শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আক্রান্ত ৫০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী সরকারের নজরদারির বাইরে

এইচ এম আকতার : ডেঙ্গু আতঙ্ক দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আক্রান্ত এসব রোগীর ৫০ শতাংশ সরকারের নজরদারির বাইরে রয়েছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে। কোনও কোনও পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত। বেশির ভাগ হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। নির্ধারিত বেড ছাড়িয়ে ফ্লোরে, বারান্দায়, লিফটের পাশে, বাথরুমের দরজার সামনে যে যেখানে পারছে সেখানেই বিছানা পেতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার সিট না পেয়ে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা না নিয়ে ফেরত যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর সঠিক সংখ্যা পেতে প্রতিটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর হিসাব জানতে হবে। কত রোগী বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান, তা জানাও জরুরি। তারা বলছেন, ঢাকা শহরের প্রাইভেট চেম্বারগুলোর কোনও হিসাব নেই। অথচ শহরের একটি বড় অংশের মানুষ প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নেন। এই অংশটাও বাদ পড়ে যাচ্ছে। ৫০ শতাংশ রোগীই সরকারি নজরদারির বাইরে থাকছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সাড়ে ৫ বছরের আলিফা খাতায় পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখছে। পাশ থেকে মা মারুফা জানালেন, গত ১০ দিন ধরে মেয়ের জ্বর। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে এখন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মাঝে ৪ দিন পিআইসিইউ-তে (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ছিল। কিছুটা সুস্থ হওয়ায় ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এভাবেই ঢাকার প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। কোনও কোনও হাসপাতালে নির্ধারিত বেডের অভাব ফ্লোরিং করতে হচ্ছে রোগীদের। নির্ধারিত মেডিসিন ওয়ার্ডের বাইরে অন্যান্য ওয়ার্ডেও রাখা হচ্ছে তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার এন্ড কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪৭ জন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে চট্রগ্রামে ৯ জন, খুলনায় ও বরিশালে ১ জন করে।
এছাড়া ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১৬৭ রোগী। আর বেরসকারি ৩৬টি হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি আছেন ৯৩১ জন। বেসরকারি হাসপাতালে এ পর্যন্ত ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৪৭৫ জন। চিকিৎসা নিয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৩ হাজার ৫৩৭ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে তারা ‘মহামারি’ না বললেও পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। আর যত রোগী হাসপাতালগুলোতে আসছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত হচ্ছেন, প্রকৃত সংখ্যা তার অনেক বেশি। কোনও কোনও হাসপাতালে রোগীদের অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে। কোথাও কোথাও বেড না থাকায় কর্তৃপক্ষ রোগীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায় রয়েছে ঢাকার ৩৬টি বেসরকারি হাসপাতাল আর সরকারি ১৩টি। কোনও কোনও হাসপাতালের নাম তালিকাতে থাকলেও সেখানে রোগীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে শূন্য। অথচ সেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন।
তারা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ১৯২টি। অথচ এর মাত্র ৮ ভাগ তথ্য দেয়। আর শহরের অলি-গলিতে রয়েছে অনেক ক্লিনিক ও হাসপাতাল, যেগুলোর তালিকাই নেই অধিদফতরে।
এই চিকিৎসকরা আরও বলেন, অনেক গরিব রোগী আছেন, যারা আশপাশের ওষুধের দোকান থেকেও ওষুধ নিচ্ছেন। আবার পরিস্থিতি জটিল না হলে অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না। যাদের ডেঙ্গু জটিল আকার ধারণ করছে তাদের সংখ্যাটাই কেবল জানা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি মরিয়া হয়ে কারণ খুঁজছি। এতদিন তো ভালো ছিল, হঠাৎ করে এই অবস্থা কেন  তৈরি হলো?
 হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আখতার বলেন, তারা প্রতিটি হাপসাতালে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য চেয়ে বারবার চিঠি দিয়েছেন, তথ্য চেয়েছেন, কিন্তু হাসপাতালগুলো তাদের সহযোগিতা করছে না।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, অনেক রোগী ভর্তি নেওয়ার পরও অনেককেই তারা ফিরিয়ে দেন, যাদের অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল না। আবার অনেকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি যান। আবার একটু খারাপ বা একটু রিস্কি মনে না হলে আমরা ভর্তি করি না।
জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন,এখন জ্বর নিয়ে এলেই আমরা টেস্ট করাচ্ছি। প্রতিদিন বহির্বিভাগের নারী-পুরুষ সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার রোগী দেখা হয়। এর ভেতরে ‘সাসপেক্টেড’ ডেঙ্গু প্রতিদিন কমপক্ষে দেড়শ’ থেকে ২০০ জনের থাকে।
বেসরকারি ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী বলেন, অনেক রোগীকেই তারা হাসপাতালে ভর্তি নিতে পারছেন না।
 রোগী ভর্তি নিতে পারছে অ্যাপলো হাসপাতালের মতো ৫ তারকা হাসপাতালও। তারা প্রতিদিন অন্তত ৫০ জনের মতো ডেঙ্গু রোগীকে ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব থেকে জানা গেছে, গত বছর জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৪ জন। আর এ বছর ২৫ জুলাই পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৫৬-তে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশের সব ডেঙ্গু রোগী কোনোভাবেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায় আসে না এবং আসা সম্ভবও নয়।
তারা মনে করেন, ১০ থেকে ২০ শতাংশ ডেঙ্গু ডায়াগনোসিস-ই হয় না। দেশের সবার হেলথ কার্ড নেই। হেলথ ইন্সুরেন্স সিস্টেম নেই। কাজেই কে কোন জায়গায় কোন চিকিৎসক দেখাচ্ছে তার সঠিক হিসাব নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের যে তালিকা গণমাধ্যম পায় সেটা হাসপাতালভিত্তিক ডেটা। এর বাইরে তো কত কত রোগী থেকে যাচ্ছে চিকিৎসার বাইরে।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি নজরদারির বাইরে অন্তত ৫০ শতাংশ রোগী রয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে এই ৫০ শতাংশের বাইরের কোনও তথ্য আসে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ