শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

খুলনায় পানির জন্য হাহাকার

খুলনা অফিস : মহানগরীতে সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ২০১৩ সালে আড়াই হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প হাতে নেয় খুলনা ওয়াসা। প্রকল্পের আওতায় মধুমতি নদী থেকে পাইপলাইনে পানি এনে পরিশোধন (ট্রিটমেন্ট) করে তা খুলনা শহরে সরবরাহ করা হবে। ২০১৭ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দু’দফায় সময় বাড়ানোর পরও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি।
এদিকে গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহে মহানগরীতে সুপেয় পানির সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাসাবাড়িতে খাবার পানি নেই, রান্নার পানি নেই, নেই গোসলের পানি। পানির জন্য মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিভিন্ন স্থানে দিন-রাত পাম্প চালিয়েও ভূগর্ভস্থ পানি উঠছে না। এছাড়া অনেক এলাকায় ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকায় তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পানির এমন সঙ্কটে নগরবাসীর অসন্তোষ বাড়ছে। ওয়াসা বলছে, পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, খুলনা মহানগরীতে বর্তমানে প্রতিদিন পানির চাহিদা রয়েছে ১১ কোটি লিটার। চাহিদার মাত্র ৪০ ভাগ পানি খুলনা ওয়াসা সরবরাহ করে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার ৩৩ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় তাও সরবরাহ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত কয়েকদিন নগরীর সোনাডাঙ্গা, গোবরচাকা, শেখপাড়া, বসুপাড়া, ফারাজিপাড়া, মির্জাপুর রোড, বাইতিপাড়া, আহসান আহমেদ রোড, টুটপাড়া, বসুপাড়া, পশ্চিম বানিয়াখামার, বাবু খান রোড এলাকায় পানির ভয়াবহ সমস্যা রয়েছে। পানির জন্য প্রতিদিনই এসব এলাকার বাসিন্দাদের ছুটতে হচ্ছে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ জানান, ওয়াসার পুরাতন লাইনের সংযোগ শহরের অনেক স্থানে নেই। সেখানে ব্যক্তিগত নলকূপগুলোতেও পানি পাওয়া যায় না। ফলে নগরীতে পানির সঙ্কট বেড়েছে। তবে ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ আগামী জুন মাসে শেষ হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন গড়ে ১১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা যাবে।
তবে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষোভ রয়েছে নগরবাসীর। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ মোশাররফ হোসেন বলেন, ওয়াসার কাজে সড়কে খোঁড়াখুঁড়িতে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত হয়নি, আবার কাঙিক্ষত সুপেয় পানিও সরবরাহ করতে পারেনি। ২০১৭ সাল থেকে ওয়াসা নতুন পাইপলাইনে পানি দেওয়ার কথা বললেও অনেক গ্রাহকের বাড়িতে এখনো সংযোগ পর্যন্ত দিতে পারেনি।
ওয়াসার প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী এম ডি কামাল উদ্দিন আহম্মেদ জানান, কয়েকটি এলাকায় গ্রাহকরা নতুন করে আবেদন করায় তাদের বাড়িতে পাইপলাইনের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে মধুমতি নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে রূপসা শোধনাগারে পানি আনা হয়েছে। এই শোধনাগার থেকে রূপসা নদীর তলদেশ হয়ে খুলনা শহরের ৭টি রিজার্ভারে পানি আনা হবে। বর্তমানে এলাকাভিত্তিক ওয়াসার পানি সরবরাহ মিটার (ডিএমএ) বসানো হচ্ছে। আগামী মাসেই পরীক্ষামূলকভাবে গ্রাহককে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হবে। তিনি বলেন, ওয়াসার পুরানো পানির লাইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ড্রেন ক্রস’ করে যাওয়ায় ‘স্কেভেটর’ দিয়ে ময়লা পরিষ্কারের সময় অসচেতনতায় তা ফেটে যায়। এতে পানিতে দুর্গন্ধ ও ময়লা আসতে পারে। তবে এলাকাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করতে ওয়াসার কর্মীরা কাজ করছেন। নতুন পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করা হলে এ ধরনের সমস্যা থাকবে না।
এদিকে গত কয়েকদিন যাবত নগরীর পিটিআই, মিয়াপাড়া ও মৌলভীপাড়াসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসা-বাড়িতে খুলনা ওয়াসার সংযোগ লাইনে প্রচন্ড দুর্গন্ধ যুক্ত ময়লা পানি আসছে এমন অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক সেন্টিফিউগালে পানি উঠানো সম্ভব না। ফলে নগরবাসীর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীতে বসবাস করে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর পানির জন্য একমাত্র ভূ-গর্ভস্থ গভীর নলকূপ ও ওয়াসার সাপ্লাই পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। গরম মওসুমের শুরুতেই পিটিআই মোড়, টুটপাড়া ও মৌলভীপাড়া এলাকায় উৎপাদক নলকূপ চালুর পর পানির স্তর অনেক নিচেই নেমে যাচ্ছে। ফলে নগরীতে হাতচাপ টিউবওয়েল ও বাসা-বাড়িতে স্থাপিত সেন্টিফিউগাল পাম্পে চাহিদামতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে, কয়েকদিন যাবৎ ওই সব এলাকায় বাসা-বাড়িতে খুলনা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির সাথে ময়লা আসছে এবং সেই পানি প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর মৌলভীপাড়া, টুটপাড়ার বাহাদুর লেন, বানিয়াখামার এলাকায় সরবরাহকৃত পানিতে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে ওই পানি ব্যবহারে গ্রাহকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
টি বি বাউন্ডারী রোড়ের বাসিন্দা রাহাত রহমান বলেন, কয়েকদিন যাবত তাদের বাড়িতে ওয়াসার পানিতে ময়লা আসছে। পানিতে দুর্গন্ধও রয়েছে। ফলে পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
মৌলভীপাড়া ও মিয়াপাড়ার একাধিক বাসিন্দা জানান, সব মিলিয়ে তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত জন। বেশ কয়েকদিন ধরে পানি পাচ্ছে না তাদের পরিবার। তাই পানির চাহিদা মেটাতে পুরো পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া সরবরাহকৃত পানিতে পচা গন্ধ, অবিরাম ময়লা আসছে। ফলে দৈনন্দিন কাজ সারতে ভোগান্তি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী বিক্রম মজুমদার বলেন, বলেন, পাইপে কোথাও ছিদ্র হয়েছে। সেটি চেক করে শিগগিরই সমস্যার সমাধান করা হবে।
ভ্যাপসা গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ : বৈশাখের খরতাপে সকাল থেকেই শুরু হয় ভ্যাপসা গরম। সূর্যের তেজ বাড়লে দুপুরের দিকে প্রচণ্ড গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাপদাহে যেন পুড়তে থাকে চারপাশ। গরমের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। সেই সাথে রয়েছে পানির সঙ্কট।
তীব্র তাপদাহে এভাবেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বেড়েছে খেটে খাওয়া মানুষদের। গরমজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা।
আবহাওয়া অফিস বলছে, খুলনা বিভাগজুড়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপদাহ প্রবাহিত হচ্ছে। অসহনীয় এই অবস্থা থাকবে আরও কয়েকদিন। এরপর কালবৈশাখী ঝড়ে বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমবে।
খুলনার গোবরচাকা এলাকার বাসিন্দা সাইফুর রহমান জানান, পানির স্তর (লেয়ার) নিচে নেমে যাওয়ায় আশেপাশের কোনো টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। ওয়াসার কল থেকেও পানি পাওয়া যায় না। দিনে-রাতে কয়েকবার লোডশেডিং হয়। রোজায় গরম আর পানির সঙ্কটে মানুষ খুবই কষ্টে আছে।
এদিকে সবচেয়ে নাকাল অবস্থা খেটে খাওয়া মানুষদের। দুপুরের দিকে রিক্সাচালক ও শ্রমজীবী মানুষদের হাসফাস করতে দেখা যায়। অনেককে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। অফিস-আদালতে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ভোগান্তি বেড়েছে হাসপাতালের রোগীদের।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. অঞ্জন কুমার চক্রবর্তী জানান, প্রচণ্ড গরমে বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে গরমজনিত ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, বমিসহ নানা রোগে। গরমে হাসপাতালে রোগির চাপ বেড়েছে। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ছাতা নিয়ে বাইরে বের হওয়া ও বেশি করে বিশুদ্ধ পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ বলেন, বাতাসে জলীয়বাস্পের পরিমাণ বেশি থাকায় গরম অনুভব হচ্ছে বেশি। গেলো কয়েকদিনে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা আরও বাড়লে মাঝারি তাপপ্রবাহে স্থবির হয়ে পড়বে জনজীবন। তবে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ