শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য মূল্যের পার্থক্য

ডাঃ মোঃ মহিবুল্লাহ : বাংলাদেশে এবার বারই আগষ্ট যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে গেলো মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য ইবাদত ঈদুল আজহা। এ ঈদে প্রায় এককোটি বিশ লক্ষ পশু কুরবানি হয়েছে। তারমধ্যে টানারি মালিক সুত্রে জানা গেছে তারা এবার এককোটি চামড়া ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে বাকি চামড়ার কপালে যে কি দুর্দশাই না হয়েছে তা আমরা কেইবা না জানি। সরকার এবার চামড়ার যে মূল্য নির্ধারন করে দিয়েছিলো তা ছিলো গরিবের হকমারা এক রেকর্ড ভাঙ্গা দাম। ৩৫/৪০ টাকা দরে গরুর চামড়ার ফুট আর ৮/১০ টাকা ছাগলের চামড়ার ফুট বিক্রি করে ৫/৭ জন হকদারদেরকে দিতে গেলে যা দেয়া পড়ে তা তারা পারলে মুখের উপর ছুঁড়েমেরে রেখে যাওয়ার মতো অবস্থা।
সাম্প্রতিক সময়ে ভিক্ষুকদেরকে এক টাকা ভিক্ষাদিলে এখন তারা তা দাতাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে "আপনার ভিক্ষা আপনিই নেন আমার লাগবেনা।" অথবা বলে "আমিও এরচেয়ে বেশী ভিক্ষাদেই।" তবে চামড়ার এমন চরম নিম্নমূল্য নির্ধারন করে দেওয়ার ফলে মাঠের ক্ষুদে ক্রেতারা আরো সুযোগ গ্রহণ করেছে। যে কারণে চামড়ার দাম একেবারে নেমে যায়। এছাড়াও সারাদেশে এমন অসংখ্য অভিযোগ তাদের চামড়ার কাছে ঈদের দিন সন্ধ্যা পর্যন্তই কোনো চামড়ার খরিদ্দার  আসেনি। মাগরিবের নামাজে যেয়ে শুনলাম একে অন্যের সাথে গল্প করছে "নব্বই হাজার টাকা দামের আইড়ের (ষাঁড়ের) চামড়া বেচলাম মাত্র একশো টাকা।" প্রতিত্তোরে খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার মুশারফ মোল্লা বলে ওঠে "আমাদেরসহ এক জায়গায় চারচারটি চামড়া এখনও পড়ে আছে। কেনে ক্রেতা খবরও নেয়নি। কালকে নাগাত কেউ না নিলেতো মাটিতে পুতে রাখা ছাড়া কোনো গতি থাবেনা।" যাদেরকে পরদিন এমনটাই করা লাগলো। পচাগন্ধের হাত থেকে বাচতে তাদের পশুর চামড়াগুলো মাটিতেই পুঁততে হল। হাফেজ খাইরুল আলমের একটি গরুর চামড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য বাগেরহাটের মোল্লারহাট থানার গাংনী গ্রামের গাংনী ইসলামিয়া কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানার এক ছাত্রকে এ খবর সেখানকার শিক্ষকদেরকে দিতে বল্লে আব্দুর রহমান নামের সে ছাত্র বলে "আপনারা ভ্যান ভাড়া করে দিয়ে আসলেও নিবে কিনা সন্দেহ। কারন গতকালই যেগুলো সংগ্রহ করেছে তা-ই বিক্রি করতে পারিনি। এমনকি ঐ গুলোই কি মাটিতে পুতে ফেলতে হয়কিনা তার নিশ্চয়তা নেই।"
গাংনী ইসলামিয়া কওমি মাদ্রাসা প্রতি বছরই চামড়া কিনে থাকে। বেশ লাভ ও করে তারা। এ অঞ্চলের সকল মানুষই তা জানে। এমন ভাবে বাংলাদেশের অনেক লিল্লাহ বডিং ও এতিমখানা মাদ্রাসার পক্ষথেকে কুরবানি এলেই চামড়া কিনে থাকতো। এদেশের যেখানেই এধরনের প্রতিষ্ঠান আছে সেখানকার সকলেরই তা জানা। কেননা এরা চামড়া কেনার পাশাপাশি কুরবানিদাতাদেরকে বলেন, "আপনারা আমাদের মাদ্রাসার লিল্লাহ বডিং ও এতিমখানায় এচামড়ার কতোটাকা দেবেন?" এভাবে তাদের ব্যবসার পাশাপাশি কালেকশনটাও একধাপ ভালো হয়ে চলে। কিন্তু এবার ঈদের আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় ও বিভিন্ন রকম সংবাদ মাধ্যমে চামড়ার মূল্য উদ্বেগজনক ভাবে কমার ও টানারি মালিকদের চামড়া ক্রয়ের পরিকল্পনা দেখে অসংখ্য চতুর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চামড়া কিনাথেকে যথারিতি বিরত থেকেছে। আর অনেকে কিনে তা বিক্রি করতে না পারার কারনে মাটিতে পুতে ফেলেছে অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। সবকিছু মিলে এঈদে চামড়ার কাষ্টমার চোখে না পড়ার মতো বললেই চলে। শহরে বড়োবড়ো গরুর চামড়ার কাছে যেটুকুন যা ব্যাপারীরা ঘুরাফিরা করেছে গ্রাম-গঞ্জে তার শিকিও ঘুরিনি। সেকারনে এবার অনেক চামড়াকে মাটির নিচেও পচতে হয়েছে। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে রপ্তানি করার মতো এসুযোগ যারা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে অনেক পরিশ্রম করেছে তারা অসংখ্য চামড়া দেশের বাহিরে পাচার করতেও কঠোর ভুমিকা রেখেছে। যারা বরাবরি দেশের কল্যাণ ও অগ্রযাত্রার কথা কোনোরকম চিন্তা না করে বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের চাওয়া পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে আসছে। কেননা যে চামড়া সম্পদে বাংলাদেশ বিশ্বেরমধ্যে অন্যতম। তাদের দেশে দাম কম হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এমন দুর্মূল্য নেই। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো ঠিক ধানের সিজেনের মতো। ধানের দাম সীমাতিরিক্ত কমের কারণে চাষি তাদের নিজের পাকাধানে আগুন লাগিয়েও বুকে চাপা কষ্টকে দমাতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরক্ষণে আবার সরকারকে পার্শ্ব রাষ্ট্র থেকে চাউল আমদানি করতে দেখলো হতভাগা এই জাতি। এখন আবার যখন দেশের মানুষ উপায়ান্ত না দেখে গর্ত খুড়েখুড়ে রক্ত ও বর্জ্যরে মতো চামড়া সম্পদকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলছে। কেউ ব্রীজের উপরে উঠে নদীতে ফেলে দিয়েছে। কেউবা আবার বিদেশি মাগুর মাছের পুকুরে ঢেলে দিয়েছে। তবে ঠিক এমন অবস্থার সময় আবার সেই কম মূল্যের চামড়াকে সরকার পাশের রাষ্ট্রে রপ্তানি করতে পাঁয়তারা করছে। দেশের কেউকেউকে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রক্ত ও বর্জ্যরে বরাবর চামড়ার মতো এক অতি উন্নয়নক্ষম সম্পদকে পুঁতে ফেলতে হলেও এ চামড়াজাত দ্রব্য কিন্তে গেলে হয় তার উল্টা। দেশে যখন চামড়ার দাম ছিলো তখন চামড়াজাত পন্যের মূল্য যেমন ছিল এখন চামড়ার এই বেদামের বাজারে চামড়াজাত পণ্যের মূল্য তারথেকে মোটেও কম নয়। বরং তার তুলনায় আরো অনেক বেশী। একটা চামড়ার স্যান্ডেল অথবা জুতা কিনেতে গেলে সাত আটশো টাকা থেকে শুরুকরে আট দশ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনালাগে। চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট, লাগেজ, লেদার, ব্রিফকেসসহ সকল কিছুর মুল্যই আকাশ চুম্বী। এখানেই মনে প্রশ্নজাগে কি তার কারণ? কেনো এমন সমীকরণ? যার কাঁচামালের দাম কম তার তৈরী সরঞ্জমের ওতো কমমূল্য হওয়া উচিৎ। কিন্তু কেনো জাতি তার উল্টা দেখছে? ওরা কি পেশি শক্তি প্রয়োগে দেশ ঠিকই চালিয়ে চলবে তবে দেশ ও জাতির কল্যাণমুখি কাজ করতে পারবেনা? আর এহেন ভুমিকার জন্য আসলে কি তারা ভিনদেশী ঐ অশুভ শক্তির হাতে বন্দী? নাকি ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার বিনিময়কৃত এক দেশদ্রোহী সন্ধি?
সে যাই হোক এক স্কয়ার ফুট চামড়াও যদি দেশ ও বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এভাবে পচে মাটি হয়ে যায়। তাহলে তার খেশারত সমগ্র জাহানের চামড়াজাত পণ্য ক্রেতাসাধারণের ঘাড়ে নিপতিত হয়। এজন্য দেশের চলমান চামড়া সম্পদ নষ্ট করার পরিবেশ দেখে দেশ বিদেশের চিন্তাশীলদের মাঝে দারুণ উদ্বেগ প্রকাশ পেতে দেখা গেছে। তবে তাদের এ উদ্বেগের পাশাপাশি এদেশের চামড়া চাষি ও নীতিবান প্রাথমিক পর্যায়ের চামড়া ক্রেতাদের এ চামড়া পাচারের পথে ঠেলে না দিয়ে পচিয়ে ফেলেও যে দেশ প্রেমের পরিচয় পরিস্ফুটিত করেছে তাকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছে। কেননা যারা আমাদের সম্পদ নাটকীয় কায়দায় পণবন্দি করে আমাদেরকে লসে ফেলে তারা আমাদের সম্পদ দিয়ে লাভ করে যাবে সে ষড়যন্ত্র বুঝেও আমরা দুষ্টের মুখে অন্ন তুলে দিব তা হতে পারেনা। এজন্য টাঙ্গাইলে ধানচাষীর নিজ পাকাধানে আগুন দিয়ার মতো চামড়া পচানোকেও এক নীরব প্রতিবাদ বলে আখ্যায়িত করেছে  বিশেষজ্ঞমন্ডলি।
তথাপিও বিশ্বের কোনো এক প্রান্তের একমুঠ সম্পদও অনিষ্ঠ হওয়া মানে তামাম জাহানের জনশক্তির চাহিদার একবিন্দু ঘাটতি পড়া।যে ঘাটতির ব্যাপারে সমগ্র মানবতার সক্রিয় প্রতিবাদ থাকাই সমীচীন। তাই আসুন আমরা তামাম জাহানের সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে চামড়া সম্পদের রাজধানি বাংলাদেশের চামড়া সম্পদকে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে রাক্ষা করে কাচা চামড়া ও চামড়াজাত পন্যের মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য ফিরিয়ে এনে চামড়াজাত সম্পদ রক্ষা করি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ