হুইল চেয়ারে এখন বিশ্বরাজনীতি
‘হুইল চেয়ারে একা মুহিত’ শিরোনামে একটি সচিত্র সংবাদ মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ১৯ জানুয়ারিতে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, কয়েকদিন আগেও তাঁকে ঘিরে নেতা-কর্মীদের জটলা লেগেই থাকতো। ঢাকা থেকে সিলেট ফিরলে ভিড় লেগে থাকতো ওসমানী বিমানবন্দরে। ভিআইপি লাউঞ্জে পড়ে যেত হুড়োহুড়ি-ধাক্কাধাক্কি। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠত বিমানবন্দর এলাকা। মোটর শোভাযাত্রা সহকারে তাকে নিয়ে আসা হতো বাসায়। সেই আবুল মাল আবদুল মুহিত (সাবেক অর্থমন্ত্রী) শুক্রবার যখন সিলেট ফিরলেন তখন তার হুইল চেয়ার ধরার মত ছিল না কেউ। সাবেক এপিএস জনিকে নিয়ে একা একাই ওসমানী বিমানবন্দর ত্যাগ করলেন তিনি। মন্ত্রী শব্দের সঙ্গে ‘সাবেক’ শব্দ যুক্ত হওয়ার পর দূরে সরে গেছে সুবিধাভোগী চক্রও। গেল মন্ত্রিসভার প্রতাপশালী অর্থমন্ত্রী মুহিতকে ঘিরে সব সময়ই আনাগোনা থাকতো সুবিধাভোগী চক্রের। এদের অনেকেই গেল ১০ বছরে দলীয় পরিচয়ের ছদ্মাবরণে অর্থমন্ত্রীকে ব্যবহার করে ‘কামাই’ করেছেন কোটি কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন অফিসে প্রভাব বিস্তার, তদবির ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং ঠিকাদারিসহ অনেকভাবেই এই চক্রটি আখের গুছিয়েছে নিজেদের। কিন্তু মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়তে না পড়তেই সেই সুবিধাভোগীরাও ভুলে গেছে মুহিতকে। মুহিতকে দিয়ে আর ‘ফায়দা হাসিল’ হবে না, এমনটা বুঝেই তারা কেটে পড়েছেন ইতিমধ্যে।
চিরচেনা পরিচিত মুখগুলো দেখতে না পেয়ে অনেকটা হতাশই মনে হচ্ছিল মুহিতকে এতদিন যাদের ‘কাছের মানুষ’ হিসেবে জানতেন তাদের মুখোশের অন্তরালের চেহারাটা হয়তো তখন ভাসছিল তার মনোচোখে। পরে সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত বিমানবন্দর থেকে চলে আসেন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। সেখানে বসে দেখেন সিলেট সিক্সার্স ও ঢাকা ডায়নামাইটসের ম্যাচ।
মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী সিলেটে এসেছেন ক্রিকেট খেলা দেখতে। রাজনীতির খেলা তো তিনি অনেক দিন দেখেছেন। তবে ক্ষমতায় থাকলে এই খেলার রূপ এক রকম হয়, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে হয় অন্যরকম। জনাব মুহিত দীর্ঘদিন সরকারের প্রতাপশালী মন্ত্রী ছিলেন। তখন সিলেটে আসলে বিমানবন্দরে হৈচৈ পড়ে যেত। সম্মান ও ভালবাসা উপচে পড়তো। অথচ ক্ষমতা হারিয়ে যখন হুইল চেয়ারে বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন তখন তাঁর খোঁজখবর নিতে কেউ এলেন না। আসলে এখনই পরিচিত মুখগুলোর ভালবাসা বেশি প্রয়োজন ছিল তাঁর। কি নির্মম পরিহাস! আমাদের রাজনীতির এ কেমন রূপ? রাজনীতির লোকজন এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক হয় কেমন করে!
রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন, বিজয়ী হলে দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হলো দেশ পরিচালনার কাজটি তারা সঙ্গতভাবে করছেন কী? তাদের শাসনে ন্যায়, নীতি, মানবিকতা কতটা রক্ষিত হচ্ছে? বরং ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার লক্ষটিই তাদের কাছে এখন প্রধান হয়ে উঠেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে অন্যায়, অবিচার, প্রহসনসহ যে কোন নিষ্ঠুর পদক্ষেপ গ্রহণে তারা কুণ্ঠিত নন। তাই জনমনে এমন প্রশ্ন, এ কেমন রাজনীতি?
ভারতের রাজনীতিতে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল এখন এক মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ বিল যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। নাগরিকত্ব সংশোধন বিল অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন মেঘালয় ও মিজোরামের দুই মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা ও জোরামথাঙ্গা। ১০ জানুয়ারি বিকালে এই দুই মুখ্যমন্ত্রী অন্য মন্ত্রীদের নিয়ে দেখা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে। তারা তাকে বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। দেশের স্বার্থে এই বিল অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। তারা অপেক্ষমাণ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এই বিল গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামাজিক মেলবন্ধন নষ্ট করে দেবে। সৃষ্টি করবে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে তীব্র সমস্যা। এই বিল দেশকে দুর্বল করে তুলবে। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, এই বিল রাজ্যের আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের তীব্রভাবে আহত করেছে।
উল্লেখ্য যে, নাগরিকত্ব বিলকে কেন্দ্র করে আসামসহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতির দিক দিয়ে যেসব আঞ্চলিক দল বিজেপির কাছাকাছি এসেছিল এই বিলকে কেন্দ্র করে তারা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। মনিপুরে অশান্তি চলছে। এই বিলের বিরোধিতা করছে ত্রিপুরার শাসক বিজেপির শরিক আইপিএফটি। এই অবস্থায় বিজেপি কী করবে? দলের একটি অংশের ধারণা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, এই বিল তা নষ্ট করে দিতে পারে। আসামে অসম গণপরিষদ (অগপ) মন্ত্রীরা ইস্তফা দিয়েছেন, যদিও তা এখনও গৃহীত হয়নি। ভাবতে অবাক লাগে, রাজনীতিবিদরা যেখানে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করবেন, সুখ-শান্তি নিশ্চিত করবেন; সেখানে তারা এখন সংকীর্ণ স্বার্থে মানুষের নাগরিকত্ব হরণে তৎপর হয়েছেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পর এমন মন্দ উদাহরণ কারও কাম্য হতে পারে না।
মজলুম ফিলিস্তিনীদের পর বর্তমান সভ্যতায় নির্মম রাজনীতির শিকার হয়েছেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা। বর্তমান সভ্যতা কিংবা বিশ্বরাজনীতি তাদের রক্ষায় কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে রোহিঙ্গাদের দুঃখের রজনী প্রলম্বিত হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বড় দেশ ভারতের ভূমিকাও প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে সচেতন মানুষের মনে। এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের উপেক্ষার অভিযোগ করেছেন ভারতের এই গুণীজন।
অমর্ত্য সেন বলেন, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের আটক করে মিয়ানমারে প্রত্যর্পণের ভারতীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। ধর্মীয় সূত্রে নাগরিকত্ব দেয়া না দেয়ার আইন পাস করাটা ভারতের সংবিধানের মূল নীতির ব্যত্যয়। প্রতিবেশী হিসেবে রোহিঙ্গাদেরও ভারতের সহানুভূতি পাওয়ার অধিকার আছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। এমন বাস্তবতায় রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
উল্লেখ্য যে, ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ২০১৬তে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ভারতের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত এই নতুন আইনে কোন সুসংবাদ নেই আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য। ভারত বরং তাদের চিহ্নিত করে মিয়ানমারে প্রত্যর্পণের আদেশ দিয়েছে।
ভারত সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছেন অমর্ত্য সেন। তার ভাষ্য, ‘এটা অদ্ভুত যে প্রতিবেশী দেশগুলোর অমুসলিমদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ করে দিলেও মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য কোন জায়গা দিতে পারছে না ভারত। অথচ ভারতের শাসকপক্ষ ভাল করেই জানে যে, মিয়ানমারে তাদের কি ধরনের অসহিষ্ণুতা ও নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে।’ আসলে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর ওই ধরনের সিদ্ধান্তে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির সংকেত পাওয়া গেলেও মানবিক চেতনার কোন আভাস নেই।