সংগ্রামী সাধক হজরত খান জাহান আলী (রহ.)
আহমদ মনসুর : বাংলা দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে হজরত খান জাহান আলী (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পীর মুরশীদ ইসলাম প্রচারে তাঁদের জীবন কাটিয়েছেন। উত্তর বঙ্গের বগুড়া ও মহাস্থান গড়ে এসেছিলেন বাবা আদম, শাহ সুলতান ও তুরকান শাহ; রাজশাহীতে হজরত শাহ মাখদুম রুপোশ, সিলেটে হজরত শাহজালাল, পাবনায় হজরত শাহ দৌলাহ, যশোর ও উত্তর খুলনায় বড়খান গাজী এবং দক্ষিণ যশোর ও গোটা খুলনার জন্য এসেছিলেন হজরত খান জাহান আলী (র.)।
দেশের প্রাচীন ইতিহাস হজরত খান জাহান সম্পর্কে নীরব। তাঁকে চিনতে হয় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ষাট গুম্বুজ মসজিদ, ঘোড়া দিঘি, ঠাকুর দিঘিসহ অসংখ্য দিঘি, মসজিদ ও রাস্তাঘাটের মধ্য দিয়ে। তাঁর পরিচয় মেলে তাঁর অনুসারীদের কীর্তিকলাপের মধ্য দিয়ে। ‘খলিফা আবাদ’ রাজ্যের প্রশাসক বা রাজা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ। ফলে ঐতিহাসিক ভাবে তার সম্বন্ধে প্রচুরভাবে তথ্য অবগত হওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে না না কিংবদন্তী, যা তাঁর মহত্ব ও জন প্রিয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
হজরত খান জাহান (র.) ২৬ জিলহজ্জ, ২৪ শে অক্টোবর ১৪৫৯ সালে লাভ করেন। আধুনিক বাগেরহাটে ও হাউলি মোকামে তাঁর মাজার অবস্থিত। সমসাময়িক কালের বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায় তিনি গৌড় সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্ব কালে (১৪৪২- ১৪৫৯) বাহেগরহাট শহরে ইন্তেকাল করেন।
তাঁর জন্ম স্থান সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। তাঁর কার্যবলী থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি দিল্লী অথবা জৌনপুর থেকে বাংলায় আসেন। খান- ই জাহান উপাধি থেকে অনেকে মনে করেন তিনি প্রথম জীবনে কোন সুলতানের মন্ত্রী বা সেনাপতি ছিলেন। পরে ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁকে নি¤œ বঙ্গে পাঠান হয়। তিনি ছিলেন রাজা দরবেশ।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক দিকে ছিলেন রাজা অন্য দিকে দরবেশ। মানুষের কাছে তিনি তরিকার পীর বলে পরিচিত। তবে তিনি কোন তরিকার পীর ছিলেন তা জানা যায় না। তাঁর কার্যাবলী থেকে স্পষ্ট যে তিনি মসজিদ ভিাত্তক সমাজ সভ্যতার পুনর্গঠন প্রয়াসী ছিলেন। তার প্রমাণ তাঁর দরবার ঘর যেটি ছিল মসজিদ এবং বিভাগ পূর্ব বাংলাদেশের মধ্যে এমনকি সারা উপ-মহাদেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম মসজিদ ষাট গুম্বুজ মসজিদ। এ ছাড়া যশোহর বার বাজার থেকে বাগের হাট এবং মুরলী থেকে বেদকাশী পর্যন্ত তাঁর রাস্তা, দিঘি,মসজিদ এবং বিভিন্ন কীর্তি কাহিনী তাঁর মসজিদ ভিত্তিক সমাজ গঠনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পীর দরবেশদের ইসলাম প্রচারের সাথে খান জাহান (র.)-এর ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি ছিল কিছুটা ভিন্ন। অন্য সব স্থানেই পীর আওলীয়াদেরকে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজাদের সাথে যুদ্ধ করে কেউ শহীদ, কেউ গাজী হয়ে মুসলমানদেরকে রক্ষা করেছেন, ইসলাম প্রচার করেছেন। কিন খান জাহান কে এ ধরনের কোন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়নি।
অবশ্য তাঁর পূর্বে এ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে ধর্ম প্রচারক গাজী সাহেবদেরকে হিন্দু রাজাদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। দক্ষিণা রায়ের সাথে গাজীদের যুদ্ধের বর্ণনা নিয়ে রচিত বিভিন্ন পুঁথি এর সত্যতা প্রমাণ করে।
খান জাহান যখন বাংলার দক্ষিণে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন তখন সাথে নিয়ে আসেন প্রচুর ধন সম্পদ ও আনুমানিক ষাট হাজার সৈন্য। এ সব সৈন্যদেরকে তিনি রাস্তা ঘাট, দিঘি, পুকুর মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ ও খনন কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের সর্বত্র একটি জনসেবা এবং কল্যাণমূলক আবহাওয়া বহাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে তাঁর এলাকায় তাঁর কল্যাণ মূলক কাজে সন্তুষ্ট হয়ে জনগণ পীরকে কল্যাণ ব্রতী শাসক - দরবেশ হিসেবে গ্রহণ করেন।
তিনি যেখানেই গেছেন সেখানে প্রথমেই জনকল্যাণমূলক কাজে হাত দিয়েছেন। তিনি রাস্তা নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য দিঘি খনন ও মসজিদ নির্মাণ করে সাধারণ জনগণের ভক্তি অর্জন করেছেন; তাদের হৃদয়ের কাছে পৌঁছেছেন। ফলে অতি সহজেই তার নৈতিক চরিত্র ও ধর্মীয় শক্তির প্রভাবে অসংখ্য হিন্দু, বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেন।
হজরত খান জাহানের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর মাজার গাত্রের শিলা লিপি থেকে। একখানি শিলায় লেখা রয়েছে -“আর আল মুখলিসু লি উলামাইর রাশেদীন, আল মুবদেগু লিল কুফ্ফারে ওয়াল মুশরিকীন, আল মুইনু লিল ইসলামে ওয়াল মুসলিমিনি। ...যিনি সত্যের পথানুসারী, আলেম দিগের প্রকৃত হিতাকাংখী, আল্লাহর নাফরমানদিগের প্রতি ঘৃণাপোষণকারী, যিনি ইসলাম ও মুসলমানদিগের সদা সাহায্যকারী। ...”
হজরত পীর সাহেব তাঁর নব দীক্ষিত মুসলমানদেরকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা ও তালিম দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি যে স্থানটি বেছে নেন তা পরবর্তী সময় তালিম পুর নামে পরিচিতি লাভ করে। এ ভাবে তিনি ইসলাম প্রচার ও জনগণের খেদমত করে ইতিহাসে এক অমর ব্যক্তিত্ব হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের শ্রদ্ধালাভ করে আসছেন।
আগেই বলা হয়েছে খান জাহান (র.) সুলতান মাহমূদ শাহের সম সাময়িক ছিলেন। কিন্তু তিনি সরাসরি ভাবে কার অধীনস্ত কর্মচারী বা প্রতিনিধি ছিলেন বলে কেউ মনে করে না। তবে তিনি যে স্বয়ং সিদ্ধ সুলতান বা রাজ দরবেশ ছিলেন তাতে সবে একমত পোষণ করে থাকেন।
পীর খান জাহান দীন প্রচারের জন্য জনহিতকর কাজকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারের প্রয়াসে মানুষকে মসজিদমুখী করার প্রচেষ্টা চালান এবং এ জন্যই তিনি প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করেন। তাঁর দীনি সংস্কারের দিকগুলি সরাসরি মানুষের নজরে পড়ে না বরং তাঁর জনহিতকর কাজের চিহ্ন রাস্তা ঘাট নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, ও দিঘি খনন ইত্যাতি মানুষকে বেশি আলোড়িত করে।
তিনি যে কী পরিমাণে মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা অনুমান করা চলে তাঁর মুরীদদের দিকে তাঁকালে। এ সমস্ত সহচরগণ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ছিলেন এবং এক এক এলাকায় গমন করে পীর সাহেবের মতই দিঘি, মসজিদ ইত্যাদি নির্মান করে এলাকা বাসীদেরকে তাঁদের অনুরক্ত করতে সক্ষম হন।
তাঁর অসংখ্য অনুচরদের মধ্যে মুহাম্মদ আবু তাহের,গরীব শাহ, বাহরাম শাহ, বোরহান শাহ, হজরত সৈয়দ আহমদ প্রভৃতি তাঁর কালে ও পরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। এদের মধ্যে প্রিয় মুরীদ ও মহাপাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন হজরত আবু তাহের ওরফে পীর আলী সাহেব। তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি এমনই ধর্ম প্রাণ হয়ে ওঠেন যে সবাই তাঁকে পীর আলী নামে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতে থাকে। এমনকি বহু হিন্দু তাঁর কাছে মুসলমান হয়ে পীরালী নাম পরিচিত হন।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় হিজরী ৭১০/৭২০ সালে খুলনা জেলা মুসলিম শাসনের আওতায় আসে। সে সময় থেকে খুলনা জেলা বরাবরই মুসলিম শাসনের আওতা ভুক্ত ছিল বলে অনুমান করা যায়। ইসলাম প্রচারে মুসলিম শাসকগণ যে ভূমিকা রাখেন তার চাইতে অধিক ভূমিকা গ্রহণ কররন পীর দরবেশগণ। বিশেষভাবে হজরত খান জাহানের সময়ই খুলনা জেলায় ইসলাম প্রচার অত্যন্ত বেগবান হয়।
হজরত খান জাহানের কীর্তিসমূহ বারবার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে ইসলাম প্রচার করতে হয় এ বিষয়টি। যদি রাজার ক্ষমতা ও দরবেশর আধ্যাত্মিক শক্তি তথা ইসলামের রূহানী শক্তি এক বিন্দুতে মিলিত হয় তা হলে জগতের সমস্ত শক্তিই তার কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে ধন্য হয়। তার উপযুক্ত প্রমাণ হজরত খান জাহান (র.)।