শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রাজধানী যেন আবারও তলিয়ে না যায়

মঙ্গলবার মাত্র ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকা পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। আগেরদিন সোমবারও রাজধানীবাসীকে একই পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। অথচ পরিমাণের দিক থেকে বৃষ্টি কিন্তু বেশি হয়নি। আবহাওয়া বিভাগের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, সোমবার বৃষ্টি হয়েছিল মাত্র ৪৮ মিলিমিটার। দুই দফায় হলেও মঙ্গলবারও এত বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয়নি যার ফলে পুরো রাজধানীই তলিয়ে যাবে। অন্যদিকে সেটাই ঘটেছে। এমন কোনো এলাকার নাম বলা যাবে না, যেখানে হাঁটু পর্যন্ত শুধু নয়, কোমর পর্যন্তও পানি না জমেছিল। ফলে প্রাইভেট কার ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা তো বটেই, বাস ও ট্রাকের মতো বড় বড় যানবাহনও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেনি। বহু এলাকায় উল্টে গেছে যাত্রীসহ অসংখ্য রিকশা। মিরপুর ও শ্যাওরাপাড়ার মতো বেশ কিছু এলাকায় এমনকি কোনো যানবাহনই দেখা যায়নি। ফলে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তিও সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দৈনিক সংগ্রামসহ বুধবারের সকল সংবাদপত্রেই এসব দৃশ্যসহ সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে যথারীতি প্রাধান্য পেয়েছে পানি আবদ্ধতার বিভিন্ন কারণ। নগরবিদসহ বিশেষজ্ঞরা তাদের মূলকথায় আবারও নদী ও খাল ভরাট করে ফেলার এবং অপরিকল্পিত সুয়্যারেজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের পথ তথা খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে যাওযায় বৃষ্টির স্বল্প পরিমাণ পানিও বেরিয়ে যেতে পারছে না। তার ওপর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলছে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল চলাচলের জন্য ব্যাপক নির্মাণ কাজ।
এসব কারণে একদিকে যেখানে-সেখানে মাটির স্তূপ জমা করা হচ্ছে, অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সকল ড্রেন ও ম্যানহোল। পরিণতিও যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে সেসব এলাকায় পানি সরে বা বেরিয়ে যেতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে অবিশ্বাস্য পানি আবদ্ধতার। কিন্তু এসব বিষয়ে যাদের নজর দেয়ার ও ব্যবস্থা নেয়ার কথা, সেই ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনসহ কোনো সংস্থাই বড় বড় বাগাড়ম্বর করার বাইরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, দুই মেয়র এবং কর্তা ব্যক্তিরাও বিশেষজ্ঞদের সুরে এমনভাবে খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার তথ্য শোনাচ্ছেন, যেন এসব বিষয়ে তাদের করার কিছু নেই! এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই রাজধানীর অলিতে-গলিতে পর্যন্ত এখনো খোঁড়াখুঁড়ি এবং নানারকম স্থাপনা নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে স্বার্থান্বেষীরা। এজন্যই ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলি লিটার বৃষ্টি হলেও তলিয়ে যাচ্ছে পুরো রাজধানী। ­বলার অপেক্ষা রাখে না, অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটানো না হলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কারণ, দু’দিন পরই ঝড়ের মাস বৈশাখের শুরু হবে। তার পরপর আসবে বৃষ্টি-বাদলের মাস আষাঢ় ও শ্রাবণ। ওদিকে এগিয়ে আসছে পবিত্র মাস রমযান। বড় কথা, দেড় কোটি মানুষের বসবাস যে ঢাকায় তা শুধু বিরাট একটি মহানগরী নয়, বাংলাদেশের রাজধানীও। সে কারণে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে নানা কাজে। রাজধানীবাসীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আগত সকল মানুষকেও চরম ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়। এমন ভয়ংকর অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই ঘটানো দরকার।
আমরা মনে করি এবং একথা অতীতেও বহুবার বলা হয়েছে যে, দখল ও ভরাট করে ফেলা খালগুলোকে উদ্ধার এবং সুয়্যারেজ তথা নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া রাজধানীকে পানি আবদ্ধতার সমস্যা থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অতীতের প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় সিটি করপোরেশনের আড়াই হাজার কিলোমিটার উন্মুক্ত ড্রেন দিয়ে ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও সাড়ে তিনশ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়্যারেজ হয়ে বৃষ্টির সব পানি গিয়ে আশপাশের নদ-নদীতে পড়ার কথা। পানি নিষ্কাশনের এ ব্যাপারে চারটি নদ-নদী এবং ৬৫টি খাল অতীতে বিশেষ ভ’মিকা রাখতো। সে কারণেই ২০১০ সালে প্রণীত ড্যাপ বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে রাজধানীর পাঁচ হাজার  ৪২৩ একর জায়গা বিল-পুকুর, ২০ হাজার ৯৩ একর জায়গা খাল ও নদী এবং ৭৪ হাজার ৫৯৮ একর জায়গা বন্যা প্রবাহ অঞ্চল হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু দখলদারদের বেপরোয়া কর্মকান্ডের পরিণতিতে ২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নদী ও খালের আয়তন ২০১৪ সালের মধ্যেই কমে মাত্র ১০ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটার হয়ে গেছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পানি আবদ্ধতার অশুভ পরিণতি থেকে মুক্তি পেতে হলে নদী ও খালগুলোকে অবশ্যই উদ্ধার করে রাজধানীর অভ্যন্তরে এবং চারপাশে সার্কুলার ওয়াটারওয়ে তৈরি করতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরাও মনে করি, সিটি করপোরেশন ও সরকারের উচিত দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া সকল খাল ও নদী উদ্ধার করে অবিলম্বে সার্কুলার ওয়াটারওয়ে তৈরি করার কাজ শুরু করা। সরকারকে একই সাথে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলসহ সকল নির্মাণ কাজ  দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে। কোনো স্থাপনার নির্মাণ কাজের জন্য রাজধানীর যেখানে-সেখানে ইট-সিমেন্ট ও বালুর মতো সামগ্রীর এবং মাটির স্তুপ জমিয়ে রাখার কার্যক্রম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দিতে হবে যাতে সকল ড্রেন ও নালা-খন্দক পরিষ্কার করা হয় এবং যাতে কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনার স্তুপ জমতে না পারে। একথা বুঝতে হবে যে, সামনের দিনগুলোতে বৃষ্টি যেমন প্রচুর হবে তেমনি এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হলে রাজধানী আবারও যে কোনো সময় স্থবির হয়ে পড়তে পারে। আমরা আশা করতে চাই, বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আগেই সরকার তথা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশন দ্রুত তৎপর হয়ে উঠবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ