শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অব্যাহত ধর্ষণ-ঘটনার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হয়ে উঠছে

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : ধর্ষণ মামলার আসামী, অথবা ধর্ষণকান্ডে অভিযুক্ত-এমন ব্যক্তিদের লাশ পড়ছে এখানে সেখানে। অব্যাহত ধর্ষণ-ঘটনার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হয়ে উঠছে। গত এক মাসে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠেছে, এমন চারজনের লাশ পাওয়া গেছে দেশের একাধিক স্থানে। তাদের মধ্যে একজন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারীবাহিনী। বাকীদের বিষয়ে কিছুই জানায়নি তারা। যে চারজনের লাশ পাওয়া গেছে তাদের সবাই ছিল গুলীবিদ্ধ অবস্থায়।
সর্বশেষ গত শুক্রবার (পহেলা ফেব্রুয়ারি) রাকিব মোল্লা (২০) নামে এক যুবকের লাশ পাওয়া গেছে ঝালকাঠির রাজাপুরের এক পরিত্যক্ত ইটভাটার পাশে। পুলিশ বলছে, লাশটি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী (১৩) ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী রাকিব মোল্লার (২০)। লাশের গলায় সুতা দিয়ে ঝোলানো সাদা কাগজে লেখা একটি চিরকুট পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। চিরকুটে লেখা রয়েছে, ‘আমি পিরোজপুর ভান্ডারিয়ার...(অমুকের) ধর্ষক রাকিব। ধর্ষকের পরিণতি ইহাই। ধর্ষকেরা সাবধান- ‘হারকিউলিস।’
ধর্ষণে অভিযুক্ত রাকিব হত্যার দায় চাপানো হয়েছে গ্রীক দেবতা ‘হারকিউলিস’-এর ওপর! সম্ভাব্য ধর্ষকদেরও এমন পরিণতির হুশিঁয়ারি দেওয়া হয়েছে এই দেবতার নামে।
অথচ, গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর আলোচিত চরিত্র ‘হারকিউলিস’ শৌর্যবীর্যে ভরা এক মহাবীর। অকল্পনীয় শক্তি ,অচিন্তনীয় সাহস , পেশিবহুল শরীরের হারকিউলিস রিপু বধকারী এক ইতিবাচক চরিত্র। সে কারণে গ্রীকদের কাছে হারকিউলিস অতি সম্মানীয়। কিন্তু বাংলাদেশে গুপ্তহত্যায় জড়ানো হলো এই গ্রীক দেবতার নাম।
পরিবার বলছে, রাকিব মোল্লা সাত দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। রাকিব মোল্লার বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ভিটাবাড়িয়া গ্রামে। তিনি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
এর আগে ২৬ জানুয়ারি শনিবার  দুপুরে মামলার আরেক আসামী সজল জমাদ্দারের (৩০) চিরকুট লেখা গুলীবিদ্ধ লাশ ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার বলতলা গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। চিরকুটে লেখা ছিল ‘আমার নাম সজল। আমি .....(অমুকের) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’ এ ঘটনায় সজলের বাবা বাদী হয়ে কাঁঠালিয়া থানায় দুদিন পর গত সোমবার রাতে অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে রাকিব, তাঁর বাবা, ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবা, ফুপা, ফুপু ও মাদ্রাসার এক শিক্ষককে সন্দেহভাজন হত্যাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুজন একই মামলার আসামী।
গত কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে নতুন এই খবর আসছে। ধর্ষণে অভিযুক্ত আসামীদের মৃত্যুর খবর। রাজধানীর অদূরে সাভার থেকে শুরু করে ঝালকাঠির পিরোজপুর। ধর্ষণের অভিযোগে এখন পর্যন্ত নিহত চারজন, হত্যা করা হয়েছে একই কায়দায়। এতদিন প্রশ্ন ছিল, নতুন এই কায়দায় হত্যাকান্ডগুলো ঘটাচ্ছে কে বা কারা? প্রথম দুই হত্যাকান্ডে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।
সাভারে নিহত রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণ মামলার মূলহোতা।’ অপরদিকে ঝালকাঠিতে নিহত সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার রহিমার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’
প্রথম দুই হত্যাকান্ডে হত্যাকারীর পরিচয় পাওয়া না গেলেও চতুর্থ হত্যাকান্ডে ধর্ষকদের সাবধান করে এ বিষয়ে ক্লু দেয়া হয়েছে। ঝালকাঠিতে পাওয়া  লাশের বুকে লেখা ছিল, ‘আমি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার রহিমার (ছদ্মনাম) ধর্ষক রাকিব। ধর্ষণের পরিণতি ইহাই। ধর্ষকরা সাবধান। হারকিউলিস।’
চিরকুটে পাওয়া ক্লু’তে দেখা যায় হত্যাকারীর নাম হারকিউলিস। আসলে এটা হত্যাকারীর নাম নয়, বরং ক্লু। কারণ, গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী হারকিউলিস ছিলেন গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। আর ধর্ষণে অভিযুক্তদের হত্যাকারী আসলে এই হারকিউলিসের কর্মকান্ড থেকে অনুপ্রাণিত।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন: কাউকে হত্যা করা সবচেয়ে বড় অপরাধ, যারা এ ধরনের অপরাধ করছে তাদের খুঁজে বের করে প্রচলিত আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন: কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুই কাম্য নয়, এই দুটি মৃত্যু স্বাভাবিক নয় অপমৃত্যুও বলা যেতে পারে, এগুলো কাম্য নয়। এসব হত্যাকান্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেও বিষয়টিকে সমাজের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তিনি বলেছেন: সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর ধর্ষণের ঘটনা অসম্ভবভাবে বেড়ে গেছে। কর্মস্থল থেকে শুরু করে বাসে রাস্তায় বাসায় কোথাও কোনো বয়সের নারী নিরাপদ না, দুই থেকে শুরু নয় বছরের বাচ্চা পর্যন্ত আমাদের সমাজের ধর্ষিত হয়। যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সেটা তালিকাভুক্ত হয় না। যে পরিমাণ ধর্ষণের আসামী থাকে তাদের দশ ভাগের বিচার হয় আর নব্বই ভাগের বিচার হয় না।
এমন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেছেন: এ ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন যা প্রকৃত সত্য তুলে আনবে। আমাদের সংবিধান ও মানবাধিকারের মূলনীতি অনুযায়ী যে কোনো মানুষই আইনানুগ উপায়ে বিচার লাভের অধিকার রাখে। এ ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড সমাজে ভুল বার্তা প্রদান করে। ‘আশা করছি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে খতিয়ে দেখবে এবং অপরাধের আইনানুগ শাস্তি প্রদান করবে।’
হারকিউলিস সম্পর্কে গ্রীক পুরাণে কী আছে?
গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী হারকিউলিস ছিলেন গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। তিনি যেমন সাহসী, শারীরিক শক্তি সম্পন্ন ছিলেন, তেমনি ছিলেন দয়ালু। কথিত আছে, হারকিউলিস শিশু অবস্থায় খালি হাতে বিষধর সাপ মেরে ফেলেছিলেন গলা টিপে। প্রকৃতপক্ষে হারকিউলিস হলেন গ্রিক বীর ‘ হেরাক্লেস’ এর রোমান পুরাণের নাম। গ্রীকরা তার কর্মকান্ডের জন্য তাকে দেবতা এবং মর্ত্যের বীর- এই দুই পরিচয়েই পূজা করতো।
শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ও হারকিউলিসকে নিয়ে গল্প লিখেছেন।
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী হারকিউলিসের জন্ম থিবিসে। তিনি দেবরাজ জিউসের পুত্র। তার মা আক্লমিনা একজন মানুষ। জিউসের সন্তান হওয়ায় হারকিউলিসের জীবনের শেষ পর্যন্ত হেরা তাকে কখনোই ক্ষমা করেননি। হারকিউলিস যখন শিশু তখনই হেরা তাকে হত্যা করার জন্য দুটি সাপ পাঠান। ঘুমন্ত শিশু হারকিউলিস ঘুম থেকে জেগে উঠলেন এবং শিশু হওয়া সত্ত্বেও ওই ভয়ঙ্কর প্রাণী দুটির গলা ধরে মেরে ফেললেন। হারকিউলিস সম্পর্কে তখন থিবিসের অন্ধ ভবিষ্যদ্বক্তা টাইরেসিয়াস আক্লমিনাকে বলেছিলেন, এই শিশু হবে মানবজাতির গর্ব।
হারকিউলিসের বিভিন্ন অভিযান নিয়ে রয়েছে গল্পের পর গল্প। তিনি নানা স্থানে গিয়েছিলেন আর স্থাপন করেছিলেন অনেক কীর্তি। ভয়ঙ্কর দানব অ্যান্টিউসের বিরুদ্ধে, নদী-দেবতা অ্যাকিলাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি ট্রয়ের যুদ্ধে এক কুমারীকে উদ্ধার করেও তিনি মহিমান্বিত হন। অ্যাডমিটাসের মৃত স্ত্রী অ্যালসেস্টিসকে মৃত্যু- দেবতার হাত থেকে লড়াই করে ফিরিয়ে আনেন হারকিউলিস।
ধর্ষণ প্রতিরোধ হবে কি?
ধর্ষণ মামলার আসামীর গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। আর লাশের সঙ্গে চিরকুটে ধর্ষকের স্বীকারোক্তি বা সম্ভাব্য ধর্ষকদের পরিণতি সম্পর্কে সাবধানবাণী লেখা থাকছে। চিরকুটে ধর্ষকের হত্যার দায় চাপানো হচ্ছে গ্রিক দেবতা হারকিউলিসের ওপর। ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ, সাধারণ মানুষ ধর্ষকের লাশ উদ্ধারে একধরনের স্বস্তি প্রকাশ করলেও নারী, মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষকের অভিযোগ আছে এমন ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গুলী করে মেরে ফেলা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
গত শুক্রবার ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার আন্ডারিয়া গ্রামে পরিত্যক্ত ইটভাটার পাশে রাকিব মোল্লার (২০) গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলা থেকে সজল জমাদ্দার (৩০) নামের এক যুবকের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি ... (অমুকের) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’
এ ছাড়া গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকার আশুলিয়ায় এক কিশোরী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামী রিপনের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি রিপন, গত ৫ জানুয়ারি আশুলিয়ার...নামে মেয়েকে ধর্ষণ করেছি।’ রিপনের পরিবারের দাবি, একদল লোক গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে রিপনকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
চলতি বছরে এ পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগ আছে এ ধরনের চারজনের গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। শুধু একজনের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘ক্রসফায়ার’ বলে স্বীকার করেছে। তবে চিরকুটসহ লাশের বেলায় এখন পর্যন্ত কোনো স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়নি বা কেউ দায় স্বীকার করেনি। উল্টো নিহত সজল জমাদ্দারের বাবা কাঠালিয়া থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন। তাতে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবাসহ অন্যদের হত্যাকান্ডের সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। অন্যদিকে, নিহত রাকিবের বাবার সন্দেহ, তাঁর ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গুলী করে মেরে ফেলেছেন। ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর রাকিব ঢাকা চলে আসেন এবং পরে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের পর তাঁর মা আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে পুলিশ জিডি নেয়নি বলেও অভিযোগ করেছে পরিবারটি।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে ১৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১১টি মামলা হয়েছে। ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরে (২০০২-১৬) আসা ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধান করে দেখা যায়, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, গত বছর মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৯৪২টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হন ১৮২ জন নারী ও শিশু। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৬৩ জনকে। বছরটিতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ১৪৬ জন। মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে গত বছরের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ