শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মুরসির আত্মদান উম্মাহর প্রেরণা জোগাবে!

মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন : মৃত্যু মানুষের জীবনে কঠিন এক বাস্তবতা। চিরদিন কেউ বেঁচে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক! তবে কিছু মানুষের মৃত্যু সর্বদাই অকাল থেকে যায়। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে যত মানুষ দুনিয়াতে এসেছে তারা কেউ চিরস্থায়ী হিসেবে থাকতে পারেনি। আর যারা ভবিষ্যতে আসবেন তারাও চিরস্থায়ী হবেন না। তারপরও মানুষ ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে কুন্ঠাবোধ করছে না। যুগে যুগে মুজাদ্দিদ, মুজতাহিদ, ইমাম ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের উপর জুলুম নির্যাতনের ধারা চলমান। ইমাম আবু হানিফা, মালেক, আহমদ ইবন হাম্বল ও ইমাম ইবনে তাইমিয়া, মুজাদ্দিদে আলফে সানী, জামাল উদ্দিন আফগানী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সাইয়েদ আহমদ বেরলভী, নিসার আলী তিতুমীর, মিসরের হাসানুল বান্না, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, আব্দুল কাদের আওদাহ, যায়নাব আল গাজ্জালী, সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, অধ্যাপক গোলাম আজমসহ আরও অনেকে যুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা কেউ সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গীগোষ্ঠীর অনুসারী নন! তারপরও তাদেরকে নির্মম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর  খুঁজলে দেখা যাবে, তাদের অপরাধ একটিই! আর তা হচ্ছে বাতিলের সামনে কালেমার পতাকাকে উড্ডীন করতে চেয়েছে। এ যুগেও আমরা লক্ষ্য করেছি যারাই বাতিলের সামনে ইসলামে দাওয়াত তথা ইসলামী আন্দোলনের রূপরেখা জাতির সামনে পেশ করার চেষ্টা করছেন তাদের উপরই নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করা হচ্ছে। এমনকি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অনেককে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। যার জ¦লন্ত প্রমাণ মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি। গত ১৭ জুন সোমবার মিসরের একটি আদালতে বিচারের শুনানি চলার সময় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা মোহাম্মদ মুরসি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এই মুহসীন বান্দার মৃত্যুর সংবাদ শুধু মিসর নয়, পুরো বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদেরকে কাঁদিয়েছে। ইসলামী আদর্শ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তাঁর আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ শ্রদ্ধার সাথে চিরকাল স্মরণ করবে। ইসলামী আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষ সম্পর্কে দুটো কথা লেখার ন্যূনতম যোগ্যতা আমার নেই। তারপরও এই মজলুম নন্দিত জ্ঞানী মানুষের জীবনকথা নিপীড়িত ইসলামী আন্দোলনের ভাইবোনদের খেদমতে পেশ করছি।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন : নীলনদের দেশ মিসর, ফেরাউনের দেশ মিসর, পিরামিডের দেশ মিসর, জামাল নাসেরের দেশ মিসর, আবদেল ফাত্তাহ সিসির দেশ মিসর। এই মিসরে যেমন আল্লাহদ্রোহীদের জন্ম হয়েছে তেমনি আল্লাহপ্রেমিক হাসানুল বান্না, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, আব্দুল কাদের আওদাহ, যায়নাব আল গাজ্জালী ও মোহাম্মদ মুরসির মতো মানুষেরও জন্ম হয়েছে। মিসরের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়াহ গ্রামে ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের সাবেক জননন্দিত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম মোহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত। তার বাবা কৃষক ও মা গৃহিনী ছিলেন। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার পর নিজের মেধার জোরে ১৯৭৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রকৌশল) বিষয়ে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। প্রখর মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি একজন কুরআনে হাফেজ ছিলেন। যেখানেই যেতেন সেখানেই নিজে নামাজের ইমামতি করতেন। এমন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের প্রতিটি দেশে জন্মগ্রহণ করুক এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
কর্মময়জীবন : ড. মোহাম্মদ মুরসি মিসরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসায় কাজ করার সুযোগ পান এবং স্পেস শাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশের মায়ার টানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে ১৯৮৫ সালে শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের উদ্দেশ্যে মিসর ফিরে আসেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন : ড. মোহাম্মদ মুরসি ১৯৭৯ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্র কৃর্তক ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ থাকায় তিনি ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের আদলে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি গঠন করে পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হোসনি মুবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০১২ সালের ৩০ জুন দেশটির প্রথম অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট যার গাড়ীবহর ট্রাফিক ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়ার পরির্বতে সচল রেখেছেন। শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থা নয়, তিনি  একজন ওড়না পরিহিত নারীকে খবর পরিবেশন করার অনুমতি প্রদান করে নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত করেন, যা মিসরের ৫২ বছরের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সেনাপ্রধান আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি সামরিক এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করে। প্রহসনমূলক বিচারে মুরসিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে তার মৃত্যুদ-াদেশ বাতিল করে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। জেনারেল সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে এবং ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছে। যা ইতিহাসের কলংকিত অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ থাকবে।
প্রেসিডেন্ট জীবনের ঘটনাবলী : ড. মোহাম্মদ মুরসি কুরআনের হাফেজ ছিলেন। প্রেসিডেন্টের জন্য বিলাসবহুল প্রাসাদ যেখানে বরাদ্দ থাকে সেখানে মুরসি বিলাসবহুল প্রাসাদে না থেকে ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে সপরিবারে বসবাস করেন। রাষ্ট্রপ্রধানরা যেখানে সরকারি বাসভবনে উঠার জন্য মরিয়া হয়ে যান সেখানে মুরসি ছিলেন সম্পূর্ণ তার ব্যতিক্রম। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তার বোন অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে বোনকে দেখতে গেলে চিকিৎসকরা তাকে জানায় আমেরিকাতে তার বোনের উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় বোন ইন্তিকাল করে। একবার এক গৃহহীন বিধবাকে রাস্তায় পেয়ে মুরসি তাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি রাস্তায় বসবাস করছেন। বিধবা মহিলাটি বললেন আমার স্বামীকে হারানোর পর বাসা ভাড়া ঠিকমত দিতে পারিনি বিধায় বাধ্য হয়েই রাস্তায় বসবাস করছি। মুরসি বলেন মিসরের কোন মা এভাবে কষ্ট করতে পারে না। বিধবা মহিলার জন্য বাসার ব্যবস্থা এবং বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন বাবদ মাত্র বছরে দশ হাজার ডলার পারিশ্রমিক হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। যখন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখন দেখা যায় যে তিনি তার পুরো সময়ে কোন বেতন উত্তোলন করেননি। সকল আরব স্বৈরশাসকদের অনুশীলন ছিল রাষ্ট্রীয় সকল অফিসে প্রেসিডেন্টের ছবি সংরক্ষণ করা সেখানে মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই অনুশীলনের ব্যতিক্রম করেন। সেখানে তার ছবির পরির্বতে সকল অফিসে আল্লাহর নামকে স্থলাভিসিক্ত করেন।
মসজিদ পরিচ্ছন্ন করাই ছিল যার অভ্যাস : গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসির আকস্মিক মৃত্যুতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। এই মহান নেতার সংগ্রামী জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরে প্রশংসা করছেন অনেকে। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে মুরসি কী করতেন সেটাই বলেছেন তার এক প্রতিবেশী। প্রতিদিন ফজরের আজানের আগেই স্ত্রীকে নিয়ে মসজিদে নিয়মিত আসতেন। এমনকি তারা উভয়ই নিয়মিত মসজিদ-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন। নিয়মিত তারা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। কোনোদিন যদি সমজিদে আজান না হতো, তাহলে তার কথা আমরা স্মরণ করতাম। তিনি তখন আজান দিতেন।
স্ত্রীর আবেগঘন স্ট্যাটাস : আরব বসন্তের মহানায়ক মুরসির মৃত্যুতে ফেইসবুক, টুইটারসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিশেষ করে মুরসির স্ত্রী নাগলা মাহমুদের আবেগঘন স্ট্যাটাস সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়েছে। স্ত্রী নাগলা মাহমুদ ড. মুরসিকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরো লিখেছেন আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে শারকিয়া প্রদেশে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে দাফন করতে দেয়া হয়নি। আমার পরিবারে শোক প্রকাশে বাধা প্রদান করেছে । ড. মুরসির মৃত্যুতে সকল মুসলমানের চোখে পানি আসবে কিনা জানি না, তবে অকাতরে কাঁদবে ফিলিস্তিনের গাজা ও জেরুসালেমবাসী। মুরসির দুনিয়া ত্যাগকে স্বাভাবিক মৃত্যু বললেও আমরা বলবো এটি নীরব হত্যাকা-। স্বৈরশাসক ফাত্তাহ সিসি এই হত্যাকা-ের খলনায়ক। [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ