শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ঈদুল ফিতরের নানা দিক ও তাৎপর্য

মোহাম্মদ আবু নোমান : ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’
ঈদুল ফিতরকে নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী এ গান রচনা করেন ১৯৩১ সালে। লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পর ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়।
‘ঈদ’ শব্দটি আরবি। শব্দ মূল ‘আউদ’, এর অর্থ এমন উৎসব যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ মানেই পরম আনন্দ ও খুশির উৎসব। প্রতিবছর দু’দুটি ঈদ উৎসব মুসলমানদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দের ফল্গুধারা। এ দু’টি ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের প্রভাব, ব্যাপ্তি মুসলিম মানসে ও জীবনে বহুদূর বিস্তৃত। পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ উৎসব মুসলিম জাতির প্রতি সত্যিই মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত ও পুরস্কার। মুসলিম উম্মার প্রত্যেক সদস্যের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, মমতা ঈদের এ পবিত্র ও অনাবিল আনন্দ উৎসবে একাকার হয়ে যায়। আর মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়।  মানুষের জীবনব্যবস্থা থেকে ইসলামকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সংস্থান নেই।
আবালবৃদ্ধবনিতা, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য ঈদুল ফিতর আনন্দময় দিন। পল্লী শহরাঞ্চল উভয়ই উদ্বেল হয়ে ওঠে এই দিনে। এই দিনে সবাই আপনজনের সান্নিধ্য পেতে চায়। মা পেতে চায় সন্তানকে কাছাকাছি। কার্যোপলক্ষে দূরে অবস্থানকারী সন্তান তাই ছুটে যায় মা-বাবার কাছে। ভাই-বোনের নিকট হাজারো বাধা ডিঙিয়ে ছুটে চলে ঈদের দিনে। সবাই ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে উপভোগ করতে চায়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য : ঈদ অর্থ খুশি এবং ফিতর এসেছে ফিতরা থেকে। কবি কাজী নজরুলের ভাষায় ‘তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ’। সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য রমজান মাসে বেশি হারে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানবসম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। সুতরাং ঈদুল ফিতরের অর্থ দাঁড়ায় দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/ সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ’। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এটাই হলো ঈদুল ফিতরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য।
মুমিনের উৎসব : পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে আনন্দ উৎসবের দিন। তারা সে দিন বিভিন্ন ধরনের আনন্দ-উল্লাস, আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠে। ঠিক তেমনি মুসলমানদের জন্য রয়েছে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দু’টি আনন্দ উৎসবের দিন। একটি হচ্ছে, ‘ঈদুল ফিতর’ আরেকটি হচ্ছে, ‘ঈদুল আযহা’। এই ঈদের আনন্দ কেবল রোজাদাররাই ভোগ করবে। রোজাদারকে আনন্দ ও পুরস্কার দেয়ার উদ্দেশ্যেই মহান করুণাময় আল্লাহ তা’য়ালা রোজার শেষে তথা আরবি মাসের শাওয়ালের প্রথম তারিখে মুমিনদেরকে উৎসব করার একটি দিন ঈদুল ফিতর দান করেছেন। মহান আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে রোজাদারদের জন্য বিশেষ একটি পুরস্কার হচ্ছে, ঈদুল ফিতর।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যারা রমজানে রোজা রাখেনি তারা ঈদের নামাজে সু-সংবাদপ্রাপ্ত মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের কাতারে শামিল হবে না। তাদের জন্য কোনো আনন্দ নেই। আর যারা রোজা পালন করেছে, গরিবদেরকে নিজের মাল থেকে ফিতরা দিয়েছে শুধুমাত্র ঈদ তাদের জন্যই। তবে যাদের রোজা রাখার বয়স হয়নি অথবা বিশেষ কোনো কারণে রোজা রাখতে পারেনি তারাও ঈদের এই আনন্দে শরীক হতে পারবে। কিন্তু যারা বিনা কারণে এবং অলসতা করে রোজা রাখেনি তাদের জন্য এ ঈদে আনন্দ নেই। এ ঈদ তাদের জন্য আনন্দ স্বরূপ নয়, বরং তিরস্কার স্বরূপ।’
অসহনীয় অপব্যয় : আজকের মুসলিম বিশ্ব ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। ঈদ এলেই দেখা যায় এক শ্রেণির লোক  আনন্দ-ফুর্তি, ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। যারা কিনা সারা বছর আল্লাহর বিধিবিধান অবজ্ঞা করে চলছে। পুরো রমজান মাস তারা গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিয়েছে, তারাই ঈদের মহা-আনন্দে মেতে উঠছে। তাদের পরিবারেই চলছে ভোগ-বিলাসের নানা আইটেম। তাদেরকেই দেখা যায় রূপচর্চা ও সাজ-সজ্জার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারাই জাঁকজমকভাবে পোশাক-পরিধেয় ও ক্রয় করে উগ্রভাবে চলাফেরা করে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’। ঈদের বাজারে আমরা দেখতে পাই বিশেষ করে মহিলারা অসহনীয় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় হওয়ার চেষ্টা করেন। ঈদুল ফিতরের যথার্থ শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করে এই পৃথিবীকে শান্তির নীড়ে পরিণত করতে সবার সচেষ্ট হতে হবে।
সাধারণ ক্ষমার দিন ঈদ : সাধারণত দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ তাদের ক্ষমতার ফখর হিসেবে বিশেষ কিছু দিনে জাতির অপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে থাকে, তেমনি মহান আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য ঈদের দিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। আনাছ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঈদের দিন মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের মাঝে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতাগণ, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হবে? ফেরেশতাগণ বলেন, হে প্রভু, পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান। আল্লাহপাক বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। আমার মর্যাদা, আমার সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদেরকে মাফ করে দেবো।
সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন : কবি নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে/ তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।’ ঈদ এসেছে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একে-অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হওয়ার জন্য। হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি, মারামারি সবগুলো মুছে ফেলার জন্য। একে অপরের, আপন-পর সকলের পিছনের জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা ভুলে, হাতে-হাত রেখে, কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে আসতে হবে। গরিব-দুঃখী সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে ঈদের আনন্দ ভোগ করার জন্য। ঈদে শুধু বিত্তশালীরা আনন্দ করবে এরকম নয় বরং ঈদ সবার জন্য। ধনীরা যেভাবে পোশাক পরে আনন্দ করে গরিবরাও সে আনন্দ করবে। শুধু ধনীরা আনন্দ করবে আর এতিম অসহায়রা আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবে- এটা ঈদের মূল শিক্ষা নয়।
ধর্মীয় তাৎপর্য : রমজানে রোজা পালনের মূল শিক্ষা হচ্ছে, তাকওয়া অর্জন করা। মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। ঈদ কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটা সকলেরই জানা যে, ঈদ সংস্কৃতি মূলত মানুষকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। ধর্মের মূল কাজই হচ্ছে মানুষের মধ্যে জবাবদিহিতা সৃষ্টি করা। জীবন যাপনে স্বচ্ছতা আনয়ন করা, ত্যাগী মানসিকতা সৃষ্টি করা, প্রকৃত মানবতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি তার নির্দেশিত পন্থায় আচরণ করা। পবিত্র রমজানে যেভাবে পাপ মুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার ফলে প্রত্যেক রোজাদার যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করেন সে কারণে ঈদ তাদের জন্য বিশেষ আনন্দের সংবাদ দেয়। আমাদের জীবনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ম কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হওয়ায় ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে যে সুবিধা পাওয়ার সুযোগ ছিল তা পাওয়া যাচ্ছে না। সকলে ঈদের তাৎপর্য অনুধাবন করলেই ঈদ উদযাপনের সার্থকতার পাশাপাশি সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সাধন সম্ভব।
ঈদের দিনের কয়েকটি আমল : ১. শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া, ২. গোসল করা, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. যথাসম্ভব উত্তম কাপড় পরিধান করা, ৫. খোশবু লাগানো, ৬. খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ৭. ফজরের নামাজের পরই ভোরে ঈদগাহে যাওয়া, ৮. ঈদগাহে যাওয়ার আগে খুরমা অথবা অন্য কোনো মিষ্টি দ্রব্য ভক্ষণ করা, ৯. ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতরা আদায় করা, ১০. ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করা। ওজর ছাড়া মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় না করা, ১১. ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া ও অন্য রাস্তায় ফিরে আসা, ১২. ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া, ১৩. ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবীর পাঠ করা : তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।
ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন : ১. হাফেয ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কিরামগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন : ‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন। এছাড়াও ‘ঈদ মোবারক’ শব্দটি মুসলিমদের একটি ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছাবাক্য যেটি তারা ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহায় পরস্পরকে বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকেন। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উদযাপন। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। সুতরাং ঈদ মোবারকের অর্থ হল ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক। তাই আসুন, ঈদের নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনে-প্রাণে; বুকে বুক মিলিয়ে চলুন সবাই সবার হয়ে বলে যাই, ‘ঈদ মোবারক আস্-সালাম।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ