বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

লাশের মিছিলে ২৫ জন হতভাগা

# ২৪  জনের লাশ হস্তান্তর
# স্বজনদের চোখের পানিতে শেষ বিদায়
# এফ আর টাওয়ারের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ
স্টাফ রিপোর্টার : পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্রা থেকে বনানী এফ আর টাওয়ার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। মাঝখানে ৩৭ দিন। এই ৩৭ দিনের ব্যবধানে বনানীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে ২৫ জন। এই ২৫ জনের মধ্যে গতকাল শুক্রবার ২৪ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে স্বজনদের কাছে। একজনকে শনাক্ত করা যায়নি। তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশের মানুষের মধ্যে শোকের আবহ। লাশ হস্তান্তরের পর নিজ নিজ এলাকায় দাফন করা হয়েছে নিহতদের। স্বজনদের চোখের পানিতে বিদায় নিলো নিহতরা।
এদিকে উদ্ধারকাজ ও তল্লাশি শেষ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর গুলশান বিভাগের কাছে এফ আর টাওয়ারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বিকাল ৩টার দিকে ভবনটি বনানী থানা পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ভবনটিতে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের পুলিশ পাহারায় ভেতরে নেয়া হয়।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা পুলিশের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দেখে এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র, কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন। আমরা সেগুলোর তালিকা করে রেখেছি। ভবনটির দুই পাশের ফটকেই পুলিশের পাহারা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ফ্লোরে তল্লাশি করেছি। প্রতিটি জায়গা তল্লাশি করা হয়েছে। শুক্রবার ভেতরে আর জীবিত অথবা মৃত কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। তারপরও এখানে একাধিক ইউনিট অবস্থান করছে।
আগুনে যাদের প্রাণ গেলো : ঢাকায় বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় যে ২৫ জন নিহত হয়েছেন তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলের কাছে স্থাপন করা পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে এই তালিকা দেয়া হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, এটাই চূড়ান্ত তালিকা। এর বাইরে আর কেউ নিখোঁজ নেই।
গতকাল দুপুরে পুলিশের পক্ষ থেকে নিহত ২৫ জনের নামের তালিকা দেওয়া হয়। এঁরা হলেন : সৈয়দা আমিনা ইয়াসমিন (৪৮), তানজিলা মৌলি (২৫), পারভেজ সাজ্জাদ (৪৬), শ্রীলঙ্কার নাগরিক হিরস বিগ্নারাজা (৩৫), মো. সালাউদ্দীন মিঠু (২৫), নাহিদুল ইসলাম তুষার (৩৫), রেজাউল করিম রাজু (৪০), আহম্মদ জাফর (৫৯), জেবুন্নেছা (৩০), মো মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), মো মনির হোসেন সর্দার (৫২), মো মাকসুদুর রহমান (৩২), ফ্লোরিডা খানম পলি (৪৫), আতাউর রহমান (৬২), মো. মিজানুর রহমান, আনজির সিদ্দিক আবীর, আবদুল্লাহ আল ফারুক, রুমকি আক্তার (৩০), মো. মঞ্জুর হোসেন, মো ইফতিখার হোসেন মিঠু (৩৭), শেখ জারিন তাসনিম (২৫), মো ফজলে রাব্বি (৩০), আতিকুর রহমান (৪২), মো আইয়ূব আলী এবং আবদুল্লাহ আল মামুন।
অগ্নিকাণ্ডে কেউ নিখোঁজ নেই : পুলিশ
ঢাকার বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কের ২২ তলা এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ নেই বলে জানিয়েছেন গুলশান জোনের উপকমিশনার (ডিসি) মুশতাক আহমেদ। গতকাল শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। ডিসি মুশতাক আহমেদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে যান চলাচল সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। লোকজনের চলাচলও সীমিত। অগ্নিকাণ্ডে ভবনটির কাচ ভেঙে গেছে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে মানুষ ও যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্ধার কাজ শেষ হলেই রাস্তাটি মানুষ ও যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
ডিসি মুশতাক আহমেদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ নেই। এখন পর্যন্ত ২৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন শ্রীলঙ্কান। ২৪ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে ভবনের প্রতিটি তলায় পুলিশ সদস্য রয়েছে বলেও জানান ডিসি।
তিনটি ফ্লোর সব পুড়ে ছাই
বনানীর এফ আর টাওয়ারের তিনটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভবনের সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলা একেবারে পুড়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ভবনের সপ্তম তলা থেকেই আগুন লাগে। এফ আর টাওয়ার ২৩ তলা।
এই ভবনের বেসমেন্ট পুরোটাই গ্যারেজ। সেখানে এখনো কয়েকটি গাড়ি পার্কিং করা আছে। এখানে আগুন লাগেনি। ভবনের প্রথমটি বেসমেন্ট। প্রথম তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত তেমন ক্ষতি হয়নি। এই তলাগুলোয় অবস্থিত বিভিন্ন অফিসের কর্মীরা সিঁড়ি দিয়েই বের হয়ে নিচে নেমে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী বলেন, সিঁড়িতে ধোঁয়ার কু-লী ছিল। আগুনের সরাসরি আঁচ এই ফ্লোরগুলোতে সেভাবে না লাগলেও একপর্যায়ে ধোঁয়ায় ষষ্ঠ ও পঞ্চম তলা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আট তলার নিচের ফ্লোরগুলোর মধ্যে এই দুটি ফ্লোরে আগুনের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। সিঁড়ি রুম থেকে ধোঁয়া নিচের ফ্লোরের মধ্যেও ঢুকে পড়ে। তবে আট তলার নিচের ফ্লোরের কর্মীরা নাকে কাপড় চেপে ধরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। বৃহস্পতিবার রাতে ও গতকাল  শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিসের দুজন বলেন, মূলত সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলা, এই তিনটি ফ্লোর আগুনে পুড়ে গেছে। এই তিনটি ফ্লোরের কোনো কিছুই আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। ফ্লোরগুলোর বৈদ্যুতিক তারগুলো আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে বলে তারা মনে করছেন। যদিও এখন পর্যন্ত আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তাঁরা মনে করছেন শর্ট সার্কিট থেকে এই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে এটা তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।
 যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে সেই অষ্টম তলায় রেস্টুরেন্ট ছিল প্রথমে বলা হলেও সেখানে কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের অফিস। প্রতিটি ফ্লোরেই প্রচুরসংখ্যক কম্পিউটার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রয়েছে। এগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এই তিনটি ফ্লোর ছাড়া ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ফ্লোরেও আগুনের আঁচ লেগেছে। এই ফ্লোরগুলোতে ধোঁয়া ঢুকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ‘সাফোকেশন’ থেকে বাঁচতে ওপরের দিকের ফ্লোরগুলোর গ্লাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ফ্লোরগুলোর আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম।
এফ আর টাওয়ারের মালিক ২৪ জন
বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ’র এফ আর টাওয়ারে (ফারুক-রূপায়ন টাওয়ার) বৃহস্পতিবার দুপুরে অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটির ত্রটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ম বহির্ভূত নকশা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে এই ভবনের মালিক কে বা কারা তাও জানতে চেয়েছেন অনেকেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জমির মূল মালিকসহ এফ আর টাওয়ারের স্বত্বাধিকারী মোট ২৪ জন।
গতকাল শুক্রবার  দুপুরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত নিরাপত্তাকর্মী, স্থানীয় লোকজন এবং ভবনটির ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এফ আর টাওয়ারের মালিক মোট ২৪ জন। তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ফ্লোরের মালিক। ভবনটিতে ফ্লোর আছে মোট ২৩টি। প্রতিটি ফ্লোরে জায়গার পরিমাণ ছয় হাজার স্কয়ার ফুট। নিচতলা এবং দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন সাইজের দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় তলায় রয়েছে একটি কনভেনশন সেন্টার, যার নাম রোজডেল ব্যানকুয়েট হল। এই হলের মালিক এবং নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার দোকানগুলোর মালিক একই ব্যক্তি, তিনি হলেন ভবনের জমির মূল মালিক এস এম এইচ ফারুক।
ভবনটির ডেভেলপার কোম্পানি হচ্ছে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট। সেই হিসেবে যৌথভাবে ভবনের নাম রাখা হয় ফারুক- রূপায়ণ টাওয়ার (এফ আর টাওয়ার)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সালে ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট। তখন ভবনের মালিকানা ছিল অর্ধেক-অর্ধেক। ২০০৭ সালে জমির মালিক এস এম এইচ ফারুক ভবনটি বুঝে পান। এফ আর টাওয়ারের চতুর্থ তলা থেকে ওপরের দিকে ২৩ তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে চারটি করে ইউনিট রয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে জায়গার পরিমাণ ১৫০০ স্কয়ার ফুট। ডেভেলপার কোম্পানি রূপায়ন ওই ভবনে তাদের অংশ বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই হিসাবে বর্তমানে ভবনটির মালিক মোট ২৪ জন। মালিকরা আবার কেউ কেউ তাদের ফ্লোরগুলো ভাড়া দিয়েছেন। বর্তমানে ভবনটিতে ২৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে কাশেম ড্রাইসেল নামে একটি কোম্পানি তিনটি ফ্লোরের মালিক, ‘আমরা টেকনোলজিস’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের আছে চারটি ফ্লোর, ডার্ড গ্রুপের রয়েছে পাঁচটি ফ্লোর।
জমির মূল মালিক ফারুকের ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে ভবনটির মালিক ২৪ জন, আর প্রতিষ্ঠান আছে ২৯টির মতো। এর মধ্যে একজন মালিক হলেন সানলাইট ব্যাটারির প্রস্তুতকারক কাশেম ড্রাইসেল লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাসভিরুল ইসলাম। তার ফ্লোরগুলো হরো ২০,২১ ও ২২ তলা। এছাড়া, আরও মালিক যারা আছেন তাদের কারও কারও নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে, আবার কেউ কেউ ভাড়া দিয়েছেন।’
দুর্ঘটনা ঘটলে অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্ব ভবন মালিককে নিতে হবে -মেয়র
এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্ব ভবন মালিককে নিতে হবে।
গতকাল শুক্রবার বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিয়ে এফ আর টাওয়ার পরিদর্শনে এসে মেয়র এসব কথা বলেন।
আতিকুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন বহুতল ভবনের আনুষঙ্গিক কাগজপত্র রাজউকের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে সব ভবনকে কাগজপত্র দিতে হবে। এসব হাতে পেলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান শুরু করবে। অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেয়র আতিক বলেন, অফিসগুলোকে জানতে হবে তারা যেখানে অফিস নিচ্ছে সেখানে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা আছে কি না।
আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন থেকে নিজের নিরাপত্তা নিজেরা বিবেচনা করে দেখবেন। অফিসে ঢোকার আগে দেখে নিন, আগুন লাগলে বের হওয়ার বিকল্প পথ আছে কি না।’
 ছোট্ট নাইম মানুষের প্রয়োজনে বের হতে চায়
আট থেকে দশ বছরের এক শিশুর চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ। দুই হাত ও পায়ের সাহায্যে পলিথিন পেঁচিয়ে পানির পাইপ চেপে ধরে আছে। বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এমন একটি ছবি ভাইরাল হয়। উৎসুক জনতার কারণে উদ্ধারকাজে সমস্যা হয়েছে বলে একদিকে যেমন সমালোচনা ছিল, তেমনি নাইম নামের এই শিশুটির কাজ প্রশংসাও কুড়িয়েছে।
নাইম আনন্দ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। থাকে কড়াইলের বৌবাজারে। বাবা রুহুল আমীন ডাব বিক্রেতা। মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। ছোট এক বোন আছে। নাইমের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। নাইম নিজেও জানে তার ছবি ইতিমধ্যে ভাইরাল। আজ শুক্রবার তাকে পাওয়া গেল এফআর টাওয়ারের সামনে।
কীভাবে নাইম খবর পেল এখানে আগুন লেগেছে? সে বলে, ‘দুপুর একটা বাজে আগুন লাগার কথা শুনলাম। দুইটা বাজে চলে এলাম। এসে দেখি আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। ধোঁয়ার কারণে মানুষ দম নিতে পারছে না। তারপর দেখি পাশে পাইপ ফাটা। চাপ দিয়ে ধরে রাখলাম যাতে পানিটা অন্য কাজে খরচ না হয়, আগুন নেভাতে খরচ হয়। প্রায় ২০ মিনিট ধরে রেখেছিলাম।’
শুধু পানির পাইপ ধরে রেখেই নয়। নাইম উৎসুক জনতার ভিড় সামলিয়ে ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ উদ্ধারকাজ সংশ্লিষ্টদের নির্বিঘ্নে এফআর টাওয়ারে ঢুকতেও সহায়তা করেছে। কারণ নাইম জানে সেখানে সাধারণ মানুষের ঢোকার অনুমতি নেই। তাই তারা যেন ঢুকতে না পারে সে জন্য অন্যদের সঙ্গে সেও কাজ করে। বেলা পাঁচটায় সে বাড়ি ফিরে যায়। পুলিশের কর্মকর্তা হতে চায়। জনগণের সেবা করবে জানিয়ে বলে, ‘মানুষের প্রয়োজনে আমি বের হব।
মর্গে বেজে উঠল রাব্বির ফোন
ফজলে রাব্বি ও আনজির আবির বনানীর অগ্নিকাণ্ডে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে আনা হয় সাতটি লাশ। তখনো তারা অজ্ঞাত। ঠিক এমন সময় একটি মরদেহের পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। আর তাতেই মিলল একজনের পরিচয়।
ওই যুবকের নাম ফজলে রাব্বি (২৭)। এক সন্তানের এই জনকের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড়ে। মর্গে রাব্বির সঙ্গে থাকা ফোন বেজে উঠলে তা বের করে কথা বলেন লাশের সঙ্গে থাকা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের একজন কর্মী। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এ কথা জানালেন রাব্বির বড় বোন শাম্মী আক্তার। পরে আরেক যুবকের লাশ শনাক্ত করেন তাঁর স্বজনেরা।
ফোনে শাম্মী আক্তার জানান, ফজলে রাব্বি দুর্ঘটনাকবলিত এফ আর টাওয়ারের ১১ তলায় ইউরো সার্ভিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
লাশ শনাক্ত হওয়ার আরেক যুবকের নাম আনজির আবির (২৪)। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের পাটগ্রামে বলে জানিয়েছেন তার ভগ্নিপতি দেলোয়ার হোসেন।
দেলোয়ার জানান, অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর থেকেই তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতালে আবিরের সন্ধান করছিলেন। তিনি জানান, আবির ওই ভবনেই শেয়ারবাজার নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। আবির রাজধানীর কল্যাণপুরে বসবাস করতেন।
ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক প্রদীপ বিশ্বাস বলেন,অধিকাংশই ধোঁয়ার আচ্ছন্ন হয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে তাঁর ধারণা।
৯৯৯ ফোন করে আগুনের খবর দেন কিরন
বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগতে দেখে ৯৯৯ (জরুরি সেবা)-এ প্রথম ফোন করে তথ্যটি জানান মাহমুদুল হক কিরন নামের এক ব্যক্তি। যখন আগুন লাগে তখন তিনি এফ আর টাওয়ারের ঠিক অপরপাশে থাকা এসএমসি ভবনের পঞ্চম তলায় নিজ অফিসে ছিলেন। কিরন লিংকথ্রি টেকনলোজি গ্রুপের সিনিয়র টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত আছেন।
তিনি জানান, আগুনের তাপে ভবনের আট তলার গ্লাস যখন ভেঙে নিচে পড়ে তখন তার এক সহকর্মী এসে অগ্নিকা-ের বিষয়টি জানান। পরে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে জরুরি সেবা- ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে আগুনের ঘটনাটি জানান।
মাহমুদুল হক কিরন বলেন, ‘এসএমসি ভবনের পঞ্চম তলায় আমার অফিস। অফিসের ভেতরে আমার ডেক্সটি একেবারে জানালার পাশেই ছিল। সেখান থেকে এফআর টাওয়ার স্পস্ট দেখা যায়। দুপুরে আমি আমার ডেক্সে বসেছিলাম। তখন আমার এক সহকর্মী জানায় এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগেছে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি নিচের মানুষগুলো টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে এবং টাওয়ারের আট তলায় জানালার কাচ ভেঙে আগুন বের হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমার কিছু করার ছিল না। তাই আমি দ্রুত ডেক্স থেকে মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে ৯৯৯-এ কল দেই। তখন দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট ছিল। একজন মহিল কলটি ধরেছিলেন। তাকে আগুনের খবরটি দেওয়ার পর তিনি আরেকজনকে লাইন ট্রান্সফার করেন। তখন আগুনের খবরটি দিলে তার বললেন, ঠিকানা বলতে, আমি ঠিকানা বলে ফোনটি রেখে দেই। খবর দেওয়ার ৩০ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি গাড়ি আসে। তারা ঘটনাস্থলে এসে তাদের যন্ত্রপাতি সেট করতে ১০ মিনিট সময় লাগায় পানি দিতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগুন নেভাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখনও আমি ঘটনাস্থলে আমার অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আগুনের সূত্রপাত হয় এফ আর টাওয়ারের পেছনের পাশ থেকে। পরে তা ছড়িয়ে পড়লে সামনের অংশও পুড়ে যায়।’
৯৯৯-এ ফোন করে আগুনের খবর দেওয়ার বিষয়টি কিভাবে মাথায় এসেছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় শুনি, ৯৯৯-এ কল দিলে নাকি জরুরি সেবা মিলে। তাই আমি তাৎক্ষণিক জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দিয়ে আগুনের খবরটি দেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ