শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বগুড়ায় টনসিল অপারেশনকালে শিশুর মৃত্যু চিকিৎসকের পলায়ন ॥ ক্লিনিক ভাংচুর

বগুড়া অফিস : বগুড়া শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে টনসিল অপারেশনকালে ৬ বছর বয়সী স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বগুড়া শহরের সুত্রাপুর এলাকায় মালেকা নার্সিং হোমে এ ঘটনা ঘটে। মৃত শিশু হুমাইরা আকতার সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নলকা কায়েমগ্রামের কৃষক হারুনার রশিদের  মেয়ে। অপারেশনের বিল আদায় ও চার ঘন্টা অভিনয়ের পর  সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে চিকিৎসকরা মৃত শিশুকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের হাসপাতালে রেফার্ড করেন বলে স্বজনরা অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ লোকজন ক্লিনিকে ভাঙচুরের চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।  জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নলকা কায়েম গ্রামের কৃষক হারুনার রশিদের মেয়ে হুমাইরা আকতার (৭) স্থানীয় কায়েমগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার টনসিলে সমস্যা হলে গত দুদিন আগে বগুড়া শহরের শেরপুর সড়কের সুত্রাপুর এলাকায় মালেকা নার্সিং হোমে আনা হয়। সেখানে ওই শিশুকে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. সাইদুজ্জামানকে দেখান হয়। শিশুর মামা আলমগীর তালুকদার জানান, ওই চিকিৎসক সোমবার বিকাল ৩টায় অপারেশনের সময় ধার্য করেন। অপারেশন ফি ধরা হয় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। সোমবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে হুমাইরাকে ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়। বিকাল ৩টায় তাকে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নিলে আধা ঘন্টা পর ডা. সাইদুজ্জামান ভেতরে ঢোকেন। বিকাল ৪টায় চিকিৎসক বাইরে এসে জানান, অপারেশন সাকসেসফুল, রোগীকে বেডে দেয়া হবে। এরপর নার্স ও বয়রা হুমাইরাকে বেডে নিয়ে যায়। কিন্তু হুমাইরার পালস্ না থাকা ও শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয়ায় স্বজনদের সন্দেহ হয়। তারা চিকিৎসক ও নার্সকে বিষয়টি জানালে তারা কর্ণপাত না করে জানান, রোগী ভালো আছে শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে। এর আগেই অপারেশন ফি আদায় করা হয়। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত জ্ঞান না ফেরায় স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসক জানান, রোগীর অবস্থা ভাল নয়, তাকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে। এ বলে চিকিৎসকরা তড়িঘড়ি রেফার্ড করেন। শিশুকে সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাবার আগে স্বজনরা নিশ্চিত হবার জন্য প্রথমে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নেন। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কোনো মন্তব্য করেননি। তারা শিশুটিকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে নেয়ার পর চিকিৎসক ইঙ্গিতে বোঝান হুমাইরা মারা গেছে। এরপর বাবা হারুনার রশিদ, মা সাহেদা ও মামা আলমগীর শিশুর লাশ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মালেকা নার্সিং হোমে ফিরে আসেন। এদিকে, ভুল অপারেশনে শিশু মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে বিক্ষুব্ধ জনতা ক্লিনিকে ভাংচুর করেন। এ সময় চিকিৎসক, নার্স, ক্লিনিকের ম্যানেজার ও অন্যরা বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে সেখান থেকে পালিয়ে যান। কেউ কেউ ক্লিনিকের ভেতরে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকেন। খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ ক্লিনিকে যায়। ওই সময় রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সে শিশু হুমায়রা আকতারের নিথর দেহ পড়েছিল। পাশে বাবা-মা আহাজারি করছিলেন। মা সাহেদা শুধু আহাজারিতে সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, ভুল চিকিৎসায় তার বুকের মানিককে মেরে ফেলা হয়েছে। একই দাবি করেন, শিশুর মামা আলমগীর তালুকদার। তিনি বলেন, ভুল অপারেশনের সময় তার ভাগনীর মৃত্যু হলেও চিকিৎসক ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ চার ঘন্টা তাদের সঙ্গে অভিনয় করেন। শিশু বেঁচে আছে, শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে বলে ক্লিনিকের বিলও আদায় করেন। এরপর সকলে পালিয়ে যান। এমনকি রোগীর সঙ্গে দেয়া চিকিৎসাপত্র ও রেফার্ড লেটার গায়েব করে দেয়া হয়েছে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ওসি এসএম বদিউজ্জামান এবং পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুজ্জামান মিয়া ক্লিনিকে যান। এ সময় তারা পুরো ক্লিনিক খুঁজে শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসক রাফি হাসানকে পান। ডা. রাফি জানান, এ ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ও ম্যানেজার বেলাল হোসেন। তিনি রাতে কাজে আসার পর জানতে পেরেছেন, ডা. সাইদুজ্জামান এক শিশুর টনসিল অপারেশন করেছেন। শিশুর অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। এনেসথেয়েটিস্ট কে ছিলেন তাও তিনি জানেন না। ফোন বন্ধ রাখায় ডা. সাইদুজ্জামান ও অন্যদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। রাত ১টার দিকে সদর থানা পুলিশ শিশুর লাশ উদ্ধার করেন। চিকিৎসকের অবহেলায় শিশুর মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে সদর থানার ওসি এসএম বদিউজ্জামান বলেন, রাত ১ টার দিকে শিশুর মরদেহ থানায় আনা হয়। তবে তার পরিবারের কেউ অভিযোগ না দেয়ায় মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শিশুর পরিবার মামলা দিলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা: সামির হোসেন মিশু বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি বিষয়টি জেনেছেন। কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি। তবে অভিযোগ করলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীরা জানান, এর আগেও এই ক্লিনিকে মুসলমানী ও টনসিল অপারেশন করতে গিয়ে দুটি শিশু মারা গিয়েছিল। এরপরও কর্তৃপক্ষ বহাল তবিয়তে ক্লিনিক পরিচালনা করে আাসছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ