শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বিদ্রোহী কবি নজরুলের “মা”

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল : নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদের সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায় না। তিনি বাংলা ১৩১৪ সালের ৭ চৈত্র ইংরেজী ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিণত বয়সে পরলোক গমন করেন। বয়স হয়েছিল ষাট বছর। তিনি আরবি, ফারসি জানতেন তবে তাঁর বাংলা ও উর্দূ ভাষার উপর রীতিমত দখল ছিল। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দর। চুরুলিয়া অঞ্চলের নামকরা দলিল লিখিয়ে ছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলেও তাঁর সুনাম ছিল। কাজী ফকির আহমদের পিতার নাম কাজী আমিনুল্লাহ।
কাজী ফকির আহমদ সুপুরুষ ছিলেন। পিতার ওয়ারিশ সূত্রে প্রায় চল্লিশ বিঘার মতো চাষের জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে এক বসত বাড়ী ছাড়া তাঁর বিষয় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তবে বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশাখেলা। এই খেলা তাঁকে প্রবলভাবে পেয়ে বসেছিল। তাঁর এই পাশা খেলার অন্যতম জুড়ি ছিলেন মহানন্দ আশ নামক এক বণিক, তাঁর কাছেই কাজী ফকির আহমদ তাঁর বেশির ভাগ সম্পত্তি হেরেছেন পাশা খেলায়।
কাজী ফকির আহমেদ প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুন। তিনি চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর গর্ভে একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুন। সৈয়দা খাতুনের মৃত্যুর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুন কে। তিনি চুরুলিয়ার পার্শ্ববর্তী ভূড়ি গ্রামের উচ্চ বংশজাত মহিলা ছিলেন। তিনি অতি দয়াবতী রমনী ছিলেন। জাহেদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান পিতার দারিদ্য বশত উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পিতার মৃত্যুর পর অন্ন সংস্থানের জন্য রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে চাকরি নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লা খনিতে নিযুক্ত থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয় এবং অসুখে ভুগে পঞ্চাশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কাজী সাহেব জানও অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।
কাজী আলি হোসেন পড়াশুনা করেন কাজী পাড়ায় মক্তবে। পারিবারিক সূত্রে দলিল লেখকের কাজে পরবর্তীকালে নিযুক্ত হন এবং আইন আদালত বিষয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেন। এলাকার কৃষক শ্রমিকদের হয়ে সমাজ সেবকের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের তৎকালীন জমিদার জোতদারদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি নিজ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন।
কাজী নজরুল কিশোর বয়সে সেই যে গৃহত্যাগ করলেন তারপর মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর পল্টন থেকে ফিরে ১৯২০ সালে একবার চুরুলিয়ায় গেলে সেখানে সপ্তাহ কাল ধরে অবস্থান করেন তিনি। এই সময় মায়ের সাথে তাঁর নানা বিষয়ে অনেক আলাপ হয়। শেষে কথায় কথায় ভীষণ ঝগড়া বেধে যায়। এই ঝগড়ার কারণ জানা যায়নি। নজরুল ও পরবর্তীতে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলেন নি। ঝগড়ার পর তিনি বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর তাঁর মা যতদিন জীবিত ছিলেন কত অনুরোধ করেছেন কত আব্দার ধরেছেন ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য কিন্তু নজরুলের জেদ আর অভিমান এতটা তীব্র ছিলো যে মায়ের অনুরোধ তিনি রাখেন নি। ইহকালে মায়েরও আর ছেলের মুখ দেখা হয়নি।
শোনা যায় নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। সে সময় তাঁর বয়সও ছিল কম। একজন বয়স্কা সুন্দরী বিধবা রমনী সম্মানের সঙ্গে নিজের ইজ্জত আব্রু রক্ষা এবং নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণের নিশ্চয়তার জন্য যদি মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করেই থাকেন তাহলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেটাকে কোন অন্যায় বলা চলেনা। তা ছাড়া ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে এ ধরণের বিয়েকে বরং উৎসাহিতই করা হয়েছে। তবে একথা মিথ্যে নয় যে, উভয় বঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এতটাই অনুদার যে, সম্পূর্ণ বৈধ হলেও এ ধরণের বিয়েকে অনেকে কিছুটা হেয় চোখেই দেখে থাকে। সম্ভবত নজরুল ও সেই মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেন নি। এমন ও হতে পারে নজরুলকে তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কেউ হাসি-মসকরা করেছিলো যা তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং যা তিনিই কখনোই ভুলতে পারেন নি।
তবে মায়ের সাথে নজরুলের ঝগড়া এবং অভিমানের কারণ জানা না গেলেও অনুমান করা শক্ত নয় যে, মায়ের কোনো আচরণের নজরুল একটা প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যার দরুন আর কোনো দিন চুরুলিয়া ফিরে যেতে রাজি হননি। এমন কি ১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও নজরুল গ্রামের বাড়িতে যাননি। শেষবারের মতো মায়ের মুখ খানি দেখেন নি। অবশেষে এক বুক কষ্ট নিয়ে জাহেদা খাতুন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। মা জাহেদা খাতুন পুত্র নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য অন্তিম বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। জাহেদা খাতুনের মাতৃ হৃদয়ের এই অতৃপ্ত হাহাকার কি নজরুল জীবনে কোনই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি? কে জানে নজরুলের ৩৪ বছরের জীবন্ত-মৃত অবস্থার জন্যে তাঁর মায়ের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপই দায়ী কিনা। জীবদ্দশায় কবি কখনোই এ সম্পর্কে মুখ খোলেন নি। ফলে নজরুলের জীবনে এটি আজো অমীমাংসতি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে। অভিমান বশে মায়ের সাথে নজরুল সম্পর্ক ছিন্ন করলেও পরবর্তী সময়ে নজরুলের বুভূক্ষ মন কিন্তু সবর্দা কাঙ্গালের মতো কেঁদে ফিরেছে মাতৃস্নেহের সামান্যতম পরশ পাওয়ার জন্য। তাই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে কতিপয় মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে মা বলে সম্মোধন করেছেন। তাঁদেরকে কবি যেমন মায়ের মতোই অন্তর দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন। তেমনি তাঁরাও তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেছেন। নজরুলের মা সম্মোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দৌলতপুরের আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালাম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম.রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যতমা, নজরুল নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে যখন খাঁ পরিবারের সকলেই ছিলেন গররাজি তখন এই এখতারুন্নেসাই সকলের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুলের সঙ্গে নার্গিস আসার খানম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (বিয়ে নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে)। এই সময় এখতারুন্নেসা খানম মায়ের মতোই নজরুলের সকল আব্দার পূরণ করতেন। এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলেেক তিনি এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, ভাইদের কাছে প্রাপ্য তিনি তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি নজরুলের নামে লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
বহু নারীর মাতৃস্নেহ আদর, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন কবি। এমনি ধরণের আরেক অগ্নি কন্যা হেম প্রভাবকে নজরুল “মা” বলে ডাকতেন। এই হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি রচনা করেন “হৈমপ্রভা” কবিতাটি। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কবি এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে ১৯২৬ সালে রচনা করেন হৈমপ্রভা কবিতাটি।
কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলো আলোক জননী।
প্রভায় তোর উদিল প্রভাত
হেম-প্রভ হল ধরণী ॥
এসো বাংলার চাঁদ সুলতানা
বীর মাতা বীর জায়া গো।
তোমাতে পড়েছে সকল কালের
বীর নারীদের ছায়াগো ॥
শিব সাথে সতী শিবানী সাজিয়া
ফিরছি শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব বাঙালীর
কাটুক আঁধার রজনী ॥
(সংক্ষেপিত)
প্রমিলা নজরুলের বিয়ে হয ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল, তাঁদের যখন বিয়ে হয় তখন প্রমীলার বয়স ১৪ আর নজরুলের ২৩। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার ঐতিহ্য বাহী তেওতা গ্রামে প্রমীলা সেন গুপ্তার জন্ম। পিতার নাম বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত। নজরুলের শ্বাশুড়ীর নাম গিরিবালা দিবী। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মনের মেয়ে। নজরুল তাঁর নিজের শ্বাশুড়ীর গিরিবালাদেবী কে কোন দিন মা বলে ডাকেন নি। তাঁকে ডাকতেন মাসিমা বলে। তিনি নজরুলকে সম্মোধন করতেন নুরু বলে। শ্রীযুক্ত গিরিরবালা দেবী তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেন গুপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন এবং একটি মাত্র সন্তান প্রমীলা জন্মাবার পরেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেন গুপ্তের প্রথমা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থাতেই তিনি গিরিবালা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। গিরিবালা দেবীর ‘জা’ ছিলেন বিরজা সুন্দরা দেবী।
প্রমীলার জ্যেঠী বিরজা সুন্দরী দেবীকে যে নজরুল ‘মা’ বলে সম্মোধন করতেন সে কথা তো সকলেরই জানা। তিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ৩৯ দিনের অনশন ভঙ্গ করিয়ে ছিলেন। সেদিন নজরুলের অনশন ভাঙ্গিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশে বিরজা সুন্দরী দেবী বলেছিলেন- “খাইয়েছি পাগলকে, কথা কি শোনে। বলে না, অন্যায় আমি সইব না” শেষ পযর্ন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি ‘মা’। মার আদেশ সব ন্যায় অন্যায় বোধের ওপরে। লেবুর রস খাইয়ে এসেছি।” ১৯২৬ সালের অক্টোম্বর মাসে প্রকাশিত হয় কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “সর্বহারা”। কবি এই গ্রন্থটি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতাটিতে নজরুল লিখেন-
“মা (বিরজা সুন্দরী দেবী)র শ্রী চরণার বিন্দে”
সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।
তুমি কোন দিন কারো করনি বিচার।
কারেও দাওনি দোষ, ব্যথা বারিধির
কুলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর।
হয়তো ভুলেছো মাগো, কোন একদিন,
এমনি চলিতে পথে মরু-বেদুইন।
শিশু এক এসেছিল, শ্রান্ত কন্ঠে তাঁর
বলেছিল গলা ধরে “মা হবে আমার?”
বিরজা সুন্দরী দেবী সপরিবারে কলকাতা চলে আসার পর কবি নিয়মিত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এই মহিয়সী নারী দেহ ত্যাগ করেন। নজরুল এ সময় তাঁর শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন।
বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে পরিবারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়, সে পরিবারের কর্ত্রী সুনীতি বালাকেও কবি মায়ের আসনে রাখেন। নজরুল জীবনে সাহিত্য যেমন ছিলো। ঠিক তেমনটি ছিল নারীর অবদান। কবি তাঁর সুখ-দুঃখ অভিমান মুখে প্রকাশ না করে সাহিত্যের মাঝে তুলে ধরেছেন। মায়েদের নিয়ে লিখেছেন একের পর এক কবিতা। এই কবির সাহিত্য মানেই নারীর অবদান। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
হুগলীর এক মহিয়সী নারী বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা এবং লেখিকা মিসেস এম. রহমান কেও নজরুল অপরিসীম শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। তাঁকেও মা বলে ডাকতেন। তাঁর প্রকৃত নাম মোছাম্মদ মাসুদা খাতুন। জন্ম ১৮৮৪ সালে। হুগলির সরকারি উকিল খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম. রহমান নজরুর ইসলামকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাঁর স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহ্যিতিক মুজিবর রহমান। সেকালে যা ছিল অস্বাভাবিক চিন্তা হিন্দু মেয়ে প্রমিলা ও মুসলমান ছেলে নজরুলের মধ্যে বিয়ে। বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে নজরুল প্রমীলার ক্ষেত্রে তিনি তাই বাস্তাবায়ন করেন। কলকাতায় নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়ের পর নব দম্পত্তির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলিতে নজরুলকে বাসা ভাড়া করে দেন। এই বিদুষী মহিলা ১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন “মিসেস এম. রহমান” নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবিতাটির শেষ পদের ৬টি চরণ এখানে তুলে ধরা হলো :-
তোমার মমতা মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,
তুমি লাঞ্চিতা বিশ্ব-জননী! তোমার আঁচল পাতা।
নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে, বিষ শুধু তোমা দহে,
ফনা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে।
আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,
সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে।
এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে যেনো মাতৃ শোকে বিহ্বল কবির কান্না উথলে উঠেছে। এই সময় নজরুল ইসলাম সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুউদ্দীন কে একটি পত্রে লিখেছিলেন মা’র  (মিসেস এম. রহমান) মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমার সব কিছু গুলিয়ে গেলো। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিলো। আপন পেটের ছেলে চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন আমায়। আমি তার প্রতিদানে কিছুই দিতে পারি নাই। আমি আজ দেউলিয়া যেনো জীবনের জোয়ার-ভাটা দেখছি শুধু।
এখানে উল্লেখ্য নজরুল যখন একজন পাতানো মায়ের মৃত্যুতে শোকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন তখন গর্ভধারিনী মায়ের কোনো খোঁজ খবর রাখার ও প্রয়োজন মনে করছেন না। এই সময়ে কবির নিজের ‘মা’ জীবিত ছিলেন। নজরুলের ‘মা’ জাহেদা খাতুন মারা যান ১৯২৮ সালের ৩০ মে।
এই সময় আরেক জন মহিয়সী নারী কে তিনি প্রাণ ভরে ‘মা’ বলে সম্মোধন করতেন। তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মীনি বাসন্তী দেবী। তিনি ও তাঁকে সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (জন্ম ১৮৭০ খ্রি. মৃত্যু ১৬ জুন ১৯২৫ খ্রি.) বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন।
দেশ বন্ধুর মৃত্যুর পরে কবির নজরুল শোকগাঁথা মূলক যে চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন সেটি ও উৎসর্গ করেছিলেন বাসন্তী দেবীর নামে “ইন্দ্র পতন” কবিতায় নজরুল চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুকে স্মরণ করে লিখেলেনঃÑ
জন্মিলে তুমি মোহাম্মদের আগে, হে পুরুষ বর!
কোরাণে ঘোষিত তোমার মহিমা, হতে পয়গাম্বর!
যে জ্যোতি পারেনি সহিতে স্বয়ং মুসা ও কোহ-ই তুরে,
সেই জ্যোতিঃ তুমি রেখেছিলে তব নয়ন মণিতে পুরে।
(সংক্ষেপিত)
যাই হোক, আমরা দেখতে পাচ্ছি মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে, যিনি গ্রামের বাড়িতে যাননি, তিনিই আবার পাতানো মায়ের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন।
অদ্ভুদ রহস্য ভরা এই মানুষের মন। খেয়ালী কবি নজরুলের খাম খেয়ালী তো আর কম ছিলনা। কে জানে মায়ের সাথে বিরোধ জিইয়ে রেখে মাকে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়ে অন্য মহিলাদের প্রাণ ভরে ‘মা’ ডেকে তাঁর বুভূক্ষ হৃদয়ের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা মেটানোর বিষয়টিও তেমনি খেয়ালীপনা ছিল কিনা।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথাই প্রমানিত হয় যে, চির ক্ষুদ্ধ, চির অভিমানী খেয়ালী নজরুল নিজের মায়ের থেকে দূরে সরে গিয়ে মাতৃস্নেহ পাবার জন্যে উন্মাদের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন এবং যার কাছেই সে স্নেহটুকু পেয়েছেন তাঁকেই হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রবল আবেগে আকঁড় ধরেছেন। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও এই পাতানো নকল মায়েরা কি মাতৃস্নেহের কাঙাল কবির মায়ের অভাব সবটুকু পূরণ করতে পেরেছেন কি?
তথ্য সূত্র :-
১। কবি নজরুল বিচিত্র পথের পথিক : সম্পাদিত আফরিনা হোসেন রিমু
২। নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম : ডঃ আবুল আজাদ
৩। নজরুল জীবনের ট্র্যাজেডি : শেখ মুহম্মদ নূরল ইসলাম
৪। নজরুল প্রতিভার নানা দিগন্ত : আফতাব চৌধুরী
৫। নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় : সুফী জুলফিকার হায়দার
৬। নজরুল ও নাসির উদ্দীন (স্মারক গ্রন্থ) : সম্পাদিত মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ।
লেখক : কলামিষ্ট, সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ