২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোর মান অভিমানের অবসান অচিরেই ঘটবে -বিএনপি
স্টাফ রিপোর্টার : ২০ দলীয় জোট থেকে বিজেপির বেরিয়ে যাওয়াকে ‘মান-অভিমান’ অভিহিত করে অচিরেই তার অবসান ঘটবে বলে জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল বুধবার সকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একথা জানান। তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে শরিক দলগুলোর মধ্যে যে মান অভিমান চলছে শীঘ্রই তার অবসান ঘটবে। এই জোট আরও শক্তিশালী ও বেগবান হবে।
নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অধ্যাপিকা শাহিদা রফিক, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, কেন্দ্রীয় নেতা মুনির হোসেন, মাহবুবুল হক নান্নু, খান রবিউল ইসলাম রবি ও শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেইন উপস্থিত ছিলেন।
রিজভী বলেন, চলমান রাজনীতির দুঃসময়ে একটা চলছে, এই দুঃসময়ে জোটের অন্তর্ভুক্ত অনেকের মধ্যে মান-অভিমান থাকতে পারে। সেটার নিরসন হয়ে যাবে। বিশেষ করে বড় দল বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং জোটের আরো যারা নেতৃবৃন্দ আছেন সবার পদক্ষেপে এগুলো থাকবে না। অচিরেই এই মান-অভিমান সেরে যাবে। ২০ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে যে কর্মসূচি বিভিন্ন পর্য়ায়ে করে যাচ্ছি সেটা অব্যাহত থাকবে- এ ব্যাপারে আপনারা নিসন্দেহ থাকতে পারেন।
২০ দলীয় জোটের ঐক্য সুদৃঢ় দাবি করে রিজভী বলেন, সরকারের নানা ধরনের ইয়ে থাকতে পারে, খেলা-ধূলো থাকতে পারে। কিন্তু যারা দীর্ঘ এই দশ বছর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, গণতন্ত্রের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিল করেছেন তাদের মধ্যে ভাঙ্গন আসবে না। যত নিষ্ঠুর নির্বাচন হবে ততই ঐক্য আরো অটুট হবে, আরো মজবুত হবে, ততই সিমেন্টেড হবে।
গত ৬ মে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ গণমাধ্যমের কাছে ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। এছাড়া মঙ্গলবার জোট ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছে লেবার পার্টি। ২০ দলীয় জোট ছাড়ার কারণ হিসেবে পার্থ বলেছিলেন, হ্যাঁ আমরা জোট ছেড়ে দিয়েছি। এটার কারণ তিনটি। বিএনপি অতিমাত্রায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টমুখী হয়ে গেছে। ২০ দলীয় জোটের কর্মকান্ড শুধু সহমত, সংহতি ছাড়া তেমন কিছুই নয়। প্রহসন ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর সংসদে যাওয়াটাকে নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি বলে মনে করেন বিজেপি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সংসদে বিএনপি যে যাবে এটা আমার দল শুধু নয়, জোটের কেউই জানে না। এ্সব কারনেই আমি জোট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের শরিক অন্যতম বিজেপি। প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর গঠিত বিজেপি বাবার মৃত্যুর পর এই দলের হাল ধরেন পার্থ।
রিজভী বলেন, রমযান মাস শিক্ষা দেয় সংযম-সৌহার্দ্য-সহনশীলতা-সহমর্মিতা। কিন্তু বাস্তবে সরকারের লোকজনের মাঝে তার কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সিয়াম সাধনার এই মাসে মানুষের চরম কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘবে মিডনাইট নির্বাচনের সরকারের যেন কোন দায়বদ্ধতা নেই। উদাসীন ভ্রূক্ষেপহীন তারা। রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ক্রেতারা। মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। স্বল্প আয়ের মানুষ রমজানে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন রমযানে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়বে না। অথচ রমজানের শুরুতেই বাজার অস্থির।
রিজভী বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়বে না ঘোষনার পরদিন থেকেই হু হু করে দাম বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের। বিভিন্ন পন্যের দাম বেড়েছে গড়ে তিন থেকে চারগুণ। অন্যদিকে বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্যের বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ন্ত্রন না করে প্রমান করেছেন নাগরিক সেবায় তারা ব্যর্থ। নিত্যপণ্যের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিক কারণ না থাকার পরেও দ্রব্য মূল্য ঊর্ধ্বমুখী, যে কারণে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। তাদের আয়ের পুরোটাই চলে যাচ্ছে চাল, ডাল, শাক-সবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে। তা নিয়ে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা বাগাড়ম্বর করে চলেছেন। বাজারে সরকারের কোন নজরদারি নেই। তাদের নজর লুটপাটে।
তিনি বলেন, রোজার মাসের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গরু ও খাসির গোস্তের দাম কেজি প্রতি যথাক্রমে ৫২৫ ও ৭৫০ টাকায় বেঁধে দিয়েছে। তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গরুর গোস্ত প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ এবং খাসির গোস্ত ৮০০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা এর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত খাজনা ও সরকারী লোকজনের চাঁদা আদায়কে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, পশুর হাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে প্রতি কেজি মাংস ৩০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। এই চাঁদাবাজির অর্থ যাচ্ছে সরকারের ওপর মহলে। আওয়ামী সিন্ডিকেট পবিত্র রমজান মাস এলেই দ্রব্যমুল্য বাড়িয়ে মানুষকে জিম্মি করে ফেলে। সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। লুটপাটতন্ত্র সর্বত্র জেঁকে বসেছে। সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের কোনো দায় নেই। সরকার জিম্মি অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে। বাজারের দুষ্টুচক্র সিন্ডিকেট এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ বাজারের নিয়ন্ত্রকরাই এখন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। গণতন্ত্র ধরাছোঁয়ার বাইরে, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ শেষে এখন ভাতের অধিকার এবং ন্যায় বিচারের অধিকার কেড়ে নিতে তৎপর সরকার।
বাজারে রোজার মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির গতির কোন স্পীড লিমিট নেই। রোজার প্রথম দিন কেজি প্রতি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। যা আগের দিন ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কাঁচা পেঁপে ৬০ টাকা, পটল ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৪৫ টাকা, শসা ৪০ থেকে ৫০ টাকা, টমেটো ৩০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৩৫ টাকা, আদা ১১০ টাকা, রসুন ১১০ টাকাসহ আলু ১৯ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলের বাজারও টালমাটাল। সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়েছে ছোলা, চিনি, তেল, আটা, ময়দা, বেসন, মুড়ি, চিড়া, গুড় ও আটার।
বিএনপির এই নেতা বলেন, কোন কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। বাজার দরের মতোই সরকারের ভেতর চলছে অস্থিরতা। সরকারের সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতির কারণেই দারিদ্রের দুষ্টুচক্রে নিষ্পিষ্ট জনগণ। গণতন্ত্রহীনতা ও দারিদ্রের কারণে প্রান্তিক মানুষগুলোর অধিকার বৃদ্ধির সুযোগ ক্রমাগত নি:শেষিত হচ্ছে।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতিশীল অভিযোগ করে রিজভী বলেন, দেশে গুম, রহস্যময় অন্তর্ধান, খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যা ও অনাচারের হিড়িক চলছে। প্রতিদিন নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে গড়ে ২০ জনের অধিক। প্রতিদিন গড়ে খুনের ঘটনা ঘটছে ১৫ থেকে ২০ জনের অধিক। গার্মেন্টস শিল্পে প্রতিদিন গড়ে ৪ জনের মধ্যে ১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। চলন্ত গাড়ি, বাসাবাড়ী, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিস কোথাও নারী নির্যাতন থেমে নেই। দিনের পর দিন বিচার বহির্ভূত হত্যার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক রোগীর মতো মানুষ খুনের নেশায় পেয়ে বসেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে। পত্রিকার পাতা খুললেই বিচার বহির্ভূত হত্যার হিড়িক দেখা যায়। এই সরকারের আমলে নারী-শিশু নির্যাতন অতিতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের উন্নয়নের জয়োল্লাসের মধ্যে এত হিংসার ছবি কেন ? এটি আজ জনগণের প্রশ্ন। দেশের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে কেন এত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ? বাবা মা তাদের সন্তানদের নিয়ে দু:স্বপ্নে দিন কাটাচ্ছে। কন্যা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে অস্থির বাবা মা। সুশাসনের চাবিকাঠি বর্তমান নিষ্ঠুর দু:শাসনের কাছে জিম্মি বলেই সারাদেশে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সরকারের পক্ষভুক্ত হওয়ায় জনগণকে তারা প্রতিপক্ষ করে তুলেছে। প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে সমাজে কোনক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নেই। সামাজিক নিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়েছে, কারণ দূর্বৃত্ত অনাচারকারীরা ক্ষমতাসীনদের আনুকুল্য পাচ্ছে এবং সেইজন্য আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। অনাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তাকে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে হয়। নয়তো ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে তার স্থান হয় কারাগারে।
সরকারের উদ্দেশ্যে রিজভী বলেন, সব ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ এই মিডনাইট নির্বাচনের অন্ধকারের সরকারকে বলবো-দ্রুত পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। দেশের জনগণের ঘাড়ে জোর করে চেপে থেকে আর কষ্ট দিবেন না। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন। গুরুতর অসুস্থ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সুচিকিৎসা না পেয়ে দু:সহ যাতনা ভোগ করছেন। তাকে মুক্তি দিলে তিনি তাঁর পছন্দমতো বিশেষায়িত হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পারবেন। ভালোভাবে রোজা পালন করতে পারবেন। আদালতকে কুক্ষিগত করে রেখে তার জামিনে পদে পদে বাধা দেয়া বন্ধ করুন। জামিনে হস্তক্ষেপ বন্ধ করুন।
রিজভী বলন, বিজেএমসি নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন জুট মিলে পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের জন্য ধর্মঘট চলছে। ২০১৫ সালের মুজুরী কমিশন রোয়েদাদ এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাটকলগুলিতে শ্রমিকদের ১০ থেকে ১৫ সপ্তাহের মজুরি বাকী। অথচ রমজান মাস শুরু হয়েছে। এ মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্য কেনার সামর্থ তাদের নেই। স্টাফদের তিন মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থের প্রতি সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং তাদের ওপর শোষণের মাত্রা আরও তীব্র হয়েছে। আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র পক্ষ থেকে পাটকল শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবিগুলি মেনে নেয়ার জোর আহবান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন এদেশের মানুষের দু:খ-দূর্দশা শোচনীয় পর্যায়ে উপনীত হবে। এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলো হবে আরও ভয়াবহ। সরকার যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক, সে চায় ‘নির্বাক জনগোষ্ঠী’। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষ আর নির্বাক বসে থাকবে না। যেকোন মূহুর্তে ক্ষমতার ‘গণেশ উল্টে’ যাবে।