বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রংপুরে বোরো ধান নিয়ে কৃষকের মাথায় হাত

মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, রংপুর অফিস : রংপুরের কৃষকদের মাথায় বাজ পড়েছে। যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।  চলতি মৌসুমে বোরো ধানের দাম নেই। উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারে ধানের দাম কম। তাই তঁদের এখন মাথায় হাত। এক মন ধান দিয়েও একজন মজুর পাওয়া যাচ্ছেনা। সামনে বড় উৎসব ঈদ।  মূল্য কম থাকায় ঈদকে ঘিরে কৃষকদের দীর্ঘশ্বাস দিন দিন ভারি হচ্ছে। বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকদের মোটা অংকের অর্থের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এর মুল কারণ মজুর সংকট সহ কৃষি শ্রমিকের মজুরী, সার , কীটনাশক ও সেচের মুল্য বৃদ্ধি । জমিতে ধান উৎপাদনে ব্যয়ের চেয়ে প্রাপ্ত ধানের বাজার মুল্য অনেক কম। সার্বিক এ পরিস্থিতির কারণে ধান উৎপাদনের লোকসানের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কৃষকের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনিতেই গত আমন মওসুমে এই অঞ্চলের কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। চলতি বোরো মওসুমে উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারে কম দামে ধান  বিক্রি হওয়ায় তাদের গোলার ধান গোলাতেই রয়ে গেছে। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড়দরগাহ ইউনিয়নের ডাসাড়পাড়া গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম দূঃখ করে জনালেন,। শ্রমিক সংকটের মধ্যেই ১ বিঘা জমির ধান ঘরে তুলেছেন । চলতি মওসুমে তাঁর ১ বিঘা জমিতে বোরো  চাষ করতে সার, বীজ, সেচ, জমির পরিচর্যা এবং মাড়াই মজুরী বাবদ ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার টাকা। ঐ কৃষক ১ বিঘা জমিতে ধান পেয়েছেন প্রায় ১৩ শ কেজি । বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ধানের মুল্য সর্বোচ্চ ১২ টাকা কেজি হিসেবে যার বাজার মুল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার  টাকা । ফলে ঐ কৃষকের ১ বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার টাকা । এই চিত্র জেলার প্রায় সর্বত্র। উৎপাদনের চেয়ে ধানের দাম কম হওয়ায় হতাশায় ভুগছে রংপুরের বোরো চাষীরা। বিশেষ করে যারা জমি বর্গা ও লিজ নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছে, তারা চোখে এখন অন্ধকার দেখছেন।  ধানের আশানুরূপ মূল্য না পেয়ে কৃষকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের কৃষক নিপেন্দ্র নাথ জানালেন, সমাজের সবাই ধানের ভাত খায়। কিন্তু  কেউ ভাবেনা এই ভাতের চাল উ্ৎপন্নে কৃষক কিভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। সরকার ধান উৎপাদন করলে বুঝতো এতে কত খরচ। একই গ্রামের কৃষক সোনা মিয়া জানালেন, ধান-চালের দাম কম হওয়ায় এক শ্রেণীর মানুষ ঠান্ডা আছে। অথচ বিভিন্ন পণ্যের দাম ৪/৫ গুন বেড়েছে। একজন কৃষি কর্মকর্তা জানালেন, যারা নিজস্ব জমিতে বোরো চাষ  করেছে তাদের ততটা লোকসান হবে না। তাদের উৎপাদন ব্যয়ের সাথে আয় প্রায় সমান থাকব। তবে’ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যের জমি বর্গা ও লিজ নিয়ে যারা বোরো ধান চাষ করেছে। তিনি জানালেন, বর্তমানে কৃষকদের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় ১৪ টাকা কেজি দরে। তবে সরকারি ধান ক্রয় শুরু হলে তা কেনা হবে ২৬ টাকা কেজি দরে। তখন কৃষকরা লাভবান হবেন।
 বদরগজ্ঞ উপজেলার রামনাথপুর ইউপির ঘাটাবিল এলাকার কৃষক অতুল চন্দ্র জানালেন কৃষকরা বিঘা প্রতি ধান পেয়েছেন ৪০ থেকে ৪২ মণ।বিভিন্ন রোগ-বালাই এর প্রভাবে ফলনও হয়েছে কম। বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন এর মোল্লাপাড়ার ওহাব মোল্লা বলেন, যে ধান পেয়েছি সব খরচ দিয়েও লোকসান গুনতে হবে। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ৪শ-৪২০ টাকা। অথচ একজন কৃষি শ্রমিকের মজুরী ৫০০ টাকা দিতে হয় কালুপাড়া  ইউপির হাজীপাড়ার মাসুদ অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানালেন, ১ মণ ধানে একজন শ্রমিক নিতে হয়।  পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের কৃষক বুলবুল মিয়া দুই বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। ৫০০ টাকায় দিন হাজিরার শ্রমিক দিয়ে কিছু ধান কেটেছেন। স্থানীয় বড়দরগাহ হাটে ধান বিক্রি করতে এসে দাম কম থাকায় সে ধান বিক্রি করতে পারেন নি। তিনি জানান, বাজারে ধানের মন সাড়ে ৫০০ টাকা বলায় তিনি ধান বিক্রি করেননি। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ধান ফেরত নিয়ে গেছেন। এতে তার যাতায়াতে খরচ হয়েছে ৪শ’ টাকা। তিনি জানান গত বছর মওসুমের শুরুতে ধানের দাম ছিল না। তার ধারণা ছিল এই মওসুমে ধানের দাম বৃদ্ধি পাবে। কিন্ত হয়েছে তার বিপরীত। ধানের দাম আরো কমেছে। এবারও ধানের ন্যায্য মূল্য পবেন কিনা শংকিত। আমান মওসুমের মত বোরো ধানের দাম না পাওয়া গেলে তাকে পথে বসতে হবে। 
গত মওসুমের চেয়ে এবার ধানের মূল্য কম থাকায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে অনেকে বেশি দামের আশায় হাটে ধান বিক্রি না করে বাড়িতে গোলায় তুলে রাখছেন কেউ কেউ। কৃষকরা জানান ক’বছর আগেও ১ একর জমির ধান কাটা মাড়াই করতে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা লাগত।  এখন প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেশি মজুরি দিতে হচ্ছে।  একমন ধানের বিনিময়েও একজন কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছেনা।  ফলে উৎপদন ব্যয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ। তার ওপর ধানের দাম নেই। সামনে ঈদ উৎসব কিভাবে পার করবে এ নিয়ে চিন্তিত অনেক কৃষক পরিবার। রংপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আব্দুল কাদের জানান, ৮ উপজেলায় চলতি বোরো মওসুমে ৯টি খাদ্য গুদামের ক্রয় কেন্দ্রে প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে ৪ হাজার মেট্রিকটন ধান, প্রতিকেজি ৩৬ টাকা দরে ২৫ হাজার ১শ  মেট্রিকটনের বেশি সিদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা কেজি দরে ৭শ ২৬ মেট্রিকটন আতব চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এজন্য জেলার ৯শ মিল মালিকের সাথে চুক্তি করেছে খাদ্য বিভাগ। ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে রংপুর সদর উপজেলা খাদ্য গুদামে বোরো চার সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডক্টর সরোয়ারুল হক জানান, চলতি মওসুমে জেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ২৫হাজার ৩শ ৭৮ হেক্টর জমিতে। এবছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সেখানে অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৮শ ৭০ হেক্টর জমিতে। তিনি জানান জেলার ৮ উপজলোয়  ৪৩ হাজার ৫শ জন বর্গচাষী সহ জেলায় মোট চাষী রয়েছে ৮ লাখ সাড়ে ২৯ হাজার। উৎপাদন বেশী হলে দাম কম হয় এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া মাড়াই মওসুমে দাম কম হয়। সরকার ধান কেনা শুরু করছে। এখন দাম বাড়বে  গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৫ ভাগ জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। কাটামাড়াই শেষে দাম কিছুটা বাড়তে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ