনও কখনও চোখাচোখিও হয়ে যাচ্ছে। শরম মিশ্রিত চোরাই চাহনিতে মুচকি হাসি বিনিময় করে দুই জনই লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যার যার কাজে মন দেয়। পশ্চিম দেয়ালে ঝোলানো ইলেক্ট্রিক পেন্ডুলামে ৫ টার ঘন্টা বেজে উঠলে আবিদ দেখলো ব্যাংকে আর কোন গ্রাহক নাই। এখনই তাকে দিনের কার্যক্রম সমাপ্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসমূহের দিকে নজর দিতে হবে। এক ঘন্টার ভিতরে সকল কাউন্টার থেকে ক্যাশ বুঝে নিয়ে জি.এল মেলানোর দ্বারপ্রান্তে। সবাই উৎসুক হয়ে আবিদের মুখের দিকে চেয়ে আছে ‘‘ক্যাশ মিলে গেছে’’ এই ঘোষণাটির অপেক্ষায়। সারে ছয়টার দিকে আবিদ ঘোষণাটি প্রকাশ করলে সবাই যার যার মতো বেরিয়ে গেলেও নূরী বসে আছে আবিদের জন্য। ক্যাশ ভোল্টে টাকা তুলে আবিদ ব্যাংকের নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই নূরী এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো আবিদের। শপিংমলের ঝাঝালো আলোয় ঝকমক করে উঠলো নূরীর চুমকি লাগানো বোরখার হাতা। পিছন থেকে হঠাৎ ধমক দিলে শরীর যেমন চমকে ওঠে তেমনি আবিদের ভেতরটা নারী শরীরের ছোঁয়ালাগা মাত্রই কেঁপে উঠলো। ঝটকা বাতাসের মৃদু শিহরণে দুলতে লাগল তার মন। মেহেদির রঙে আলপনা আঁকানো নূরীর নরম কোমল হাত আবিদের বাম হাতটি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল পাশের কফি হাউজে। বাইরের চক্ষুলজ্জায় মুখ কাচুমাচু করলেও আবিদের সমস্ত সত্তা জুড়ে খুশির প্রজাপতি নাচতে লাগলো।  নিজেকে সে আজ একজন প্রেমিক পুরুষ ভাবতে চেষ্টা করছে। কোন দিন তাকে কোন নারী এভাবে সমাদর করে নাই। ভাগ্য বিধাতাকে পাইলে তার পা ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছা করছে আবিদের। সামনাসামনি বসে সাদা কাপে গরম কফি চুমুক দিতে দিতে নূরী বলল, আপনি সত্যিই আমাকে চিনতে পারেন নাই আবিদ ভাই? লজ্জা লুকানোর জন্য ঠোঁটের কোনায় কৃত্রিম হাসির রেখা ফুটিয়ে আবিদ জবাব দিল, সারাদিন ব্যাংকের ডেবিট ক্রেডিট মিলাতে গিয়ে স্মৃতির অনেক মেগাবাইট খরচ হয়ে গেছে। এখন টু জি গতির মস্তিষ্ককে চেনা মুখগুলোর ছবি সহজে আপলোড হতে চায় না। ধোয়া-ওড়া কফির কাপে ফু দিয়ে নি:শব্দে লম্বা একটা টান দিয়ে নূরী বলল, আমি ফরিদা। মসজিদের উঁচু মিনার থেকে ভেসে আসা মাগরিবের আজানের ধ্বনির সাথে মিশে কেঁপে উঠলো নূরীর গলা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত বাংলায় দন্ডায়মান পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল আবিদের চোখ। যেন বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে আছে নূরীর দিকে। ধ্যানি ঠাকুরের ধ্যান ভঙ্গের পাপে না জড়ানোর ইচ্ছায় নীরবে উঠে কফির বিল পরিশোধ করে গট গট করে বেরিয়ে গেলে আবিদ শুধু তাকিয়ে রইল তার চলে যাওয়া পথের দিকে।  ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার মতো সন্ধ্যা রাতের অন্ধকার ঢেকে দিল সেই পথের শেষ প্রান্ত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ