সড়কে আবারও শিক্ষার্থীর মৃত্যু
বেপরোয়া বাসের চাপায় আবারও দু’জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে। এবারের ঘটনাস্থল কুমিল্লা। গত মঙ্গলবার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় কুমিল্লার পৃথক দুটি স্থানে প্রাণ গেছে দু’জন স্কুলছাত্রীর। প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, দু’জনের মধ্যে মাত্র ১৫ বছর বয়সী ও দশম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া রানী সাহার মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। আর ১৪ বছর বয়সী ও নবম শ্রেণির ছাত্রী মাহমুদা আক্তার মারা গেছে কুটুম্বপুরে। সে চান্দিনার কুটুম্বপুর হাই স্কুলের ছাত্রী ছিল। দুর্ঘটনা দুটিতে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। কুমিল্লায় নিহত দু’জনকে নিয়ে গত মাত্র ১০ দিনে ১৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটলো সড়কে।
প্রকাশিত খবরে প্রসঙ্গক্রমে অন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যও জানানো হয়েছে। তথ্যটি হলো, কুমিল্লার দুটি দুর্ঘটনার সময়ই চালকের আসনে ছিল দু’জন কিশোর। অর্থাৎ এমন দু’জনই গাড়ি চালাচ্ছিল, যাদের লাইসেন্স তো ছিলই না, বয়সের দিক থেকেও তাদের চালক হওয়ার কথা নয়। তথ্যটির মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার অতি ভয়ংকর অবস্থারই প্রকাশ ঘটেছে। কারণ, কুমিল্লার দু’জনের কেউই একেবারে নতুন ছিল না। তারা বরং অনেক আগে থেকেই গাড়ি চালিয়ে আসছিল। কিন্তু ট্রাফিকসহ পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর সে কারণেই কুমিল্লার কিশোর দু’জন চালকের আসনে বসার এবং গাড়ি চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। ফলে ধরে নেয়া যায়, এমন অবস্থা আসলে দেশের অন্য সব এলাকাতেও বিদ্যমান রয়েছে এবং লাইসেন্সহীন আরো অনেক কিশোরই বেআইনিভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। সড়কে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানিও ঘটে চলেছে একই কারণে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যেন মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই!
আমরা ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর কারণে। ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু অনেক বেশি ঘটছে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, চালকদের মধ্যকার একটি গোষ্ঠী যেন দুর্ঘটনার আড়াল নিয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা করার অভিযান চালাতে শুরু করেছে। গুরুতর হলেও এমন মন্তব্য অকারণে করা হচ্ছে না। গত বছর, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কুর্মিটোলায় দু’জন শিক্ষার্থীকে বাস চাপায় হত্যা করার পর রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যখন সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছিল এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা যখন সড়ক তথা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছিল তখন থেকেই বাস চালকদের মধ্যে অত্যন্ত নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে।
ঠিক কোন মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার কোন গোষ্ঠী ঘাতক চালকদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছেন এবং কোন গোষ্ঠীর বাধা ও হস্তক্ষেপের কারণে চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান যুক্ত করে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি- এসব বিষয়ে দেশের সাধারণ মানুষও অবহিত রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে নামে মাত্র একটি আইন প্রণয়ন করা হলেও ঘাতক চালকদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর। পরবর্তীকালে মৃত্যুদন্ডের বিধান যুক্ত করা হলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যসহ এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, যার ফলে কোনো চালককেই চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত করা সহজে সম্ভব হবে না। এ পর্যন্ত সম্ভব হয়ও নি।
উল্লেখ্য, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ শিরোনামে সরকার যে আইনটি পাস ও বলবৎ করেছে তার মূলকথায় বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রযোজ্য হবে শুধু সেই সব ক্ষেত্রে, যেগুলোতে চালক ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ কাউকে হত্যা করবে! কোনো দুর্ঘটনা ‘ইচ্ছাকৃত’ কি না তা কিভাবে প্রমাণ করা যাবে- সঙ্গত কারণেই সে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, নিজের মক্কেল চালককে বাঁচানোর জন্য আইনজীবীরা অবশ্যই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীসহ নানা ধরনের তথ্য-প্রমাণ চেয়ে বসবেন। একযোগে চলবে পুলিশকে ঘুষ দেয়াসহ টাকা ছড়ানোর এবং সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখানোর তৎপরতা। এসব কারণে খুব কম ক্ষেত্রেই ‘ইচ্ছাকৃত’ হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হবে। সুতরাং ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ কাউকে হত্যা করলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে পার পেয়ে যাবে ঘাতক চালকরা। পার তারা পেয়ে যাচ্ছেও।
আমরা মনে করি, আইনের আড়ালে চালকদের জন্য হত্যার অঘোষিত লাইসেন্স দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত এমন আয়োজন নিশ্চিত করা যাতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই কমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে দরকার দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণসমূহের দিকে নজর দেয়া। কারণ, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সকল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী আসলে বাস চালকরা। তারা ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করে না, মানুষের জীবনের ব্যাপারেও তাদের কোনো মায়া বা দায়দায়িত্ব থাকে না। এজন্যই যখন-তখন এবং যেখানে-সেখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে এবং পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। বিষয়টিকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, দেশে গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। সুতরাং দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বেশি জোর দিতে হবে যানবাহন ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে। এর শুরু হতে হবে বিআরটিএ থেকে, যেখানে ঘুষের বিনিময়ে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল করার অনুমতি এবং গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
চালকদের বয়স, লাইসেন্স এবং প্রশিক্ষণের মতো বিষয়গুলোও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে নজর দেয়া হলে কুমিল্লায় দু’জন কিশোর যেমন চালকের আসনে বসতে পারতো না, তেমনি মৃত্যু ঘটতো না দু’জন স্কুলছাত্রীর। আমরা মনে করি, মাত্র ১০ দিনে সড়কে ১৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাগুলো থেকে সরকারের উচিত শিক্ষা নেয়া এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগী হয়ে ওঠা।