শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শিকারি পাখি

আব্দুস সালাম : তোমরা অনেকেই জানো যে আমাদের দেশকে পাখির দেশ বলা হয়। এদেশে হরেক রকমের পাখি বসবাস করে। এদের মধ্যে কিছু পাখিকে আবার সারাবছর দেখা যায় না। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এদেরকে আমরা দেখতে পাই। বিশেষ কারণে পাখিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে এবং কিছুদিন থেকে আবার আপন আপন দেশে ফিরে যায়। এদেরকে আমরা পরিযায়ী পাখি বলি। এছাড়াও বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, আচারণ, খাদ্যাভাস, আকার-আকৃতি ও গুণাবলীর কারণে পাখিগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই যেমন- গায়ক, দর্জি, শিকারি, নিশাচর, দিবাচর, কুটুম, মৎসভোজী, পোকাখেকো, গৃহপালিত, শিল্পী, বুদ্ধিমান, সর্বভূক, শবভোজী পাখি ইত্যাদি। 

আজ তোমাদের শিকারি পাখির গল্প শোনাব। মনে রাখবে- সে সমস্ত পাখি তাদের প্রখর ইন্দ্রিয়শক্তি বিশেষত দৃষ্টিশক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে তাদের শিকারি পাখি বলে। পক্ষীবিজ্ঞান অনুসারে যেসব পাখির শিকার শনাক্ত করার জন্য প্রখর দৃষ্টিশক্তি, শিকার ধরার জন্য নখরযুক্ত শক্তিশালী পা ও মাংস ছেঁড়ার জন্য বাঁকানো ঠোঁট থাকে, তাদের শিকারি পাখি বলে। এভাবে যদি কোন পাখি পোকামাকড় শিকার করে তাহলে তাকেও শিকারি পাখি বলা হয়। তাই বলা যায় শুধু ছোট প্রাণী, মাছ বা পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করলেই তাকে শিকারি পাখি বলা হয় না। পক্ষীজগতে মোট ছয়টি গোত্রের সদস্যরা শিকারি পাখি হিসেবে চিহ্নিত। কিছু শিকারি পাখি দিবাচর আবার কিছু শিকারি পাখি নিশাচর। চিল, বাজ, কাপাসি, মাছমুরাল, শকুন, ঈগল এরা দিবাচর শিকারি আর প্যাঁচা, হুতুমপ্যাঁচা ও লক্ষ্মীপ্যাঁচাকে নিশাচর শিকারি পাখি বলা হয়। কিছু শিকারি পাখি আছে যারা মৃত প্রাণীর মাংস খায়। শিকারি পাখির নখগুলো শিকার ধরার জন্য খুব উপযোগী। কবুতর, গাঙচিল ও সারসজাতীয় পাখিদের শিকারি পাখি বলা হয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- এসব পাখি শিকার ধরার জন্য কেবল ঠোঁট ব্যবহার করে, নখর ব্যবহার করে না। একই কারণে পাখিখেকো জলদস্যু পাখি বা জেগার, মৎসভোজী পেঙ্গুইন এবং মাংসাশী কুকাবুরা শিকারি পাখি নয়। এখন তোমাদের কয়েকটি পরিচিতি শিকারি পাখি নিয়ে আলোচনা করব।

 

ঈগল: ঈগল একপ্রকার বৃহৎ আকার, শক্তিধর, দক্ষ শিকারি পাখি। ঈগল সাধারণত বনে বা ঘন জঙ্গলে বসবাস করে থাকে। এদের পায়ের নখগুলো খুব তীক্ষ্ম ও ধারাল। বানর, ছোট জাতের পাখি, টিকটিকি, হাঁস-মুরগি খেয়ে এরা জীবনধারণ করে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক ঈগলের ওজন প্রায় ৩০ কেজি এবং লম্বায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি হয়ে থাকে। এরা ১১,০০০ ফুট পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে। এরা কমপক্ষে ১০০ ফুট উপরে নির্জন স্থানে বাসা তৈরি করে। কম শীত পড়ে এরকম স্থান ওদের খুব পছন্দ। দুঃখের বিষয় এদের এখন আর চরাচর দেখা যায় না। এরা এখন বিলুপ্তির পথে। 

 

শকুন : এরা মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। তোমরা শুনে অবাক হবে যে এরা বুঝতে পারে কোন প্রাণীটা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছে। তাই এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারিদিকে উড়তে থাকে আর প্রাণীটির মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এরা তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী হয়। শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোনো পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে উড়ে বেড়ায়। লোকচক্ষুর আড়ালে এরা বড় বড় বৃক্ষে বাসা বাঁধে। পাহাড়ের গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় এরা একসাথে ১-৩ টা পর্যন্ত ডিম পাড়ে। ডিমের রং সাদা বা ফ্যাকাসে। সারাবিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন রয়েছে। আমাদের দেশে ০৬ প্রজাতির শকুন দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ০৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ০২ প্রজাতি পরিযায়ী। বিভিন্ন দেশে গবাদি পশু চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় ‘ডাইক্লোফেন’ নামক ব্যথানাশক অষুধ। আমাদের দেশেও এই অষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এসব মৃত পশুর মাংস খেয়ে শকুন মারা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এরা এখন বিলুপ্তির পথে। সারাবিশ্বে শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রতিবছর ৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

চিল : চিল দিবাচর শিকারি পাখি। এদের ডানা দুটি বেশ দীর্ঘ, পা দুর্বল ও খাটো। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর। শিকার খোঁজার জন্য এরা আকাশে ডানা স্থির রেখে চক্রাকারে ঘুরপাক খায়। চিল সাধারণত  প্রাণীর মৃতদেহ খায়। তবে অনেক সময়ে এরা ক্ষুদ্র প্রাণীও শিকার করে থাকে। সারাবিশ্বে কালোডানা, কালোকাঁধ, ধলালেজী, শঙ্খ, মুক্তো, বাদুড়ে নামে বিভিন্ন প্রজাতির চিল দেখা পাওয়া যায়।

 

প্যাঁচা : এরা এক প্রকার নিশাচর শিকারি পাখি। সারাবিশ্বের প্রায় সবখানেই প্যাঁচার বসবাস। বাংলাদেশে ১৭টি প্রজাতির প্যাঁচা দেখা যায়। এরা একাকী থাকতে পছন্দ করে। এরা সাধারণত গাছের কোটরে, পাহাড়ের গর্তে বা পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িতে বাস করে। প্যাঁচার মাথা বড় মুখম-ল চ্যাপ্টা এবং মাথার সম্মুখদিকে চোখ থাকে। প্যাঁচার চোখের চারিদিকে সাধারণত বৃত্তাকারে পালক সাজানো থাকে। একে মুখচক্র বলা হয়। এদের অক্ষিগোলক সামনের দিকে অগ্রসর থাকায় এরা দ্বিনেত্র দৃষ্টির অধিকারী। তবে দূরের বস্তু পরিষ্কার দেখতে পেলেও খুব কাছের বস্তু ভালো দেখতে পায় না। এই কারণে এরা শিকার ধরার পর, আহার করার সময় চঞ্চু এবং নখরে অবস্থিত বিশেষ এক ধরনের পালক দ্বারা অনুভব করে আহার করে। এরা নিজের কাঁধের উপর দিয়ে পেছনের জিনিস দেখতে পারে। প্যাঁচার শ্রবণশক্তি অত্যন্ত প্রখর। শুধু শব্দকে অনুসরণ করে ঘন অন্ধকারে শিকার ধরতে পারে। ইঁদুর ও কীটপতঙ্গ এদের খুব পছন্দ। কিছু কিছু প্যাঁচা আছে যারা মাছও ধরে।

বাজপাখি : এরা দিবাচর শিকারি পাখি। চোখা পাখা, চৌকো লেজ, খাঁজ কাটা ঠোঁট এদের বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের ৯ প্রজাতির বাজপাখি রয়েছে। এদেরে মধ্যে ৫ প্রজাতি পরিযায়ী। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় একাকী বসবাস করতে এরা পছন্দ করে। এরা ধারাল নখর দিয়ে কীট-পতঙ্গ, জলপিপি, ছোট পাখি ও মাছ শিকার করে খায়। এদের চোখ দুটো কমনীয় এবং দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। এরা খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান। অনেক উপরে উঠে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ ডানা ভাঁজ করে উড়ন্ত প্রাণীকে ধরে ফেলে। বাজপাখি অত্যন্ত ক্ষীপ্র গতিসম্পন্ন হিংস্র পাখি। এরা অত্যন্ত ধৈর্যশীল। বাজপাখি কখনও অন্যের শিকার ছিনিয়ে নেয় না। দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে থাকে। এগুলো সবই বাজপাখির গুণ। 

এবার বাজপাখির জীবন নিয়ে তোমাদের একটা সুন্দর তথ্য দিতে চাই। তাহলে শোন। বাজপাখি প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এর বয়স যখন বয়স ৪০ বছর পার হয়ে যায় তখন তার নখর দুর্বল হয়ে যায়। সে কোন কিছু ঠিকমতো ধরতে ও ছিঁড়তে পারে না। তার ধারাল চঞ্চু দুটো বেঁকে সামনের দিকে ঝুলে পড়ে। আর ডানা দুটো ভারী হয়ে পড়ে। সে আগের মতো আকাশে উড়েত পারে না। ফলে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকা তার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। তখন তার সামনে দুটি পথ খোলা থাকে। হয় সে মৃত্যুকে বরণ করে নেবে নতুবা যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট সহ্য নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করবে। সে হার মানতে চায় না। অবশেষে শেষেরটিই সে বেছে নেয়। তখন সে একটা উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বাসা বাঁধে। আর শুরু করে নিজেকে পাল্টে ফেলার কঠোর প্রচেষ্টা। সেখানে পাথরের উপর নিজের ঠোঁট ঠুকতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সেটি উপড়ে না পড়ে। একইভাবে পায়ের নখরগুলো খুলে ফেলে। অনাহারে অর্ধাহারে থেকে সে নতুন ঠোঁট ও নখের জন্য ১৫০ দিন অর্থাৎ ০৩ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। নতুন ঠোঁট ও নখ গজানোর পর সে খুব খুশি হয়। তারপর সে তার দেহ ও ডানা থেকে পুরানো পালকগুলো একে একে ছিঁড়ে ফেলে। এভাবে উদোম গায়ে সে আরও ০৩ মাস পর্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট শিকার করে নতুন পালকের জন্য। অবশেষে দেহে নতুন পালক গজাতে শুরু করে। নতুন পালক গজানোর পর সে পূর্বের মতো দেহে আবার শক্তি ফিরে পায়। আবার উড়তে শুরু করে। এভাবে বাজপাখি আরও ত্রিশ বছর বেঁচে থাকতে পারে। কী বুঝলে? বাজপাখির কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে, তাই না? আমরাও হার মানব না। চেষ্টা করতে থাকব যতক্ষণ পর্যন্ত সফল না হবো। আর একটা কথা মনে রাখবে। পাখি কিন্তু আমাদের অনেক উপকার করে থাকে। তাই আমরা এমন কোন কাজ করব না যেন পাখিদের ক্ষতি সাধন করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমরা সবসময় পাখিদের প্রতি যতœশীল হবো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ