বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

চকবাজার ট্র্যাজেডির পেছনে ‘ওয়াহেদ ম্যানশনের কেমিক্যাল গোডাউন’

*  বাড়িটি আইন মেনে নির্মাণ করা হয়নি : রাজউক
*  আহত ১১ জনকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকা হস্তান্তর
*  ডিএনএ নমুনা দিতে হাসপাতালে স্বজনেরা
*  ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ছেয়ে গেছে শোকের ব্যানার আর পোস্টারে
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ‘ওয়াহেদ ম্যানশনের কেমিক্যাল গোডাউন’ই মূলত দায়ী বলে একাধিক সূত্র ও তথ্য প্রমাণে বেরিয়ে এসেছে। ওই ভবনের নীচতলায় ছিল কেমিক্যালে ঠাসা। ওই ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকরা প্রভাবশালীও বটে। যার কারণে তাদেরকে কেউ ঘাটাতো না।
এদিকে, ঘটনার ৫ দিন পরও চকবাজার ট্র্যাজেডির সূত্রপাত যাদের কারণে হয়েছে সেই ভবন মালিকদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। জানা গেছে, তারা সটকে পড়েছেন। এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকদ্বয় কোথায়?
চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার না গোডাউনে থাকা কেমিক্যাল থেকে এ নিয়ে বিতর্ক ছিল শুরু থেকে। তবে এই বিতর্কের মধ্যে দু’টি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশের পর আগুনের সূত্রপাত নিয়ে সন্দেহের তীর যাচ্ছে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা বডি স্প্রে, পারফিউম ও কেমিক্যাল গোডাউনের দিকেই।
ফুটেজ দু’টি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই আগুনের পাশাপাশি বডি স্প্রের ক্যান ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তায় থাকা পিকআপ ভ্যানের সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে স্থানীয়রা জানালেও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে বডি স্প্রের ক্যানসহ জিনিসপত্র নিচের দিকে পড়ছে। সেই সঙ্গে একের পর এক বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৭ জন সরকারি হিসেবে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচটি ভবন। এই পাঁচটি ভবনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ওয়াহেদ ম্যানশনের। আর এই ওয়াহেদ ম্যানশনের প্রতিটি ফ্লোরে বিস্ফোরণ হওয়ার মতো প্রচুর পরিমাণে কেমিক্যাল মজুদ ছিল বলে জানিয়েছে বাড়িটির বাসিন্দারা। নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউন; দোতলায় পারফিউম-বডি স্প্রের গোডাউন, রিফিল করার কাঁচামাল; তৃতীয় তলায় চার ইউনিটের মধ্যে একটিতে পারফিউম-বডি স্প্রের গোডাউন; চতুর্থ তলায় কসমেটিক ও পারফিউম-বডি স্প্রের গোডাউন ছিল।
রাজমহল হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা একটি ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ১০টা ৩২ মিনিটে প্রথমে একটি ছোট বিস্ফোরণ ও তার এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের ব্যবধানে আরও একটি বড় বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে জিনিসপত্র ভেঙে নিচে পড়ে যায়। এই নিচে পড়া জিনিসপত্রের মধ্যে বডি স্প্রের ক্যান ও কার্টন নিচে পড়তে দেখা গেছে। একই সঙ্গে ভারি জিনিসপত্রও উপর থেকে নিচে পড়তে দেখা যায়।
ঘটনাস্থলের পাশে থাকা মসজিদ সংলগ্ন একটি ভবনের সিসিটিভিতে ধারণ করা অপর একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেই ফুটেজেও বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে বডি স্প্রের ক্যান উড়ে এসে মসজিদের গলিতে পড়তে দেখা যায়।
অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়াহেদ ম্যানশনের ফ্লোরগুলো ঘুরে দেখা গেছে, পারফিউ ও বডি স্প্রের বিশাল মজুদ ছিল তাতে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা কোনও একটি ক্যানে অতিরিক্ত গ্যাসের প্রেসারের কারণে বিস্ফোরিত হতে পারে পুরো গোডাউন।
ওয়াহেদ ম্যানশনের গোডাউনগুলোতে কেমিক্যালের উপস্থিতি ছিল বলে এরই মধ্যে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান। তিনি বলেন, ‘ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এছাড়া আরও অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমের মতো কাজ করেছে।’
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ বলেন, ‘কোথা থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বা আগুনের সূত্রপাত কীভাবে, তা তদন্ত প্রতিবেদনের আগে বলা যাচ্ছে না। আমরা ভিডিওগুলো পেয়েছি, প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘটনাস্থলে কী কী উপাদান পাওয়া গেছে, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আশা করছি মূল ঘটনা উঠে আসবে।’
ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণ হওয়া বা আগুন লাগার মতো অনেক উপাদান এই ভবনে মজুদ ছিল। এখন কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত তা সময় হলে জানা যাবে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
গোডাউনে থাকা অসংখ্য বডি স্প্রে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বিস্ফোরিত হয়ে অনেক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া। তিনি বলেন, ‘বডি স্প্রেতে বিস্ফোরণ হওয়ার মতো অনেক উপাদান থাকে। আর একসঙ্গে অনেকগুলো মজুদ করে রাখলে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা যে কোনোভাবে একটি বিস্ফোরিত হলে বড় আকারের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।’
ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিকের গা ঢাকা
হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিককে খুঁজছে পুলিশ। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকা-ে নিহত এক ব্যক্তির ছেলের করা মামলায় তাঁরা দুজন আসামী। তবে গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বৃহস্পতিবার রাতে চকবাজার থানায় মো. আসিফ বাদী হয়ে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক মো. হাসান, মো. শহীদসহ ১০-১২ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। মো. আসিফের বাবা মো. জুম্মন চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন। আসিফ মামলার এজাহারে বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজ করে মৃত্যু ঘটানো, ঘরবাড়ি ধ্বংসের জন্য আগুন বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার, উপাসনালয়, মানুষের বসতি বা সম্পত্তি রাখা হয়, এমন দালান ধ্বংস ও লোকসানের অভিযোগ এনেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের চারতলা ভবনের বিভিন্ন তলায় ভবনমালিক দাহ্য পদার্থের গুদাম ভাড়া দিয়েছিলেন। আর্থিকভাবে লাভবান হতে তাঁরা আবাসিক এলাকার ভবনে কোনো পরিবারকে ফ্ল্যাট ভাড়া দেন না।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মু. মোরাদুল ইসলাম বলেন, আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁরা ওই ভবনে সব সময় থাকেন না। কালেভদ্রে আসেন। ভূগর্ভস্থ তলাসহ পাঁচটি তলায় পাঁচটি ইউনিট ও প্রতিটি ইউনিটে চারটি করে ঘর ছিল। দুটি ইউনিটে দুটি পরিবার ভাড়া ছিল। আর ভবনটির নিচতলায় দোকানপাঁট ভাড়া দেয়া ছিল। সেখানে অনেকেই মারা গেছেন। তবে ওপর থেকে কোনো লাশ উদ্ধার হয়নি। সে থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ভবনটিতে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা বেঁচে আছেন।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মো. হাসান (৫০) ও মো. সোহেল ওরফে শহীদ (৪০) দুজনেই নিরাপদে আছেন। অগ্নিকাণ্ডে নিহত ওয়াসিউদ্দীন মাহিদের বাবা নাসিরউদ্দীন জানান, তিনি শুনেছেন, ঘটনার দিন মো. হাসান সপরিবার ঢাকার বাইরে ছিলেন। তাঁরা আগে থেকেই চট্টগ্রামে বেড়াচ্ছিলেন। রাতে আগুন লাগার পর আরেক মালিক মো সোহেল ওরফে শহীদ ও তাঁর মা বেরিয়ে যান। নাসিরউদ্দীন ছেলের খোঁজে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন এবং তিনি নিজেই তাঁদের দেখেছেন।
কোথায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকরা
চকবাজারের ট্র্যাজেডির পর থেকেই আলোচনায় ওয়াহেদ ম্যানশন। কেবল ভবনই নয়, এতে মজুত থাকা দাহ্য পদার্থের গুদামই এখন মূল আলোচনায়। যার কারণে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আশপাশের ভবনগুলোতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬৭ জন। আলোচিত এই ভবনটির মালিক ছিলেন হাজী ওয়াহেদ। এরশাদের আমলে তিনি ছিলেন ওই এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার। প্রায় একযুগ আগে তিনি মারা যান। এরপর উত্তরাধিকার সূত্রে ভবনটির মালিকানা পান তার দুই ছেলে হাসান ও সোহেল। ভবনটির দেখভাল করতেন হাসান। তিনি পরিবার নিয়ে ওই ভবনেই থাকতেন। ওই ঘটনার পর থেকে তাদের দেখা মেলেনি। তারা এখন কোথায় আছেন, তাও বলতে পারছেন না স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন নামের ভবনটি তৈরি করা হয়। ভবনের মূল মালিকের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে হাসান ও সোহেল মালিকানা পান। সোহেল প্রায় সময়ই চট্টগ্রামে থাকেন। আর হাসান তার পরিবার নিয়ে ওই ভবনেই থাকতেন।
ওয়াহেদ ভবন স্থানীয়দের দাবি, ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে কেমিক্যালের যে গুদাম রয়েছে সেটির মালিক সোহেল। ঘটনার দিন দুই ছেলের মধ্যে একজন কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন। অন্যজন বাসার বাইরে ছিলেন। তবে আগুনের ঘটনায় পরিবারের লোকেরা সবাই অক্ষত থাকলেও তারা গা-ঢাকা দিয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ভবনটির কার পার্কিং, নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে। ওপরের তলাগুলো ছিল আবাসিক। সড়কে আগুনের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার গুদামে আগুন পৌঁছে যায়। মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আরও পাঁচটি ভবনে।
প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপরে গড়ে ওঠা ভবনটি নির্মাণে ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’ বা রাজউকের কোনও আইন মানা হয়নি। সরেজমিন দেখা যায়, ভবনের চারপাশে নেই কোনও উন্মুক্ত জায়গা। বিশাল ভবনটিতে ওঠানামার জন্য একটি মাত্র সিঁড়ি রয়েছে। কার পার্কিংয়ের জায়গাটিও ব্যবহার করা হচ্ছে গুদাম হিসেবে। এই ভবনটির বিষয়ে বৈধ কোনও কাগজপত্রও নেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউকের কাছে।
আগুনের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তেও বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। কমিটি মনে করে, বাড়িটি আইন মেনে নির্মাণ করা হয়নি।
ডিএসসিসি’র তদন্ত কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ভবন পরিদর্শনকালে দেখেছি পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলার পুরোটাতেই গুদাম ছিল। অন্যান্য ভবনগুলোতে কম বেশি গুদাম ছিল। এটি একটি বড় ভবন হওয়া সত্বেও আগুন নেভানোর জন্য কোনও ইক্যুইপমেন্ট ছিল না। একটি মাত্র সিঁড়ি রয়েছে, যা পর্যাপ্ত নয়। আগুনের সূত্রপাত যে কারণেই হোক না কেন, কেমিক্যালের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।’
ভবনটির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের অথরাইজড অফিসার নুরুজ্জামান জাহিদ বলেন, ‘ওয়াহেদ ম্যানশনসহ অন্যান্য ভবনগুলো রাজউকের অনুমোদিত কিনা আমরা সে বিষয়ে এখনও কোনও তথ্য নিতে পারি নাই। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাবে আসলে তারা অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছেন কিনা। এই সমস্যাটি পুরান ঢাকার দীর্ঘদিনের সমস্যা।’
ডিএসসিসি’র স্থানীয় কাউন্সিলর মো. আনোয়ার পারভেজ বাদল বলেন, ‘ওয়াহেদ সাহেব ভালো লোক ছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। আসলে বাসাবাড়িতে মালামাল মজুত করে রাখা পুরান ঢাকার বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশন কাজ করছে।’
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও ডিএসসিসি’র প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের অনুমতি নেই। সরকারের নির্দেশনার পর নতুন করে আর লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। বর্তমানে যারা ব্যবসা করছেন, তাদের কারও বৈধ লাইসেন্স নেই। যেকোনও মূল্যে এলাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়া হবে। আর দায়ীদের বিরুদ্ধে কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ছেয়ে গেছে শোকের ব্যানার আর পোস্টারে
অগ্নিকাণ্ডের চারদিন পর গতকাল রোববার ওয়াহেদ ম্যানশন ও আশেপাশের ভবন ছেয়ে গেছে শোকের ব্যানার আর পোস্টারে। বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ, চকবাজার মডেল থানাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন শোক প্রকাশ করে এসব ব্যানার পোস্টার লাগিয়েছে। ‘আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায়’ লেখা কালো রঙ এর ব্যানারে ভরে গেছে পুরো চুড়িহাট্টা।
এছাড়াও ছোট ছোট ব্যানারে লেখা আছে, ‘গ্যাস সিলিন্ডার, সকল কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন অপসারণ চাই’। প্রচারে সাধারণ এলাকাবাসী।
ওয়াহেদ ম্যানশন ও চুড়িহাট্টায় শাহী মসজিদ সংলগ্ন প্রবেশের চার মুখেই উৎসুক জনতার ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশের ব্যারিকেড থাকার পরেও মানুষের ঢল নেমেছে এই পথে। নারী-পুরুষ, ছেলে -বুড়ো সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পোড়া ভবনগুলোর দিকে।
ভবনটি অগ্নিকাণ্ডে ঝুঁকি পূর্ণ হওয়ায় যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা সাধারণ মানুষকে বার বার সরিয়ে দিলেও কোন না কোন ভাবে তারা ভেতরে ঢুকে পড়ছেন।
আরমানিটোলা থেকে রফিকুল নামে একজন এসেছেন আগুন লাগা ভবনটি দেখতে। কেন দেখতে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা পাশের এলাকায় থাকি। একই এলাকায় এমন ঘটনা খুব কষ্ট পেয়েছি তাই দেখতে এসেছি। তবে ঢুকতে পারছি না।
উপস্থিত এক পুলিশ সদস্য বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি, এখানে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয় এমন কিছু যাতে না ঘটে তাই আমরা সাংবাদিক ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছি না।
২৩ ট্রাক কেমিক্যাল সরানো হয়েছে
অন্যদিকে ওয়াহেদ ম্যানশনের গ্রাউন্ডে যে বিশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালের মজুদ পাওয়া গেছে সেগুলো অপসারণের কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
গতকাল রোববার বিকালে সিটি কর্পোরেশনের কর্মী শাহেদ আলী বলেন, গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩টি ট্রাকে ভরে কেমিক্যাল অপসারণের জন্য নেয়া হয়েছে। আরো রয়েছে সেগুলোও সরিয়ে ফেলা হবে। তবে এগুলো সরিয়ে নিয়ে কোথায় রাখা হচ্ছে তা বলতে পারেন নি তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় চকবাজার অগ্নিকাণ্ড
অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহিদ ম্যানশন। ঘটনার সময় ওই ভবনের তৃতীয় তলার বারান্দায় বসেছিলেন ঢাকা সিটি কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম সজিব। তার চোখের সামনেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে আগুন লাগার পর পর নিজের পরিবারের সদস্যদের ও মালিকের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে বের করে নিয়ে আসেন। বাসাটি পুরো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলেও তারা সকলে নিরাপদে বের হতে পেরেছিলেন বলে জানান তিনি।
আগুনের সূত্রপাত
কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয় এবং তার ও মালিকের পরিবারের সদস্যদের, কীভাবে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসেন তা বিস্তারিত জানিয়েছেন রাকিবুল ইসলাম সজিব। তিনি বলেন, ‘যখন ঘটনা ঘটে তখন আমি ওয়াহিদ ম্যানশনের তৃতীয় তলার বারান্দায় ছিলাম। চেয়ার নিয়ে বসে মোবাইল চালাচ্ছিলাম। রাস্তায় তখন জ্যাম ছিল। বাসার নিচে একটি পিকআপ ভ্যান আসে। ওটাতে সিলিন্ডার ছিল। সিলিন্ডারগুলো সম্ভবত পাশের হোটেলে সাপ্লাই দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ হয়। বাইরে তাকিয়ে দেখি, রাস্তা থেকে কিছু একটা উপরে উঠে এসেছে। আর নিচের রাস্তাটা পুরা আগুনের ময়দান হয়ে আছে। আগুন ছাড়া তখন চোখের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। পুরো বাড়ি বিকট আওয়াজে কাঁপছিল। আমার রুমে একটা টিভি ছিল। সেটা আওয়াজই জাস্ট ফেটে গেছে। গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগছে এটা ঠিক আছে কিন্তু খুব দ্রুত আগুন ছড়াইছে কেমিক্যাল থেকে।’
ভবনে কেমিক্যালের গোডাউন
ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউন; দোতলায় পারফিউম এর গোডাউন, রিফিল করার কাচামাল; তৃতীয় তলায় চার ইউনিটের মধ্যে তিনটিতে ফ্যামিলি ও একটিতে পারফিউমের গোডাউন; চতুর্থ তলায় কসমেটিক্স ও পারিফিউমের গোডাউন ছিল বলে জানিয়েছেন তৃতীয় তলার রাকিবুল ইসলাম সজিব। তার ভাষ্য, আমাদের বিল্ডিং এ পারফিউম এর গোডাউন ছিল। দোতালায় পারফিউম, তিনতলায় এক ইউনিটে, আন্ডারগ্রাউন্ডে বড় বড় ড্রাম ছিল কেমিক্যালের, আবার প্লাস্টিকের দানাও ছিল। চতুর্থ তলাতেও পারফিউম আর কসমেটিকসের গোডাউন ছিল। কেমিক্যালের কারণে আগুনটা দ্রুত ছড়ায় গেছে। উল্টা পাশের কর্তারের দোকানটায় কেমিক্যাল ছিল। ক্যামিকেলের কারণে যারা জ্যামে আটকে ছিল তারা সামনে পিছে কোথায় যেতে পারেনি। ওখানে আগুনে পুড়ছে।
যেভাবে নিজের পরিবারের সদস্য ও অন্যদের বাঁচালেন
‘আমি আগুন দেখার সাথে সাথে বুঝতে পারি এটা ভয়াবহ। কেমিক্যাল যে আশপাশে আছে সেটাতো জানতাম। আমি দ্রুত বারান্দা থেকে সরে গিয়ে আম্মুকে বলি যে দ্রুত বের হতে হবে। বাসায় আমার আম্মু, ছোট বোন, চাচা ছিল। আম্মু বলল, বাবা ভুমিকম্প হইছে কি? আমি বললাম না আগুন। আমি বাসার কাউকে সময় দিই না। জুতা পড়ারও সময় পায়নি। সবাইকে নিয়ে আমি যখন বাসার গেটে আসি তখন পুরা বাড়ির বিদ্যুৎ চলে যায়। মোবাইলের লাইট দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তাদের নিয়ে নিচে নামি। সাথে সাথে বাড়ির যত লোক ছিল তারাও নিচে নেমে আসে। নিচ তলায় এসে আগুন দেখার পর সবাই বলছিল যে বাইরে যাওয়া যাবে না। এখানেই থাকি। বাইরের পরিস্থিতি দেখার জন্য আমি আর ড্রাইভার আঙ্কেল দুজন গেটে আসি। গেটে এসে দেখি শুধু বাম পাশটায় আগুন নেই। তারপর আমি এসে সবাইকে বলি যে, এখানে থাকা যাবে না বের হয়ে যেতে হবে। কারণ আমরা এখানে থাকলে ধোঁয়া আর গ্যাসেই মারা যাবো। তখন আমি একে একে সবাইকে বের করে নিয়ে আসি। বাড়িওলার মা ছিল তৃতীয় তলায়।উনাকে আমার চাচা ও ড্রাইভার আঙ্কেল উঠিয়ে নিয়ে আসে। আমিও সাথে সাথে বের হয়ে আসি। এরপর যখন ফিরে আসি তখন সব শেষ। আমাদের পাঁচ রুমের ইউনিট ছিল। আমার রুমের খাঁ ও ওয়াড্রপ বাদে বাসার সব পুড়ে গেছে। তিনি জানান, ঘটনার পর তারা উর্দু রোডে মামার বাসায় উঠেছেন। সেখান থেকে ক্লাস ও বাবা অফিস করছেন। আগুনে তার সব সার্টিফিকেট পুড়ে গেছে।
মধ্যরাতে গোডাউনে আসত কেমিক্যাল
“বিল্ডিংয়ে কেমিক্যালগুলো আসত রাত ১২টার পর। বড় বড় কার্গোতে করে এগুলো নিয়ে আসা হতো। আন্ডারগ্রাউন্ড বস্তায় করে কেমিক্যাল এনে রাখা হতো, অনেকটা সিমেন্টের বস্তার মতো। ড্রামও ছিল। আর তৃতীয় তলায় পারফিউমগুলো আনা হতো কার্টুনে করে। এগুলোর কাঁচামালও ছিল। দুই তলায় পারফিউম ও ‘র’ ম্যাটেরিয়ালগুলো ছিল।”
গত ৮ মাস আগে সজিবরা বাসায় উঠার পর পাঁচমাস তৃতীয় তলার একটি ইউনিট ফাঁকা ছিল। এরপর একটি গোডাউন ভাড়া দেওয়া হয় বলে জানান সজিব। মালিকের ভাষ্য, কেমিক্যাল আর মানুষ একসঙ্গে থাকবে, এটা পুরান ঢাকার বৈশিষ্ট্য। অগ্নিকা-ের কয়েকদিন আগে সজিবের বাবা মালিক হাজী সোহেলকে বলেছিল, হয় পুরো বাড়িতে ফ্যামিলি অথবা গোডাউন দুটো থেকে একটা ভাড়া দেওয়ার জন্য। তখন মালিক হাজী সোহেল সজিবের বাবাকে বলেন, ‘কেমিক্যাল মানুষ সব একসঙ্গে মিলে থাকবে, এটা পুরান ঢাকার বৈশিষ্ট্য। এগুলো বলে লাভ হবে না।’ বলছিলেন রাকিবুল ইসলাম সজিব।
তাঁরাও নিখোঁজ, ডিএনএ নমুনা দিতে হাসপাতালে স্বজনেরা
শাহাবুদ্দীন আজ পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ। তাঁর রিকশার গ্যারেজ ছিল কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। গ্যারেজের লোকজন বলছে, শাহাবুদ্দীন চকবাজার এলাকায় রিকশা চালান নিয়মিত। বাবা হাসান আলী ভোলা থেকে স্বজন নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছেন ডিএনএ নমুনা দিতে।
চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুন কেড়ে নেয় ৬৭টি প্রাণ। এর মধ্যে ৪৮টি লাশ শনাক্ত হয়েছে এবং পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি লাশ শনাক্তে স্বজনদের ডিএনএ নমুনা নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার সময়ে চকবাজার এলাকায় থাকা নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা ভিড় জমাচ্ছেন হাসপাতালে। হাসান আলীও সন্তানের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশের মধ্যে যদি তাঁর শাহাবুদ্দীন থাকে! সেই আশাতেই মর্গের সামনে হাজির হয়েছেন হাসান আলী। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) নমুনা সংগ্রহ ডেস্কে বসেই ছেলের কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নিখোঁজ আরেক অটোরিকশাচালক মো. ইব্রাহিম। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, ইব্রাহিমও হয়তো সেদিনের আগুনে শেষ হয়ে গেছেন। ইব্রাহিমের ১০ বছরের মেয়ে নাসিমা আক্তার মা ও চাচার সঙ্গে ডিএনএ নমুনা দিতে গেছে ঢাকা মেডিক্যালে।
হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের সুপারিশ
আগুনের ঘটনায় নিহত ২৫ ও আহত ১০ শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অগ্নিকা-ের ঘটনায় ‘আহতদের মধ্যে ১০ জন ও নিহতদের মধ্যে ২৫ জন শ্রমিক রয়েছেন।' গতকাল রোববার বিকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই শ্রমিকদের তালিকা প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আহতদের মধ্যে ১০ জন ও নিহতদের মধ্যে ২৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে একলাখ এবং আহতদের ৫০ হাজার করে টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
এর আগে, ২২ ফেব্রুয়ারি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. জাকির হোসেনকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। অগ্নিকা-ে নিহত ও আহত শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে দুদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। গতকাল রোববার তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
এছাড়া, দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় মন্ত্রণালয়ের করণীয় কী তা নির্ধারণে আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আহম্মদ। এই কমিটিকে আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এই কমিটির কর্মপরিধিতে বলা হয়েছে- এই কমিটি পুরান ঢাকা এলাকার (চকবাজার, লালবাগ, কামরঙ্গীচর, বংশাল, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি) কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানের ধরন ও প্রকৃতি, ব্যবহৃত কাঁচামালসহ তালিকা তৈরি করতে হবে। ওই এলাকায় বিগত বছরগুলোতে কতগুলো কলকারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে এবং পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা, না হয়ে থাকলে তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। ওই এলাকায় প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল কারখানাগুলোর ঝুঁকি নির্ধারণ ও নিরসনের সুপারিশ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে কমিটি।
গতকাল রোববার কমিটি প্রধান জাকির হোসেন বলেন, চকবাজারের আগুনে আহতদের মধ্যে ১২ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তারমধ্যে ১০ জন শ্রমিক পাওয়া গেছে। আহত শ্রমিকদের মধ্যে রিকশাচালকসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে। বাকি দু’জন ব্যবসায়ী।আর হাসপাতাল থেকে মরদেহ হস্তান্তর হওয়া ৪৭ জনের মধ্যে ২৫ জনকে শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে কমিটি। নিয়মানুযায়ী আহত শ্রমিকদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার এবং নিহত শ্রমিকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত ৩৫ জন শ্রমিককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে যদি কেউ প্রমাণাদি নিয়ে আসেন, তাহলে তিনিও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাবেন।
আহত ১১ জনকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকা হস্তান্তর
চকবাজারে অগ্নিকা-ে আহত ১১ জনকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কনফারেন্স রুমে রোগী ও তাদের স্বজনদের হাতে এই টাকা তুলে দেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন। অনুদান হিসেবে প্রত্যেক রোগীর পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
টাকা দেয়ার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন, ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দীন ও বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। এর আগে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে আসেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
বার্ন ইউনিটের ৯ জন ও অন্য ইউনিটের দুইজন রোগীর পরিবারকে এই টাকা দেওয়া হয়েছে। বার্ন ইউনিটের রোগী হেলাল নিজে টাকা গ্রহণ করেন। এছাড়া রোগী আনোয়ারের স্ত্রী হাজেরা বেগম, মাহমুদুলের স্ত্রী পারভীন আক্তার, রেজাউলের মা হোসনে আরা বেগম, সোহাগের মা বেদানা বেগম, জাকিরের স্ত্রী খদেজা বেগম, মোজাফ্ফরের স্ত্রী রেনু বেগম, সেলিমের মা তাসলিমা বেগম ও সালাউদ্দীনের মা সুবর্ণা আক্তার অনুদানের টাকা গ্রহণ করেন। এছাড়া অন্য ইউনিটে ভর্তি রবিউলের বাবা আব্দুল মজিদ ও কাওসারের মা রাশেদা বেগম টাকা নেন।
এ সময় সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রত্যেক রোগীকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। তিনি এ টাকা আপনাদের পরিবারের জন্য খরচ করতে বলেছেন। রোগীদের চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ হাসপাতাল থেকেই দেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোগীদের মধ্যে ছয়জনের অবস্থা বেশি খারাপ। তিনজনের অবস্থা মোটামুটি। তবে কেউই আশঙ্কামুক্ত নন।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ