শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ধর্ষণ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে : ইমমিউনিটির কালচার অবিলম্বে বন্ধ হোক

বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স হলো এই যে, ২৯ ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতি এবং ৩০ ডিসেম্বর সেই অসমাপ্ত ডাকাতিকে সম্পন্ন করার অপকর্মের বিরুদ্ধে যেখানে রাজনৈতিক দল, সুধী সমাজ এবং মিডিয়ার সোচ্চার থাকার কথা, সেখানে প্রধান বিরোধী দলকে নিয়ে একশ্রেণির মিডিয়া এবং এক শ্রেণির সুধী সমাজের পোস্টমর্টেম শুরু হয়েছে। শুধু ভোট ডাকাতিই নয়, তার পরবর্তী ৪ মাসে দেশে যে চরম অপশাসন, জুলুম এবং নৈরাজ্য শুরু হয়েছে সেগুলো নিয়েও মিডিয়া এবং সুধী সমাজকে সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না। সেগুলো না করে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিএনপির ৫ জন সংসদ সদস্যের শপথ গ্রহণ, ২০ দলীয় জোট থেকে ক্ষুদ্র একটি শরীকের বেরিয়ে যাওয়া এবং আর একটি ক্ষুদ্র শরীকের বেরিয়ে যাওয়ার আল্টিমেটাম নিয়ে মাতামাতি করা।
অবশ্য এজন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টও দায়ী। ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে তারা যেমন কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হয়েছে তেমনি পরবর্তী ৪ মাসের অপশাসনের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেয়া বা পদক্ষেপ গ্রহণেও তারা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মিডিয়া শাসক গোষ্ঠীর কবলে বাধা পড়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থায় এগুলোই হয়। কিন্তু বিরোধী দলের কাজ হলো জনগণের পায়ে শিকল পরানোর সরকারি অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা। প্রধান বিরোধী দল ও জোটের এই গর্জে ওঠার পরিবর্তে তারা যদি মাঝে মাঝে প্রেস কনফারেন্সে একটি বিবৃতি এবং প্রেস ক্লাবে দুই একটি গোল টেবিল বৈঠক বা সেমিনারে দু’চার কথা বলে তাদের কর্তব্য শেষ হয়েছে বলে মনে করেন তাহলে এখন বিরোধী দলের যে করুণ পরিণতি দেখা যাচ্ছে সেটি অব্যাহত থাকবে।
দেশে ক্রাইম এবং ধর্ষণ যেভাবে মহামারির মতো বিস্তার লাভ করছে তার বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলা যেতো। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যারা রাস্তা ঘাটে চলি, বাসে উঠি বা অল্প দামের রেস্টুরেন্টে বসি, তারা মানুষের কথাবার্তা শুনি এবং শুনে বুঝতে পারি, মানুষ তাতিয়ে আছে। যদি ডাকার মতো ডাক দেয়া যায় তাহলে হ্যামিলনের বংশীবাদকের পেছনে মানুষ যেভাবে ছুটে ছিল এখনও মানুষ বিরোধী দলের ডাকের পেছনে ছুটবে। দেশে বিরাজমান অপশাসন এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এখন বিএনপি বা দক্ষিণপন্থী দলগুলো যতনা সোচ্চার তার চেয়ে বেশি উচ্চকিত আওয়াজ হলো বামপন্থীদের। তাদের সেই সব আওয়াজকে লুফে নিয়ে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামতে পারতো। ধর্ষণের চেয়ে জঘন্য অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। এখন দেখা যাচ্ছে, ধর্ষকরা শুধু মাত্র ধর্ষণ করেই তাদের লালসা চরিতার্থ করছে না, ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে হত্যাও করছে। ইবনে সিনা হাসপাতালের নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়ার ঘটনাটি এর জ¦লন্ত উদাহরণ। এব্যাপারে বামপন্থীরা যে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপি বা ডানপন্থীদের মুখে সেই কঠোর প্রতিক্রিয়ার আওয়াজ শোনা গেলো না।
গত ১০ মে শুক্রবার শাহবাগ মোড়ে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে বামপন্থী নেতা কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সরাসরি বলেছেন যে, তানিয়াকে যারা ধর্ষণ করেছে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করেছে তারা এবং অন্যান্য ধর্ষণের ঘটনার ক্রিমিনালরা সরকারি দল, প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শেল্টার পাচ্ছে। তারা শাহিনুর আক্তার তানিয়ার ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি দাবি করে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’, এই শিরোনামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এই বিক্ষোভের আয়োজন করে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে সিপিবির প্রেসিডেন্ট মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে আজ একটি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে আজ নারী এবং শিশুরা নিরাপরাধ নয়। তাদের কাউকে কাউকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, এই ধরনের ভয়াবহ কাজ তথা কথিত সিভিল সোসাইটিরও গা সওয়া হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ধর্ষকদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো মাদরাসার ছাত্রী নুসরাতের হত্যাকাণ্ড। সিপিবি নেতা বলেন, এসব ভয়াবহ ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ এবং পুলিশকে নারী নির্যাতন এবং যৌন হেনস্থার লাইসেন্স দেয়া যায় না। এসব অপরাধ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহবান জানান। নাগরিক সংহতির নেতা শরীফুজ্জামান শরীফ অভিযোগ করেন যে, এসব হত্যা ও ধর্ষণের বিচারে সরকার আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। কারণ তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঐসব ক্রিমিনালদেরকে সরকার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।
॥দুই॥
শুধু ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকার যদি সিরিয়াস হতো তাহলে নির্বাচনের পর পরই নোয়াখালীর সুবর্ণচরে যে গণধর্ষণ হয়েছে তার ঠিক ৩ মাস পর সেই একই নোয়াখালীর একই সুবর্ণচরে আরেক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করার ঘটনা ঘটতো না। প্রথম ঘটনার যিনি ছিলেন ভিক্টিম তিনি হলেন ৪ সন্তানের জননী। আর দ্বিতীয় ঘটনায় যিনি হলেন ভিক্টিম তিনি হলেন ৬ সন্তানের জননী। ইংরেজি ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক যারা ধর্ষক অর্থাৎ অপরাধী, উভয় ক্ষেত্রেই তারা শাসক দল আওয়ামী লীগ করে। প্রথম ক্ষেত্রে অর্থাৎ ৪ সন্তানের জননীর ক্ষেত্রে ‘অপরাধটি ছিল’ এই যে ঐ নারীটি গত নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছিল। আর সেই অপরাধেই নৌকার প্রার্থীর গুন্ডা পান্ডারা সেই গৃহবধুকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পূর্বে তারা গভীর রাতে তার গৃহে প্রবেশ করে, তার স্বামীকে মারধর করে এবং বেঁধে রাখে। অতঃপর গৃহবধূকে টেনে হিঁচড়ে নিকটস্থ শস্য ক্ষেতে নিয়ে যায় এবং নির্বিচার গণধর্ষণ করে।
দ্বিতীয় ঘটনাটিও প্রথম ঘটনাটির মতই জঘন্য এবং বর্বর। এটি ঘটেছে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ডেইলি স্টারের লেখা থেকে জানা যায় যে, সেখানে উপজেলা নির্বাচনের সময় ভাইস চেয়ারম্যান পদে যে দুই ব্যক্তি নির্বাচন করে তারা দুজনেই ছিল আওয়ামী লীগার। আলোচ্য ৬ সন্তানের জননী একজন আওয়ামী লীগারকে ভোট দেয়। এর ফলে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অপর আওয়ামী লীগার হিংস্র হয়ে ওঠে। তার গুন্ডা পান্ডারা ৪ সন্তানের জননীর মতোই ৬ সন্তানের জননীকে ঘর থেকে বের করে এনে গণধর্ষণ করে। দেখা যাচ্ছে যে, এই উভয় ক্ষেত্রেই গণধর্ষণকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এই সরকার নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে খুব গলাবাজি করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে সেটি তাদের সেই গলাবাজির সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই যদি না হবে তাহলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তাদের দলের নেতারা ধর্ষণ বা গণধর্ষণের আশ্রয় নেয় কীভাবে? আর সেই জঘন্য অপকর্মের পর, আজ ৪ মাস হয়ে গেল, কারো কোনো শাস্তি হলো না। তাহলে সরকার এই অপকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, এমন কথা আমরা বলবো না, কিন্তু এসব জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না, সেকথাটি বললে নিশ্চয়ই ভুল হবে না। এসব অপকর্ম সম্পর্কে উদাসীন থাকায় এসব অপরাধকে পরোক্ষভাবে প্রশয় দেয়া হচ্ছে বলে যদি কেউ বলেন তাহলে তাকে দোষ দেবো কীভাবে?
॥তিন॥
বাস্তবে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো এই যে ধর্ষণ বা গণধর্ষণকে যেনো এক প্রকার অপরাধ মুক্তি বা ইংরেজিতে immunity দেয়া হচ্ছে। ধর্ষণ বা গণধর্ষণ সম্পর্কে গত মাস খানেক ধরে অনেক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। আমি সাধারণত আমার লেখায় পরিসংখ্যান দিয়ে পাঠক ভাইদের ভারাক্রান্ত করিনা। তবে আজ এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাজি মোহিনী ইসলামের একটি পরিসংখ্যান না দিয়ে পারছি না। তাঁর পরিবেশিত তথ্য মোতাবেক গত ৮ দিনে ৪১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব শিশুর মধ্যে তিনটি হলো ছেলে শিশু আর ৩৮টি হলো কন্যা শিশু। পাঠক ভাই এবং সেই সাথে দেশবাসী ভেবে দেখুন, একটি জাতি কতখানি অধপতিত এবং পাশবিক হলে এমন ভয়ংকর কাজ ঘটতে পারে। এই সব ধর্ষক আর মানুষের পর্যায়ে নেই। তারা পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে। তাই তাদের সাথে পশুর মতোই আচরণ করতে হবে। কিন্তু এব্যাপারে সরকার বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এমন কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? সেজন্যই বলছি, সরকার এসব পাশবিক বলাৎকারের পেট্রোনেজ করছে, এমন কথা বলবো না। কিন্তু ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা দানবের মতো এদের বিরুদ্ধেও তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সেই বলাৎকারকে লাই দেয়া বা প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে।
নুসরাত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে তোলপাড় হয়ে গেল। একথা ঠিক যে কয়েক জন রেপিস্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢক্কানিনাদে বলা হচ্ছে যে ওসি মোয়াজ্জেমকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু শনিবার দৈনিক ‘প্রথম আলো’ থলির বিড়াল ফাঁস করেছে। নুসরাত জাহান হত্যাকাণ্ডে গঠিত তদন্ত কমিটি চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি ও অসদাচারণের প্রমাণ পেয়েছে। কমিটি ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এবং সোনাগাজি থানার দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। কিন্তু শুরু থেকেই যারা নুসরাত হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছিল সেই পুলিশ সুপার এবং এসআইদেরকে এখনো স্পর্শ করা হয়নি। অথচ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার খবর সকাল ১০টায় শুনলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা হন। পরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি তাকে নির্দেশ দিলে তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে ফেনী ফিরে আসেন। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ওসি ছাড়া ফেনী জেলা এবং ঐ থানার সমস্ত অফিসার নিজ নিজ দায়িত্বে কর্মরত আছেন। তাহলে এতবড় একটি প্রমাণিত অপরাধের পরেও অপরাধীগণকে কীভাবে আড়াল করা হচ্ছে?
সব কারণেই আমরা বার বার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিদেরকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে যতখানি সিরিয়াস সামাজিক অপরাধে যারা দাগি ও প্রমাণিত অপরাধী তাদেরকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে ততখানিই উদাসীন। তাহলে তো বলতেই হয়, Something is grossly wrong somewhere. ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। সরিষায় ভূত থাকলে সেই ভূত তাড়াবে কে?
Email: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ