শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

কৃত্রিমভাবে ঋণখেলাপি কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা সুফল বয়ে আনবে না

এম এ খালেক : বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তবে ব্যাংকিং সেক্টরকে অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল স্থান হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা বলেছে, ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমানে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই মূল্যায়ন দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সাম্প্রতিক সমালোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছে। সংশ্লিষ্ট মহল নতুন করে ব্যাংকিং সেক্টরকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। এদিকে নতুন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর এক সভায় বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর বাড়বে না। তার এই মন্তব্যের পর ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কিছু আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই আইনি সংস্কারগুলো কার্যকর হলে এই সেক্টরের ঋণ খেলাপিরাই উপকৃত হবেন এবং সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টর মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। প্রস্তাবিত আইনি সংস্কারগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে আগামীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। যেসব আইনি সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর পরিবর্তে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো। আমরা কেনো যেনো সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছি। বর্তমান সময়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ঋণ খেলাপি কালচার। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা ব্যাংকের দুরবস্থার জন্য দায়ি বলে মনে করা যেতে পারে। স্মর্তব্য, খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হবার পর তা নিয়ে হৈচৈ করার চেয়ে খেলাপি ঋণ যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করাই বেশি প্রয়োজন। কারণ বাঁধের উজানে কেউ পানি ঘোলা করলে ভাটিতে সেই ঘোলা পানিই প্রবাহিত হবে। তাই উজানে কেউ যাতে পানি ঘোলা করতে না পারে সেই ব্যবস্থাটিই আগে করা দরকার। ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে না আসা, প্রভিশন ঘাটতি, বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের স্বল্পতা ইত্যাদি অনেক সমস্যার জন্য মূলত খেলাপি ঋণই দায়ি। খেলাপি ঋণ কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে সৃষ্টি হয় না। নানা কারণেই খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাগণ যদি তাদের কর্তব্য পালনে সৎ এবং দায়িত্বশীল হন এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেন তাহলে খেলাপি ঋণের প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে। 

খেলাপি ঋণ কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। যে কোনো দেশের ব্যাংকিং সেক্টরেই খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হতে পারে। তবে তার একটি গ্রহণযোগ্য বা সহনীয় মাত্রা আছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের উচ্চ উপস্থিতি যে কোনো কারণেই মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। ঋণের কিস্তি আদায় না করেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর একটি পন্থা হচ্ছে ঋণ হিসাব অবলোপন করা। ঋণ হিসাব অবলোপন কথাটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মনে এক ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হয় যে, ব্যাংক সম্ভবত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট পাওনা ঋণের দাবি ত্যাগ করেছে। কিন্তু আসলে বিষয়টি তা নয়। ঋণ হিসাব অবলোপনের অর্থ ঋণের দাবি ত্যাগ করা বা ঋণ মওকুফ করা নয়। বিষয়টি আসলে সত্য লুকিয়ে রাখার মতো। ঋণ হিসাব অবলোপনকে আমরা অপ্রদর্শিত ঋণ বলতে পারি, যদিও ব্যাংকিং আইন বা অর্থনীতির পরিভাষায় অপ্রদর্শিত ঋণ বলে কোনো শব্দ নেই। ঋণ হিসাব অবলোপনের অর্থ হচ্ছে খেলাপি ঋণের একটি অংশকে ব্যাংকের মূল লেজার থেকে অন্যত্র সরিয়ে রাখা। এটি সেই ব্যক্তির মতো যার তিনটি সন্তানের মধ্যে দু’জন সুস্থ্য-স্বাভাবিক এবং একজন শারিরিকভাবে প্রতিবন্ধি। বাড়িতে কোনো আত্মীয়-স্বজন এলে সুস্থ ছেলেদের তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শারিরিকভাবে অসুস্থ্য ছেলেকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখেন লোকলজ্জার ভয়ে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে তৃতীয় সন্তান অর্থাৎ শারিরিকভাবে অসুস্থ ছেলেটি অস্তিত্ববিহীন হয়ে যায়। সে অস্তিত্ববান কিন্তু প্রদর্শিত নয়। শারিরিকভাবে অসুস্থ ছেলের জন্য তার অভিভাবককে অন্য দুই ছেলের চেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়। অবলোপনকৃত ঋণাঙ্কও ঠিক তেমনি। অবলোপনকৃত ঋণ অর্থ ঋণের দাবি ত্যাগ করা নয়। কিন্তু কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করা হলে সেই হিসাব থেকে ঋণ আদায় কার্যক্রম কিছুটা হলেও শিথিল হয়ে পড়ে। 

কয়েক মাস আগের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এটা প্রদর্শিত খেলাপি ঋণ। একই সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরের অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে মন্দ ঋণ। মন্দ ঋণকে লোকসান বা লস্ বলা হয়। কারণ মন্দ ঋণ ভবিষ্যতে আদায় হবে না বলেই ব্যাংক ধরে নেয়। তাই মন্দ ঋণ হিসাব থেকে কোনো কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফা খাতে যোগ হয়। ঋণ হিসাব অবলোপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যাংকের মূল লেজারকে ‘ক্লিন’ দেখানো। ‘আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর বাড়বে না’ নতুন অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কৃত্রিমভাবে হলেও খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর তৎপরতায় নিয়োজিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইস্যুকৃত এক সার্কুলারের মাধ্যমে ঋণ হিসাব অবলোপনের বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধন এবং সজীকরণ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ঋণ হিসাব অবলোপনের জন্য যে নীতিমালা অনুসরণ করতো সেখানে কোনো ঋণ হিসাব মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের পূর্বক তা অবলোপন করা যেতো। যে ঋণ হিসাব অবলোপন করা হতো তার বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হতো। কিন্তু সংশোধিত নতুন আইনে মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবার পর ৩ বছর অতিক্রান্ত হলেই সেই ঋণ হিসাবকে অবলোপন করা যাবে। অবলোপনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবধারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের শর্তেও ছাড় দেয়া হয়েছে। ফলে আগামীতে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণ হিসাব অবলোপনের হিড়িক পড়ে যেতে পারে। 

প্রচলিত ব্যাংকিং আইনে আরো কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে যা কার্যকর হলে মূলত ঋণ খেলাপিরাই উপকৃত হবেন। যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে আসছেন তারা হতাশ হবেন। আর এসবই করা হচ্ছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর জন্য। ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের শর্ত শিথিল করা হচ্ছে। আগে কোনো ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করতে হলে মোট পাওনা ঋণের ১০ শতাংশ অথবা খেলাপি ঋণের ১৫ শতাংশ এককালিন ব্যাংকে নগদে জমা দিতে হতো। সংশোধিত আইনে এই জমার পরিমাণ ২ শতাংশ করা হচ্ছে। আগে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য একটি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করা যেতো। সংশোধিত আইনে এই সময়সীমা ১২ বছর করা হচ্ছে। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের উপর ৭ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ হারে সুদারোপিত হবে। যেসব ভালো ঋণ খেলাপি তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করবেন তাদের ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ সুদ প্রযোজ্য হবে এবং যারা মন্দ ঋণ খেলাপি তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করা হলে আরোপিত সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হলো, কে ভালো ঋণ খেলাপি এবং কে মন্দ বা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তা নির্ধারিত হবে কিভাবে? একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাও পরিবর্তন করা হবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে প্রচলিত আইনে কোনো ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিন মাস বা ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলে তাকে নি¤œমানের ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত হয়। এই সময়সীমা ১৮০ দিনে নির্ধারণ করা হবে। একই ভাবে কোনো ঋণ হিসাব থেকে নির্ধারিত সময়ের ১৮০ দিন পর্যন্ত কিস্তি আদায় না হলে তাকে সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। সংশোধিত আইনে এটা ৩৬০ দিন করা হবে। ৩৬০ দিন বা এক বছর অতিক্রান্ত হলে তাকে মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল। এখন তাকে ৭২০ দিন করা হবে বলে জানা গেছে। 

এসব আইনি সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে হঠাৎ করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু এই কমাটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ ঋণের বকেয়া কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো না গেলে তা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য কোনোভাবেই শুভ ফল বয়ে আনবে না।     

কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং খেলাপি ঋণ যাতে সৃষ্টি না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরের দুরবস্থার জন্য আমরা নানা জনকে দায়ি করে থাকি। কিন্তু ব্যাংকের অভ্যন্তরে বসে যারা দুর্নীতি করছে তাদের বিষয়ে আমরা কিছুই বলছি না। আমাদের সমাজটাই এমন যে, এখানে দুর্নীতি করলে সাধারণত শাস্তি পেতে হয় না। বরং দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে গেলে নানা ভাবে হয়রানি হতে হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তাকে ইচ্ছে করলেই চাকরিচ্যুৎ করা যায় না। তাই তারা চাইলে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে বা অনুকূলে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। একজন কর্মকর্তা যদি সৎ এবং সাহসী হন তাহলে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। দুর্নীতিবাজরা খুবই ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালি। কিন্তু তারা নৈতিকভাবে খুবই দুর্বল। তাই তাদের প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনি অঙ্গিকার ছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা। এটা করতে হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা সৎ এবং আন্তরিক কর্মকর্তা আছেন তাদেরকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো কর্মকর্তা যাতে পদোন্নতি বা অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ বন্ধ করার জন্য অবশ্যই কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। 

ব্যাংকিং সেক্টর অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি সেক্টর। তাই এই সেক্টরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আইনি পরিবর্তন সাধন করতে হলে ভেবে চিন্তেই তা করতে হবে। কথায় বলে, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” কোনো কারণে একবার ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয় সৃষ্টি হলে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না। তাই আমাদের সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

-অর্থনীতি বিষয়ক কলাম লেখক

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ