শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রাজনীতির নামে অপরাজনীতি

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার : ছোট বেলা বাবা-চাচাদের কাছে শুনতাম-“রাজার যে নীতি তাই রাজনীতি। রাজনীতি দেশ ও দশের তরে! রাজনীতি কেবলমাত্র দেশের সিংহভাগ মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য।” কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতির অর্থে পরিবর্তন এসেছে! এখন রাজনীতির অর্থ নেকামী, ধান্ধাবাজি, শঠতা, ধোঁকাবাজি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের দেশে বর্তমানে রাজনীতি হলো আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার অন্যতম হাতিয়ার। রাজনীতি হলো ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যম! এমন রাজনীতিকে সাধারণ মানুষ মন থেকে ঘৃণা করে! এহেন অপরাজনীতির কবল থেকে দেশবাসী মুক্তি চায়।

একসময় রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ছিল, ছিল ভালবাসা! আর এখন রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও মানুষ পছন্দ করে না। যে রাজনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে, ন্যায়বিচার ব্যবস্থা ও সুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়; সত্যকে সত্য বলতে পারে না, নেতার অন্ধ আনুগত্য করতে গিয়ে নীতিকে বিসর্জন দেয়, অকপটে মিথ্যার বেসাতির জাল বিস্তার করে স্বার্থসিদ্ধি করতে কূটজাল বিস্তার করে, এসব জনবিধ্বংসী ছলচাতুরীকে রাজনৈতিক নেকামী বা অপরাজনীতি বৈ কি বলা চলে? সেই অপরাজনীতির খপ্পরে এখন সিংহভাগ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক দল এবং সমগ্রদেশবাসী। তাই দেশ ও দশের তরে রাজনীতির প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সর্বত্র প্রতিহিংসা ও জিঘাংসার রাজনীতির তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় কার কি ক্ষতি হচ্ছে তাতে কার কী আসে যায়! এমন রাজনীতির কবলে পড়ে নিঃশ্ব হচ্ছে নাম না জানা কত মানুষ! আমজনতা জজমিয়া আর জাহালম নাটক আরো কত দিন নীরবে নিবৃত্তে সহ্য করে যেতে হবে তা কে বা জানে! যে রাজনীতিতে রাজনৈতিক সহকর্মীকে খুন করতে হাত কাঁপে না! অপরাজনীতির দৌরাত্ম্য এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পক্ষ-প্রতিপক্ষ সে যেই হোক না  কেন যে কোন মূল্যে নিজের মতের বিপক্ষ শক্তিকে কুপকাত করতে পারাটাই যেন রাজনৈতির মুখ্য বিষয়। যেখানে আদর্শ নীতি নৈতিকতার কোন বালাই নেই। প্রতিনিয়ত এমন পরিস্থিতি দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এক নায়কতন্ত্র ধরনের শাসন ব্যবস্থার কোপানলে দেশ। আওয়ামী শাসনে পিষ্ট হয়ে মানুষ তাদের সঠিক চিন্তা ও মতামত ব্যক্ত করতে পারছে না বল্লেই চলে। মামলা-হামলা থেকে জান বাঁচানোই যেখানে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এহেন পরিস্থিতির ফলে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার পরিবর্তে বল প্রয়োগের রাজনীতি সৃষ্টি হচ্ছে, প্রকৃত রাজনৈতিক অদর্শ কর্মীর সৃষ্টি না হয়ে সুবিধাবাদী কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে, যা রাজনৈতিক দলসমূহকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে। এতে করে সময়ের পরিক্রমায় একটি পক্ষ একদলীয় শাসক গোষ্ঠীর জুলুমবাজীর শিকার হয়ে সুস্থ রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়বে। যা সুস্থ রাজনীতির চর্চা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে দুর্বল করে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিবে। শেষতক যার পরিণিত হবে ভয়াবহ!

বর্তমানে ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই যেন দেশে রাজনৈতিক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আগে শুনতাম মানুষ যাকে ভোট দেয়, নিজের চাওয়ার চাইতে জনগণের চাওয়াতে জননেতা বা জনপ্রতিনিধি হয়। আগে সর্বত্র একটা আওয়াজ ছিল, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। টুকটাক ভোট দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন হত। আর এখন ঘটছে ঠিক তার উল্টোটা। এখন আওয়াজ শুনা যায়- আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব, সকাল সন্ধ্যা রাতেও দেব! একেবারে ভোট ডাকাতি। এতে কারো বুঝতে বাকী থাকে না যে, এসব  ক্ষমতান্ধরা জনগণের চাওয়া নয় বরং নিজেই নেতা হিসেবে তাদের ঘাড়ে চেপে বসছে। জোর করে ভোটাধিকার হরণ করে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, খুনাখুনি করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেতা হওটাই যেন এদের বিশেষ ক্রেডিট! মানুষ এধরনের রাজনৈতিক নেকামী মন থেকে ঘৃণা করে। তবে সাধারণ মানুষের ঘৃণা করা না করাতে ক্ষমান্ধদের কিছু যায় আসে না। এদেরকে রাজনৈতিক কীট বৈ কী বা বলা চলে! এদের জন্য ধিক!

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় সমাসীনের পর থেকে দেশকে বিরোধী দল শূন্য করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে! সেই মিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের সাথে তারা কী না আচরণ করেছে? খালেদা জিয়াকে বছরের পর বছর কারাগারে আবদ্ধ করে, তারেক জিয়াকে সাজা দিয়ে বিএনপিকে খন্ড-বিখন্ড করতে কী  তারা বাকী রেখেছে ? অপর দিকে জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করতে টেস্ট কেইস হিসাবে শীর্ষ নেতাদের হত্যা ও নানা মামলায় সাজা কার্যকর অব্যাহত রেখেছে। পুলিশি হয়রানির কারণে বিরোধী দলীয় কার্যালয়গুলো অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে আছে। সভা-সমাবেশ নেই বল্লেই চলে। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে আর কার্যত কোন বিরোধী দল আছে বলে মনে হয় না। এহেন পরিস্থিতিতে চারদিকে আয়ামী লীগের জয় জয়াকার অবস্থা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন- সরকার বিরোধী প্ল্যাটফর্ম সক্রীয় হয়ে না উঠলে আওয়ামী লীগ অচিরেই নিজেদের পতন নিজেরাই ডেকে আনবে। তাই তাদের উচিত প্রতিহিংসা আর জেল জুলুমের পথ পরিহার করে রাজনৈতিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা। যাতে সবাই তাদের মত-পথ চর্চা করতে পারে।

বিরোধী দল বিহীন সংসদ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে কার্যকর বিরোধী দলের কোন বিকল্প নেই। এমন শাসন ব্যবস্থায় একদলীয় শাসন ও একদলীয় রাজনীতিকে বাহ্যত শক্তিশালী করলেও ফ্যাসিবাদকে সাংঘাতিকভাবে উস্কে দিয়ে গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে। কালের ব্যবধানে দেশে বিরোধীদল ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অকার্যকর হয়ে যায়। দেশে ২০১৪ সালের মত এবারের বিরোধীদলও নামকা ওয়াস্তে এরশাদের জাতীয় পার্টি! একেবারে গৃহপালিত বিরোধী দল! যদিওবা ক’দিন আগে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতা জি.এম কাদের বলেছেন, তারা এবার গৃহপালিত বিরোধী দল নয় বরং কার্যকর বিরোধী দল হিসাবে ভূমিকা পালন করবেন! বক্তব্য বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ সরকার বা জাতীয় পার্টি যাই কলুক না কেন, তাদের অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার নিরিখে দেশবাসী এখন আর এমন বক্তব্য বিশ্বাস করে না।

দেশের সামগ্রিক উন্নতি অবনতির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে মিডিয়ার কোন বিকল্প নেই। যার মাধ্যমে দেশবাসী সচেতন হয়। যে কোন ভাল ও মন্দের ব্যাপারে তাদের মত ব্যক্ত করতে পারে। এতে দেশে কোন অন্যায়-অবিচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পাওে না। তবে সরকার যখন মিডিয়াকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে “মিডিয়া ক্যু” করে তখন মিডিয়ার মালিক/ পরিচালক/কর্মীরা দেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পারেন না। তারা দেশের আসল সত্য প্রচার করতে পারে না। যেমন পারেনি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচনের অনিয়মের কথা! কারণ আসল সত্য প্রচার করলে লাইসেন্স থাকবে না! যেমন অতীতে বেশ ক’টি মিডিয়া তাদের লাইসেন্স হারিয়েছে। মিডিয়াগুলো নীতি-নৈতিকতা বা আইনের কাছে ধরা বাঁধা নয়, বরং আওয়ামী সরকারের কাছে ধরা বাঁধা! তাইতো কিছু মিডিয়া সরকারের ফরমায়েশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সত্যকে মিথ্যা বানাতে আর মিথ্যাকে সত্য বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে! এতে সচেতন বিবেকবানরা পত্রিকা-টিভির খবরকে গুরুত্ব দেয় না, কোন মিডিয়াকে দেশের প্রতিচ্ছবিও মনে করে না।

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে সর্বত্র এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে। একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়ে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী মুক্তির প্রহর গুনছে। তারা সকল বাধাবিপত্তি মাড়িয়ে বাধাহীন মুক্ত জীবন চায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ