শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আইনী জটিলতায় নিউজপ্রিন্টের ৮শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প

খুলনা অফিস : এশিয়ার বিখ্যাত কাগজ তৈরির কারখানা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল অভ্যন্তরে ৮শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগটি আইনী জটিলতায় আটকে আছে। সোনালী ব্যাংকের কাছে মিলটি এখনও প্রায় চারশ’ কোটি টাকা ঋণ থাকায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পত্র দিয়ে তা’ পরিশোধ না করে কার্যক্রম বন্ধের আহবান জানানো হলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিষ্ঠান নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানী লি. কর্তৃপক্ষ বলছেন, দু’টিই যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান সুতরাং এটি দ্রুতই সমাধান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া ৮শ’ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যেহেতু ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদন হয়েছে সেহেতু আন্ত:মন্ত্রণালয় সমঝোতার মাধ্যমেও এটি সমাধান করা সম্ভব। নগরীর খালিশপুরস্থ বন্ধকৃত নিউজপ্রিন্ট মিলের প্রায় ৮৮ একর জমির মধ্যে ৫০ একর জমি দেয়া হয়েছে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানীকে। প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে রূপসা ৮০০ মেগাওয়ার্ড কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। যদিও গত ১১ ডিসেম্বর চুক্তি হলেও ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকায় কাগজপত্র বুঝে পায়নি কোম্পানীটি। তার পরেও ইতোমধ্যে নির্দিষ্ট জায়গা দখলে নিয়ে গাছপালা বিক্রির টেন্ডার দেয়া হয়েছে। নিউজপ্রিন্ট মিল স্কুলটিও অন্যত্র সরিয়ে নিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নিজস্ব জায়গা পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে নিজস্ব সিকিউরিটিও। পক্ষান্তরে নিউজপ্রিন্ট মিল কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব সিকিউরিটি গার্ড রয়েছে সেখানে। সব মিলিয়ে একই জমি এখন দু’টি প্রতিষ্ঠানের পাহারাদারদের দখলে রয়েছে।
খালিশপুরস্থ নিউজপ্রিন্ট মিল এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, আবাসিক এলাকা ও স্কুলসহ আশপাশের ৫০ একর জমিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানী।
তবে এ বিষয়ে নিউজপ্রিন্ট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার মজুমদার বলেন, নর্থ ওয়েস্টের পক্ষ থেকে দেয়া গাছপালা বিক্রির টেন্ডারটি তিনি পত্রিকায় দেখেছেন। যা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের কাছে যেহেতু নিউজপ্রিন্ট মিলের জমি বন্ধক রয়েছে সেহেতু ব্যাংক থেকেও তাকে এবং বিসিআইসিকে পত্র দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কি হবে সেটি কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও তিনি জানান।
নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানীর রূপসা ৮শ’ মেগাওয়ার্ড কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য গত বছর ২২ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকে অনুমোদন হয়। যা প্রকল্প আকারে কাজ শুরু হয় গত বছর ৫ জুলাই। গত ১১ ডিসেম্বর চুক্তি হওয়ার পরপরই দু’শ’ কোটি টাকা বিসিআইসিকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তিনটি প্যাকেজে ভাগ করে কাজটি এগিয়ে নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে বিদ্যুৎ গ্রীডে নেয়ার জন্য প্রথমত দু’টি লাইন নির্মাণ করতে হবে। একটি ২৯ কিলোমিটার এবং অপরটি ১১ কিলোমিটার। এছাড়া মিলের স্কুলটি ভেঙ্গে অন্য জায়গায় স্কুল ভবন নির্মাণ করে দেবে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড। এসব কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে।
অবশ্য নর্থ ওয়েস্টের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের এ কাজের অংশ হিসেবে নির্ধারিত সীমানার মধ্যের গাছপালাসহ অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে নিতে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেয় কোম্পানীটি। যা গত ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি দু’টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপরই সোনালী ব্যাংকের নজরে আসে বিষয়টি। ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করে এমনকি জমি হস্তান্তর না নিয়েই টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়। আবার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিসিআইসি’র একজন প্রতিনিধি রাখার অনুরোধ জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি একটি পত্র দেয়া হয় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. খালেকুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই পত্রে জমির মালিকানা হস্তান্তর না হওয়ার পরও নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় সমালোচনা করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু নর্থ-ওয়েস্ট কোম্পানির কাছে এখনও ৩৮৬ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে তাই ওই জমি, স্থাপনা ও গাছপালার মালিকানা স্বত্ত্ব এখনও হস্তান্তর হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে নিলামের বিক্রয়লব্ধ অর্থ বিসিআইসি’র বকেয়া পাওনার সঙ্গে সমন্বয় এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিসিআইসি’র একজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করারও অনুরোধ জানানো হ।
সোনালী ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মুন্সী জাহিদুর রশীদ বলেন, যেহেতু এটি একটি সরকারি উদ্যোগ এবং ব্যাংকও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান সেহেতু সবকিছুই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। কারণ ব্যাংকের কাছে জমির দলিলপত্র রেখে সেখানে কোন কার্যক্রম করা আইনগতভাগে কতটা সঙ্গতি রাখে সেটি বিবেচনায় আনা উচিত। উন্নয়নের স্বার্থে অর্থ, শিল্প ও বিদ্যুৎ এ তিনটি মন্ত্রণালয়কে দ্রুত সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। নিউজপ্রিন্ট মিলের কাছে তিনশ’ ৭০ কোটি টাকারও উপরে পাওনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে মাত্র ৫৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, মাত্র ৭২ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হলেও তার সুদ নিয়ে এখন পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিনশ’ ৭০ কোটি টাকার উপরে। সুতরাং সবগুলোই যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান সে কারণে সুদ মওকুফ করারও সুযোগ সরকারের রয়েছে। আবার সুদ মওকুফ না করা হলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের খরচ বেড়ে যেতে পারে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বাড়বে। যার সর্বশেষ চাপ গিয়ে দেশের মানুষের ওপরই পড়বে। কেননা বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে দামও বেড়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে এসব বিষয় নিয়ে সন্তোষজনক সমাধান করে দ্রুত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
অবশ্য ২০০২ সালে নিউজপ্রিন্ট মিলটি বন্ধের পর থেকে এ নিয়ে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা’ আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ এ সরকারের গত মেয়াদের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু খুলনা এসে বলেছিলেন, দ্রুতই নিউজপ্রিন্ট মিলটি চালু হবে। কিন্তু সরকারের এ মেয়াদে এসে মিল চালু না করে নর্থ ওয়েস্ট কোম্পানীর কাছে ৫০ একর জমি দেয়া হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য।
উল্লেখ্য, নগরীর শহর খালিশপুরে ভৈরতের তীরে ৮৭.৬৯৫ একর জমির ওপর ১৯৫৯ সালে স্থাপন হয় খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। কানাডার মেসার্স স্যান্ডওয়েল এন্ড কোম্পানীর মাধ্যমে ই.পি.আই.ডি.সি মিলটি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৫৯ সালে পরীক্ষামূলক ও বাণিজ্যিক উৎপাদনের পর ১৯৮১ সালে শুরু করে ১৯৮৫ সালে বিএমআরই সম্পন্ন করে। এর পর ১৯৯৮-৯৯ ও ১৯৯৯-২০০০ সালে মিলটির সর্ট বিএমআরই করা হয়। কিন্তু লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ২০০২ সালের ৩০ নবেম্বর মিলটি বন্ধ করা হয়। বন্ধের পর ২০০৫ সালে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন বিরাষ্ট্রীয়করণ তালিকাভুক্ত করে। ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর এর স্থায়ী সম্পদ দেখানো হয় ৩ কোটি ৯৩ লাখ ২ হাজার টাকা এবং চলতি সম্পদ দেখানো হয় ৪০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ এর মোট সম্পদের পরিমান দেখানো হয় চার কোটি ৩৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এর মাত্র এক বছর পর অর্থাৎ ২০০৮ সালের ২ মার্চ প্রাইভেটাইজেশন কমিশন কর্তৃক বিরাষ্ট্রীয় করণের উদ্দেশ্যে দরপত্র গ্রহণ করা হয়। যার সর্বোচ্চ দর হয় এক কোটি ২৭ লাখ ২৭ কোটি টাকা। স্থায়ী সম্পদ ও চলতি মূলধনের চেয়ে কম দর পাওয়ায় ওই দরপত্র বাতিল করা হয়। একই বছর ১৩ মে দ্বিতীয় বার দরপত্র আহবান করা হলেও কোন দরপত্র পাওয়া যায়নি। ওই বছর ২৮ আগষ্ট অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক মিলটি লীজ অথবা অন্য কোন পদ্ধতিতে চালু করার লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে ফেরত প্রদান করা হয়। এর পর ২০০৯ সালের ২৮ মে সমীক্ষা কমিটি গঠনের মধ্যদিয়ে সরকার পুন:চালু কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু সেটিও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। সর্বশেষ নগরীর খালিশপুর গোয়ালপাড়ায় ২৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকা নর্থ ওয়েস্ট কোম্পানি আরও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি খুঁজতে থাকে। ঠিক এমন সময়ই নিউজপ্রিন্ট মিলের ৫০ একর জমি নর্থ-ওয়েস্টকে দিতে রাজী হয় বিসিআইসি। যে কার্যক্রম এগিয়ে চললেও ব্যাংকের ঋণ জটিলতায় তা’ থমকে যেতে বসেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ