সরগরম সচিবালয়ে হঠাৎ নীরবতা
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ‘টানা দুই দিন সাপ্তাহিক বন্ধের পর খোলার দিন স্বাভাবিকভাবেই সরকারের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয় সচিবালয় খুবই সরগরম থাকে। কিন্তু গতকাল রোববার ছিল তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কেমন জানি সুনসান নীরবতা লক্ষ্য করা গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সচিব সবাই নীরবতা পালন করেছেন। অন্যদিন নানা আয়োজন থাকলেও গতকাল তেমন কিছুই ছিল না। সবাই যেন নিশ্চুপ। কারো কাছ থেকেই কোনো বক্তব্য পাওয়া গেল না। সবাই যেন মুখে কুলুপ এটেছেন’। রাজধানীতে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) তে আড্ডায় এমন বক্তব্যই উঠে এসেছে সচিবালয়ের সংবাদ সংগ্রহকারী রিপোর্টারদের কাছ থেকে। তারা বলছেন, এ রকম সচিবালয় তারা দেখেননি। কেউই কোনো কথা বলছেন না। সবার মাঝে একটা হতাশার চাপ। অথচ সাপ্তাহিক অফিসের প্রথম দিনে সচিবালয় থাকে সরগরম। একাধিক মন্ত্রী ব্রিফিং করেন। কিন্তু গতকাল তেমনটি দেখা যায়নি। জানা গেছে, রাজধানীতে চলমান ক্যাসিনো ও জুয়ার অভিযানের সাথে অনেকের নাম ও সম্পৃক্ততা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় টেনশনে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী-সচিবসহ অনেকেই। তাই এই মূহুত্বে বাড়তি কোনো ঝামেলায় যেতে চাইছেন না কেউই। মিডিয়ায় অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হয়। যদি এখানে ক্যাসিনো বা জুয়ার বিষয়টি চলে আসে, তাই আপাতত বাধ্য না হলে মিডিয়ার মুখোমুখী হতে চাচ্ছেন না কেউই।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে অপরাধের জগৎ সম্পর্কে ভূরি ভূরি তথ্য এখন দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে। এই জগৎ সমাজের সর্বস্তরে, সর্বত্র বিস্তৃত। প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক দল ও তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সংগঠন, শিল্প-ব্যবসা-ব্যাংকিং থেকে নিয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অপরাধের জগৎ এখন বিস্তৃত। এককথায় বলা চলে, বাংলাদেশ এখন অপরাধীদের এক ভূস্বর্গে পরিণত হয়েছে। তাদের থাবার বাইরে কোনো ক্ষেত্রই আর নেই। পরিস্থিতি কত সংকটজনক এবং দুর্নীতি ও ক্যাসিনোতে জুয়ার আড্ডা কতদূর বিস্তৃত এবং এর সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে কারা জড়িত এ প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়, ‘রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। তিনি দাবি করেছেন, ক্লাবের ভেতরে জুয়ার আড্ডা বসত এমন খবর তার কাছে ছিল না। তিনি ক্লাবটিকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ক্লাব হিসেবেই জানতেন। এটাও এক তাজ্জব ব্যাপার! ক্লাবটিতে জুয়ার আড্ডা এবং মদের ব্যবসা চলা সত্ত্বেও মেননের মতো একজন ব্যক্তি তার কোনো খবরই রাখতেন না, এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এর থেকেই বোঝা যায় শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাদের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যরাও দুর্নীতির জালে জড়িত। এর থেকে বাদ যায়নি সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংস্থাও। অনেকেই এখন নিজেকে সাধু সাজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকলে অনেক রথি-মহারথির নামও জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হবে বলে মনে করছেন সবাই।
সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে লিখেছেন, অভিযান নিয়ে তাদের এতো টেনশন কেন? তিনি বলেছেন, সবাই যদি ভালো হয়, তাহলে খারাপ কারা? যাদের টাকা পয়সা নেই। ক্ষমতা নেই। তারাই কি অপরাধী? মোহামেডানের লোকমান হোসেন ভ্ূঁইয়া এক সময়ে বেগম জিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন। আওয়ামী লীগের সময়ে বিসিবি সভাপতি পাপনের আশীর্বাদে তিনি এখন মোহামেডান ও ক্রিকেট বোর্ডের প্রভাবশালী কর্মকর্তা। অস্ট্রেলিয়ায় ৪০ কোটি টাকা পাচার, ক্লাবে ক্যাসিনো ভাড়া দেয়াসহ নানা অভিযোগে তিনি যখন আটক তখন পাপন সাহেব ইনিয়ে বিনিয়ে তার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলছেন, তিনি মদ খান না। জুয়া খেলেন না। তিনি যে ক্যাসিনোর সাথে যুক্ত সেটা তিনি জানেন না। আবার ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে যখন সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলো, গ্রেফতার হলো খালেদ ভূঁইয়া তখনতো যুবলীগ চেয়ারম্যান হুঙ্কার ছাড়লেন। তিনি বললেন, ঢাকার যুবলীগের প্রান পুরুষ সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আবার চট্টগ্রামে যখন ক্লাবে ক্লাবে জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলো তখন স্থানীয় এমপি ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরী তো ক্ষোভে ফেঁটে পড়লেন। বললেন, জুয়া বন্ধ হলে খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলেরা রাস্তায় রাস্তায় ছিনতাই রাহাজানি শুরু করবে। আবার টেন্ডার সম্রাট জি কে শামীমকে যখন ধরা হলো তখন অনেকে হাই হাই করে উঠলেন। বললেন,সর্বনাশ তার হাতে ৩/৪ হাজার কোটি টাকার সরকারি নির্মাণ কাজ। তাকে আটক হলে এসব স্থাপনার কি হবে? তার বিষয়ে আবার মিডিয়ার কারো কারো বিশেষ সহানুভূতির কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব মদাড়ু, জুয়াড়ু ও লুটেরা গোষ্ঠীর প্রতি অনেকেই আকারে ইঙ্গিতে সমর্থন দিচ্ছেন। কেন এমনটা হচ্ছে?
মোস্তফা ফিরোজ আরো লিখেছেন, সবাই জানেন নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কঠিন বিষয়। প্রধানমন্ত্রী সেই কঠিন কাজটিতে যখন হাত দিলেন তখন সরকার ও ক্ষমতার সাথে যারা এতোদিন ওঠা বসা করেছে তাদেরই বেশি খুশি হবার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাদের ভিতরে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। তারা বলতে চাইছেন বেশি নাড়াচাড়া করার দরকার নেই। ওই ছাত্রলীগ যুবলীগ পর্যন্ত যা হবার হয়েছে। আর বেশি দূর বাড়ার দরকার নেই। কেন সমস্যা কোথায়? এই সরকারকে যারা ভালোবাসেন তাদেরই তো উচিত দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার জন্য জোরেশোরে অভিযান চলুক। সরকার ও দুর্নীতিকে একসাথে ভালোবাসা যায় না। সেজন্য এই অভিযানে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেকেই টেনশনে। কেন? কেন ভেতরে ভেতরে চাওয়া যে অভিযান শেষ হোক? তাহলে কি সর্ষের ভিতরে ভূত বসে আছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি, লুটপাট, ক্যাসিনো বা জুয়ার সাথে যারাই জড়িত তারা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগরই লোক। কিন্তু যখনই এসব লোক ধরা পড়ছে তখন ক্ষমতাসীনরা তাদের অতীত নিয়ে টানাটানি করছে। তার পূর্ব পরিচয়টাকেই তারা বড় করে দেখছে। ফলে বর্তমান পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিষয়টি খুবই হাস্যকর। তারা বলেন, কখন কে কার দায়িত্ব পালন করেছে সেটা বড় বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে বর্তমানে সে কি করছে। এছাড়া সারা পৃথিবীতে দলবদল একটা চলমান বিষয়। একদল থেকে অন্য দলে যাবে, আবার সরকারি চাকরী ছেড়ে রাজনীতি করবে, এটাকে তো আইন করে বন্ধ করা হয়নি। তারা বলছেন, যে লোকটা অতীতে কারো নিরাপত্তার দািয়ত্বে ছিল সে বর্তমান সরকারের আমলে এসে চোর হয়ে গেল। এটার জন্য দায়ী কে? রাজনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটাই হচ্ছে রাজনীতির জন্য দুভ্যাগ্য। অতীতের পরিচয়টাকে সামনে আনার কারণেই অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। কারণ অতীতটাকে দিয়েই তার বর্তমান বড় অপরাধকে ডেকে দেয়া হচ্ছে। রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। ফলে এসব অপরাধী ধরা পড়লেও বিচারের নামে প্রহসন চলে। আবার বিচার হলেও সরকার তাদের ক্ষমা করে দিচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১৪ দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৪ দলের বৈঠকে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকদের বলেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা ও নির্লিপ্ততার জন্যই রাজধানীতে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ জুয়া খেলা ও ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, কিছু রাজনৈতিক কর্মী দুর্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। আমরা বিস্মিত হয়েছি, দুঃখ পেয়েছি। আমরা আরও বিস্মিত হয়েছি, ঢাকা শহরে প্রশাসনের নাকের ডগায় কীভাবে অবৈধ ক্যাসিনোর কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। প্রশাসনের ব্যর্থতা ও নির্লিপ্ততার জন্য নিন্দা করি। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো। কোনও দুর্বৃত্তকে যাতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। প্রশাসনের মধ্যেও দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ায় আমরা নিন্দা জানাই এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম বলেন, সমাজের যে কোনও অসঙ্গতি, সমাজের কোনও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমরা বারবার বলে আসছি। আমরা আনন্দিত হয়েছি, সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। নাসিম বলেন, অভিযানের পরিস্থিতিতে কোনও অশুভ শক্তি যাতে ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে না পারে, এজন্য আমাদের নিবেদিত কর্মীরা সংগঠিত থাকবেন, সতর্ক থাকবেন। এই লড়াইয়ে আমরা অবশ্যই জয় লাভ করতে চাই।
সূত্র মতে, যুবলীগের ক্যাসিনো বাণিজ্যের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক বিষয়ে এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘ক্যাসিনো থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেতেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার থানার ওসি, এডিসি এবং ডিসি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) নামে চাঁদা তোলা হতো। এমনকি ঢাকা মহানগর পুলিশের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়মিত ক্যাসিনো থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। পুলিশের প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তা বিদেশের ব্যয়বহুল হাসপাতালে চিকিৎসা করান। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের পর গ্রেফতার হন সংগঠনটির আরেক প্রভাবশালী নেতা এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। যিনি টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ হিসেবে সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত। তার চাঁদাবাজির ভাগ সরকারের শীর্ষ মহল থেকে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে যেত বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে এখন টেনশনে আছেন। অনেকেই বরছেন, এরা সবই করেছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নাকের ডগায়। শুধু তাই নয়, এদের ব্যবহার করেই আওয়ামী লীগ তার সাংগঠনিক তৎপরতা অনেকাংশে চালিয়ে এসেছে। কাজেই তাদের সবার কার্যকলাপ সম্পর্কে তারা কিছু জানতেন না এবং হঠাৎ করে এখন জেনেছেন, এটা তো ঠিক নয়।