বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

কুরবানি কি কেন? এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা মুফতী মোঃ ওমর ফারুক : [দুই]
প্রিয় জন্মভূমি সোনার বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশে সকল মানুষের মাঝেই দেখা যায় যে যখন কোন আনন্দ বা খুশির বিষয় থাকে, তাহলে মিষ্টি বিতরণ, মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ, দান সদকা করতে দেখা যায়। বেশীরভাগ সময়ে জয়ের আনন্দে রং ছিটিয়ে আশ পাশের এলাকায় হৈ হুল্লা করে, আনন্দ মিছিল বের করে, পথ যাত্রীদের গায়ে রং ছিটিয়ে খুশির সংবাদ জানান দেয়া হয় যা মোটেই কাম্য নয়, কারণ এতে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হয়। কখনো কখনো খেলার মাঠে জয় লাভের পর মহান মালিককে সিজদা করতে দেখা যায়, যদিও তুলনামূলক ভাবে এই অভ্যাসটি অনেক কম। আসলে তাই করা উচিৎ। মিষ্টি মুখ করানো, দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ ও অতি উত্তম কাজ।
কুরবানীর পশুর রক্ত মাংশ এর আকার আকৃতি ইত্যাদি আল্লাহ তায়ালার কোন-ই প্রয়োজন নেই বরং এর সবকিছু-ই আমাদের জন্য। আমাদের কোন না কোন উপকারার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। যখন কোন চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী অথবা অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত নারী পুরুষ কোন পশু কুরবানী করতে চায় কিন্তু তার পশু নেই। সে বাজার হতে যখন পশু ক্রয় করে তখন পরোক্ষভাবে সমাজের অপরাপর পেশায় নিয়োজিত সকলের প্রতি তার অবদান শুরু হয়ে যায়। যা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের অগণিত কল্যাণ বয়ে আনে। শুধু কুরবানীতেই হালাল পশু জবাই হয়না বরং দৈনন্দিন জীবনে মানুষের জীবন ধারনের এক অসীম প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে পশু পাখী জীব জন্তু। যার কোন না কোন অংশ আমাদের উপকারে আসছে। উন্নত মানের জুতা, মানি ব্যাগ, বেল্ট তৈরীতে পশুর চামড়াই প্রধান উপাদান। মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরীতে দুধের বিকল্প নাই। আমাদের শরীরে পুষ্টি যোগাতে, বিয়ে-শাদী, শিশুদের আকীকা, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে হালাল পশুর গোশতের বিকল্প আর কিছুই নাই। তাহলে অতি সহজেই বুঝা গেল যে শুধু কুরবানীতেই পশু জবাই নয় বরং প্রতি নিয়তই মানুষের কল্যানে পশু জবাই আল্লাহ বৈধ করেছেন।
অপচয় অপব্যয় ব্যতীত যদি বৈধ পথে মানবতার কল্যাণে পশু জবাই করা হয় কুরবানী দেয়া হয় তা হলে নি:সন্দেহে তা ছওয়াবের কাজ,পূণ্যের কাজ মানবতা মনুষত্বের কাজ,সমাজ সেবা মূলক কাজ। যদি কেহ সামর্থ রাখে তাহলে ভাল কাজ প্রতি মুহূর্তে করলেই সমস্যা কোথায়? যদি কুরবানী মানুষের ক্ষতির কারণ হতো তাহলে আল্লাহ এ বিধান দিতেন না। যারা কুরবানীতে পশু নিধনের দোহাই দিয়ে জাতীয় আয়ের জন্য মায়া কান্না করে, তারা নিজেরাই জাতীয় দায়! এ দেশের বোঝা! দেশ জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শত্রু। তারা মূলত মহান আল্লাহর বিধান কে উপেক্ষা করতে চায়! তারা মুসলমান নামের কলঙ্খ! নকল মুসলমান! মুসলমান উম্মাহর পোড়াহ! তাদের কে সামাজিক ভাবে বয়কট করা দরকার । সরকারের উচিৎ যারা এ জাতীয় বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাদের কে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির সম্মুখীন করা!
আর কুরবানী হচ্ছে মুসলিম জাতীর পিতা হযরত ইব্রাহীম আ: এর সুন্নত। যা আল্লাহ তায়ালার কাছে খুবই পছন্দনীয় একটি আমল। কুরবানীর পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও খুরসহ হাজির হবে। কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে পৌছে যায়। কুরবানী কৃত পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেক দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে।
কুরবানী সহ মুসলিম জাতীর দৈনন্দিন সকল কর্ম সম্পাদন ইবাদত-বন্দেগী ম’ুয়ামালাত ম’ুয়াশারাত সবকিছু মহান মালিকের দেখানো পথে হবে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আ: এর পুত্র হাবিল কাবিলের বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়ে কাবিলের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির বিরোধ নিরসনের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় হিসাবে কুরবানী দেওয়া হয়েছে যা পৃথিবীর  প্রথম কুরবানী। কুরবানীর শ্রেষ্ঠতম স্থান হচ্ছে পবিত্র মক্কা মুর্কারমার অতি সন্নিকটে মিনা। যা হযরত ইসমাঈল আ: এর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। সম্মানিত পাঠক সহ সকলকেই প্রতি বছর এবং জীবনে একবার হলেও মিনাতে নিজ হস্তে কুরবানী করার তাওফিক দেন এই কামনা করছি।
কুরবানি কবুল হওয়া ও এর ফজিলত লাভের সহজ উপায় : কুরবানি কবুল হওয়া এবং এর যথাযথ ফজিলত লাভের জন্য কিছু কিছু বিষয়ে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।আর কিছু বিষয় পরিহার করতে হবে। যে সকল বিষয়ে অতি মাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা হচ্ছে কুরবানী হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি রেজামন্দি হাসিলের উদ্দেশ্যে, হালাল ও বৈধ অর্থের মাধ্যমে। আর এগুলো সকল ইবাদত কবুলের ও শর্ত। কুরবানী হতে হবে মনের ঐকান্তিক আগ্রহসহকারে শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ পালন, ইব্রাহীম নবীর সুন্নতের অনুসরণ অনুকরণের বাস্তব নমুনা হিসাবে ইসলামী শরীয়ার একটি বিধান পালনের নিমিত্তে। এ দুটি বিষয়ের অনুপস্থিতিতে অথবা দুটির একটির অনুপস্থিতিতে কুরবানী বা অন্য যে কোন নেক কাজ ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না বরং লোক দেখানো যে কোন ইবাদত শিরক,যা আল্লাহ মাফ করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন সুরা মায়িদার ৭১ নাম্বার আয়াতে। (১) নিয়তের বিশুদ্ধতা: ইহা যে কোন ভাল কাজ ইবাদত বন্দেগী ও কুরবানী কবুলের প্রথম এবং পূর্ব শর্ত (২) অর্থের বিশুদ্ধতা: অবৈধ অর্থের দান সদকা হজ্জ মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ,কুরবানী ইত্যাদি কোন বিষয়ই কবুল হয় না (৩) শরিক নির্বাচনে সতর্কতা যেহেতু কুরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য তাই সকলের ইখলাছ এক রকম হয় না তাই শরীকদের কোন এক জনের নিয়তে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে বাকী সকলের কুরবানী বাতিল। কুরবানিতে শরীক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুদ খোর ঘুষ খোর, বেনামাজি, প্রতারক অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ীর সাথে কুরবানী করা উচিৎ নয় (৪)বাজার হতে পশু ক্রয় করে বাজারের ট্যাক্স দিতে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা: এ কাজটি করা মোটেই ঠিক নয় কিন্তু অনেকে নানা কলা কৌশলে ট্যাক্স ফাকিঁ দিতে চায়, কেহ কেহ ফাঁকি দেয়। ইহা অনুচিত, কারণ কুরবানি একটি ইবাদত  ৫. আল্লাহর নামে কুরবানি না দিয়ে অমুকের নামে কুরবানী দেওয়া কারো নামে কুরবানী দেওয়া ৬. যে আকীকা দেয় নি সে কুরবানী দিতে পারবে না এমন আকীদা পোষণ করা সঠিক নয় ৭.শুধু পরিবারের প্রধানের নামে কুরবানী দেওয়া অর্থাৎ যদি কোন পরিবারে একাধিক সদস্য থাকে সবাই আয় রোজগার করে সবার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয় সেই ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই কুরবানী দেবে যদিও যৌথ পরিবার ৮ কুরবানীর গোশত বিক্রি করে দেওয়া যায় না বরং দান করা যায় ৯. কুরবানীর গোশত শরিকদের মাঝে পাল্লা দিয়ে ওজন  করে বন্টন করতে হবে। ১০. জবেহকারী বা কসাইকে গোশত বানানোর মজুরী স্বরূপ গোশত, চামড়া, রশি ইত্যাদি দিয়ে দেওয়া যাবে না  ১১. রাসুল সা: এর নামে কুররবানী দেওয়া নয় বরং আল্লাহর নামে দিতে হবে ১২. একই পশুতে কুরবানী ও আকীকার নিয়ত করা যাবে না  ১৩. কুরবানীর সময় মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা নয় ১৪ কুরবানীর পশুর সামনে এসে কুরবানী দাতাদের নাম উচ্চারন করার কোন প্রয়োজন নেই। ১৫. জীবিত মানুষের নামে কুরবানী ও ১৬. মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী নয় বরং সকল কুরবানী হবে আল্লাহর নামে ১৭. নিজ এলাকায় কুরবানী ১৮. পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি অমুসলিমদের মাঝে ও কুরবানীর গোশত বিতরণ করা যাবে ১৯. অসিয়তের কুরবানী দেওয়া যাবে ২০. মান্নতের কুরবানী দেওয়া যাবে তবে কোন কুরবানী-ই কোন ব্যক্তির নামে নয় বরং সকল কুরবানী-ই হবে আল্লাহর নামে ।
কুরবানী সম্পর্কে কিছু অনুমান ভিত্তিক ও ভিত্তিহীন কথা সমাজে প্রচলিত রয়েছে যে, হযরত ইব্রাহীম আ: এর স্বপ্ন যোগে জানতে পারলেন তাঁর প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানী করা পরে প্রথমে ১০০ দুম্বা পরের দিন ১০০ উট তার পরেরদিন ১০০ গরু কুরবানী দিলেন এবং প্রথমে তিনি বুঝতে পারেন নি যে আল্লাহ কি চাচ্ছেন (নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক)অথচ সুরা আসসফাত  ১০০-১০৮ নাম্বার আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে তিনি ইসমাঈল আ: কে জানালেন হে বৎস! আমি স্বপ্নে জানতে পেরেছি যে তোমাকে জবাই করছি তোমার অভিমত/অভিপ্রায় কি ? সাথে সাথে ইসমাঈল আ: বললেন ওহে আব্বাজান আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন । পিতা-পুত্র ঊভয়ে আল্লাহর আদেশ পালনে অনুগত হয়ে তা শতভাগ বাস্তবায়নের সকল প্রস্তুতি শেষ ঐ মুহূর্তে স্বয়ং আল্লাহ ডেকে বলেন হে ইব্রাহীম ক্বাদ সদ্দাক্বতার রুইয়া অর্থাৎ আপনী ১০০% পরীক্ষায় পাশ করেছেন ... যা পরবর্তীদের জন্য আমরা নমুনা হিসাবে রেখে দিলাম । সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে সহীহ নিয়তে কুরবানী করলে কুরবানীর পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেওয়া হবে আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ নিয়ত ও হালাল ইনকাম দ্বারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর রাহে কুরবানী করার তাওফিক দান করুন।  [সমাপ্ত]
-লেখক : একজন কলামিষ্ট, কবি,সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যাংকার
ই-মেইল: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ