বেশির ভাগ ডাক্তারের পদ শূন্য
দিলওয়ার খান : নেত্রকোনা স্বাস্থ্য বিভাগ চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। তিনভাগের একভাগের কম ডাক্তার দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। কর্মস্থলে ডাক্তারের পোস্টিং কাগজেপত্রে থাকলেও বাস্তবে নেই। নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালসহ জেলার দশটি হাসপাতালে অর্ধেকেরও বেশি ডাক্তারের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ২৫৬ জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে পোস্টিং আছে ১০০ জন। তার মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৭৭জন। ১০০ শয্যার নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল চলছে ৫০ শয্যা হাসপাতালের জনবল দিয়ে। এতে করে জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চলছে দায়সারাভাবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবলের অভাব, পর্যাপ্ত ওষুধ, চিকিৎসা উপকরণের অভাব, অবকাঠামোগত সমস্যায় ব্যাহত হচ্ছে জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে গড় হাজির থেকে টাকার বিনিময়ে বাইরে চিকিৎসা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে রোগিরা বাইরে ক্লিনিকে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নেত্রকোনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল ছাড়া অন্য ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসক ও সেবিকার পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে ২২ জন ডাক্তারের বিপরীতে পোস্টিং আছে ২০ জনের। এর মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন ও জুনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু প্রেসনে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে আছেন। জেলার পূর্বধলায় ৩১টি পদের বিপরীতে পেস্টিং আছে ৯জন ডাক্তার। সহকারী সার্জন ডা. আসিফ আমেদদ ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এবং মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মাহফুজুল্লাহ কবীর ২০১৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত আছেন। বারহাট্টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের অনুমদিত পদ ১৭টির মধ্যে পোস্টিং দেখানো হচ্ছে ৯ জন এর মধ্যে ৬ জন কর্মরত আছেন। দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের অনুমদিত ১৭ জনের বিপরীতে পোস্টিং দেখানো হচ্ছে ৭ জনকে। এর মধ্যে ডা. হোসাইন মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ডা. রকিবুল হাসান নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে প্রেসনে আছেন। কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্রে চিকিৎসকের ২৯ টি পদের মধ্যে ১২ জনের পোস্টিং দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে তিনজন অনুপস্থিত রয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। মোহনগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত দেখানো হচ্ছে ১৩ জন। এর মধ্যে অর্থপেডিক সার্জন ডা. আবদুল হালিম ঢাকা মেডিকেল কলেজে ও ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. রেবেকা সুলতানা ৫০ শয্যার হাসপাতাল কুর্মিটোলায় প্রেসনে আছেন। খালিয়াজুরীতে ১৪ জন চিকিৎসকের জায়গায় পোস্টিং দেখানো হচ্ছে ৫ জন। বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র তিনজন। ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনী, সার্জারি, মেডিসিন, এনেসথেসিয়া, ডেন্টাল সাজনের পদ থাকলেও কোন চিকিৎসক নেই দীর্ঘদিন ধরে। জেলার আটপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭ জন ডাক্তারের স্থলে ৬ জনের পোস্টিং দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে মেডিকেল অফিসার ডা. সানজিদা আফ্রিন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, ডা. ফাহাদ আল মামুন ঢাকার সহরোয়াদী মেডিকেল কলেজে প্রেসনে ও সহকারী সার্জন ডা. সৈয়দ ওয়াসিউল্লাহ বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত আছেন। এর মধ্যে দুইজনকে ৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। আটপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শরীফ আহমেদ কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্রে চিকিৎসকের অনুমদিত পদ ৩৫ টির মধ্যে কর্মরত দেখানো হচ্ছে ৮ জনকে।
মেডিকেল অফিসার ডা. জোবায়ের আহমেদ বিনা অনুমতি অনুপস্থিত আছেন। জেলার মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯ জন ডাক্তারের বিপরীতে ৮ জনের পোষ্টিং দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে ডা. মোহাম্মদ ফজলুল বারী, ডা. ফেরদৌসী নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ডা. মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে প্রেসনে আছেন। উডজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. মো. ফখরুল হাসান চৌধুরী বেশির ভাগ সময় অফিসের কাজে হাসপাতালের বাইরে থাকেন। চারজনকে পালাপক্রমে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়।
নেত্রকোনার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাগজেপত্রে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১০০ জন। এ অধিকাংশ হাসপাতালগুলোতে নেই কোন মেডিসিন, গাইনি, ডেন্টাল, নাক-কান ও গলা, চক্ষু, অর্থোপেডিক্র, সর্জিারি, কার্ডিওলজিষ্ট ও শিশু বিশেষজ্ঞ। এতে করে শিশু বৃদ্ধ ও গর্ভবতীরা যথাযথ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গাড়ো পাহাড় ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কাছে সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন ধরে এক্স-রে, ইসিজি মেশিন ও জেনারেটর নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। সার্জারি ও অবেদনবিদ চিকিৎসক না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে সিজারিয়ান কাজ করা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। যেখানে আগে সিজার হতো প্রতিদিন প্রায় ৮-১০টি। এ উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা, তাহেরপুর, মধ্যনগর হতে এখানে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী অন্ত:বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও বহি:বিভাগ হতে চিকিৎসা সেবা নিতে আসে। রোগিদের অভিযোগ চিকিৎসক, নার্স, জনবল ও নিরাপত্তার অভাব, পর্যাপ্ত ঔষধপত্র না পাওয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণের অভাব, নিম্নমানের খাবার, পয়:নিস্কাশন, পানীয়জল ও পরিচ্ছন্নতার অভাবে এখানে রোগির সংখ্যা কমতে শুরু করছে। গর্ভবতী মা, জরুরি রোগি ও নিম্ন আয়ের রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আধুনিক সদর হাসপাতাল ও শহরের ক্লিনিকগুলোতে রোগীর চাপ দিনদিন বাড়ছে।
নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গড় হাজির থেকে টাকার বিনিময়ে বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সফিকুর রহমান, সিনিয়র কার্ডিওলজিষ্ট ডা. আবদুল মোতালেব, গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. জান্নাত আফরোজ নুপুর, নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জুবায়দুল হক, অর্থোপেডিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ। এ ব্যাপারে গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. জান্নাত আফরোজ নুপুর অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন নিয়মিত আমার দায়িত্ব পালন করছি। হাড় বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, নিয়মিত অফিস করে যাচ্ছি। কর্মস্থলে গড় হাজির থাকার অভিযোগ সঠিক নয়। হাসপাতালে আসা রোগিদের ভালোভাবে চিকিৎসা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।