শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভর্তি পরীক্ষার জন্য বুয়েটে আন্দোলন ২ দিন স্থগিত

# ৫ দফা মেনে নিয়ে কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তি
# সন্ত্রাসী ও দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে -ভিপি নূর
# শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে -প্রগতিশীল ছাত্রজোট
স্টাফ রিপোর্টার : ভর্তি পরীক্ষার জন্য বুয়েটে চলমান আন্দোলন দুই দিনের জন্য স্থগিত করেছে শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কিনা এ বিষয়ে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হলেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শিথিল করার ঘোষণা দেয়ায় সেই উৎকণ্ঠা দূর হলো। এ দিকে শুক্রবার আলোচনার ধারাবাহিতকায় শিক্ষার্থীদের ৫ দফা মেনে নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অনিয়মিত শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। প্রথম দিনেই ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকসহ ৩টি কক্ষ সিলগালা করা হয়েছে। এ দিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে বলে জানিয়েছেন ডাকসু ভিপি নূর। তিনি সন্ত্রাসনির্ভর ও দলীয় লেজুরভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান।
ভর্তি পরীক্ষার কারণে আন্দোলন শিথিল করার ঘোষণা দেয়ায় নির্ধারিত সময়েই বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এই ঘোষণা দেন। গতকাল দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তবে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আজ ১৩ ও আগামীকাল ১৪ অক্টোবর আন্দোলন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন তারা ভর্তিচ্ছুদের সহযোগিতা করবেন বলেও জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে শিক্ষকদের প্রতিও তাদের আস্থার কথা জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা জানায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ১২ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতার চেষ্টা করবো। আমাদের যে যার অবস্থান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব। এর আগে শুক্রবার আমরা ক্যাম্পাসের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ৫ দফা দাবি জানিয়ে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবিকৃত ৫ দফা পূরণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
শিক্ষাথীরা জানায়, আমরা বুয়েট প্রশাসনের কাছে আবরার হত্যাকা-ে জড়িতদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে মর্মে নোটিশ জারির কথা বলেছিলাম। এরই মধ্যে প্রশাসন তাদের পদক্ষেপের কথা নোটিশ আকারে জানিয়েছেন। আবরারের পরিবারের মামলার সব খরচ বহন ও তার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বলে ছিলাম। সেটি ও তারা মেনে নিয়েছেন। আর বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে হলগুলো থেকে অছাত্র ও অবৈধভাবে হলের সিট দখলকারীদের উৎখাত করা, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যালয় সিলগালা করার কথা জানিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এরই মধ্যে তিতুমীর হল, আহসান উল্লাহ হলসহ অন্যান্য হলে উৎখাত অভিযান শুরু করেছে।
বুয়েটে আগে ঘটে যাওয়া সব শিক্ষার্থী নির্যাতন, হয়রানি ও ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য বিআইআইএস অ্যাকাউন্টে একটি কমন প্ল্যাটফর্ম যুক্ত করা এবং এর পূর্ণ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করে শাস্তি দিতে একটি কমিটি গঠন করা, প্রত্যেক হলের সব তলায় সিসিটিভি ক্যামেরা যুক্ত করা ও সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছিলাম। এর মধ্যে কবি নজরুল হলে নতুন করে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। অন্যান্য হলগুলোতে একই কাজ শুরু হবে। আর যেসব ক্যামেরা বিকল সেসব রিপ্লেসমেন্ট করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রশাসন।
পরে শনিবার সকালে দাবিকৃত পাঁচ দাবি পুরণে নোটিশ প্রকাশ করে বুয়েট প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ দায়েরের জন্য একটি কমন প্লাটফর্ম এন কথা বলেছিলাম। আমরা আইসিটি বিভাগে যোগাযোগ করেছি। তারা জানিয়েছেন বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। এক সপ্তাহ লাগতে পারে। আমরা আশা করছি সেটি এক সপ্তাহের মধ্যে সমাধান হবে।
তারা বলেন, প্রথমে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তার সহযোগিতার ফলে অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। একই সাথে ভিসি স্যারকেও ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদেরকে শুক্রবার বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়েছেন।
তারা বলেন, আমাদের দাবি মূলত ১০ দফা আদায়ের। আমরা আন্দোলন স্থগিত করছি না। ভর্তি পরীক্ষাথীদের কথা মাথায় রেখে আন্দোলন শিথিল করছি মাত্র। ১৩ ও ১৪ তারিখ শুধু আন্দোলন স্থগিত থাকবে। আর ১০ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এই দাবিতে শনিবার সকালে টানা ৬ষ্ঠ দিনের মতো আন্দোলনে নামেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। তবে ভর্তি পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের সম্মান জানিয়ে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন তারা।
ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ সিলগালা: বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জামী-উস সানির কক্ষসহ দু’টি হলের তিনটি কক্ষ সিলগালা করে দিয়েছে প্রশাসন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়। সিলগালা করা কক্ষগুলোর মধ্যে আহসান উল্লাহ হলের দুটি এবং শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, তিনটি রুম সিলগালা করা হয়েছে। অছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, আহসান উল্লাহ হলের ১২১ নম্বর কক্ষ, জামী-উস সানির ৩২১ নম্বর কক্ষ, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আবরার হত্যা মামলার আসামী মেহেদী হাসান রাসেলের ৩০১২ নম্বর কক্ষ সিলগালা করা হয়েছে। এসব কক্ষ রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হতো। অন্যান্য হলের ছাত্রলীগের ব্যবহৃত কক্ষগুলোও আগামীকালের মধ্যে সিলগালা করা হবে।
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে বেশ কয়েকদিন ধরে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। শনিবার দাবিগুলোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। শনিবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেও ১৪ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখে আন্দোলন দুই দিনের জন্য শিথিল করেন। এর পরই ছাত্রলীগের তিনটি কক্ষ সিলগালা করে কর্তৃপক্ষ।
সভাপতি জামী-উস সানি বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সিলগালা করার সময় আমি রুমে ছিলাম। হল প্রশাসন এসে রুমটি সিলগালা করেছে। যারা অনিয়মিত, তাদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রত্ব থাকলেও আমি নিয়মিত ছাত্র নই।
অনিয়মিত শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের বুয়েট ছাড়ার নির্দেশ: মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের আজ রোববার দুপুর ১২টার মধ্যে বুয়েট ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ লক্ষ্যে বুয়েটের বিভিন্ন হলে বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
এর আগে বুয়েটের হলগুলো থেকে সিট দখলদারিত্ব উচ্ছেদ ও সাংগঠনিক ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিস সিলগালা করার নির্দেশনা জারি করে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. সাইদুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেন।
এতে বলা হয়, অবৈধভাবে যারা হলের সিট দখল করে আছে, তাদেরকে সিট খালি করা, সাংগঠনিক ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিস কক্ষ বন্ধ করে তা সিলগালা করার জন্য ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ব্যবস্থা নেবেন।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে র‌্যাগিং বা ছাত্র নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ডিসিপ্লিনারি কমিটির মাধ্যমে তা দ্রুত বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
১৪ অক্টোবর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল বিকেলে বুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান একথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, একাডেকিম কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আমরা ঘোষিত সময়েই পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বুয়েট প্রকাশিত নোটিশ থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক শ্রেণীতে বিভিন্ন অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের লেভেল-১১ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় ১২ হাজার ১শ’ ৬১ পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। তার মধ্য থেকে ১০৫০ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
পাঁচ দফা দাবি মেনে নিয়ে বিজ্ঞপ্তি: বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি মেনে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। যেসব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে, তা হলো- হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে সাময়িক বহিষ্কার করা হবে এবং পরে অভিযোগপত্রে যাঁদের নাম আসবে, তাঁদের স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে; আবরার হত্যা মামলার সব খরচ বুয়েট প্রশাসন বহন করবে ও তাঁর পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বুয়েট প্রশাসন বাধ্য থাকবে; বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ; বুয়েটে র্যাগের নামে নির্যাতনের ঘটনাসংক্রান্ত অভিযোগ প্রকাশের জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা ও অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি এবং সব হলের দুই পাশে প্রতি ফ্লোরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি: ভিপি নুর; ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক। সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং সন্ত্রাসী ও দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য সবার দাবি তোলা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভিপি নুরুল হক এসব কথা বলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, ভিপি নুরুল হকের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, ফারুক হাসান, মশিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
ভিপি নুরুল হক বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা শুধু সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা আসলে সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন। আবরার ফাহাদকে কোন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হত্যা করেছে, সবাই ভালোভাবেই অবগত আছেন। ছাত্ররাজনীতি সব দেশেই আছে, সব প্রতিষ্ঠানেই ছিল, আছে ও থাকবে। সুস্থধারার মেধাভিত্তিক ছাত্রনেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করতে হবে।
নুরুল হক অভিযোগ করে বলেন, আজকের কলুষিত ছাত্ররাজনীতির জন্য শুধু ছাত্ররাই দায়ী নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। কারণ তারা তাদের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ আবাসিক হল প্রশাসনের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ চালাচ্ছে। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকেরা নির্লজ্জের মতো জনগণের টাকায় বেতন নেন। তাঁরা আদৌ শিক্ষক কি না, সেটি আজকে জাতিকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। সমাজ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা যখন নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে তাঁদের পছন্দের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলো নিয়ন্ত্রণের অশুভ তৎপরতা চালান, সেটিও জাতিকে ভাবিয়ে তোলে।
ডাকসু ভিপি বলেন, ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৫১টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে শুধু একটি ঘটনা ছাড়া কোনোটিতেই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণেই বারবার এসব হত্যাকা- ঘটছে। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকা- সারা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। আমরা চাই, এ ধরনের হত্যাকা- এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের যে দখলদারি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও আধিপত্য বিস্তারের ধারা বন্ধ হোক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক।
সাংবাদিক সম্মেলন থেকে পাঁচ দফা দাবি জানান ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। এগুলো হলো আবরার হত্যাকা-সহ সব ছাত্র হত্যার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করা, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণে আবাসিক হলগুলোতে গণ রুম-গেস্টরুম ও ছাত্রসংগঠনের দখলদারি বন্ধ করে প্রশাসনের মাধ্যমে প্রথম বর্ষ থেকে সিট বণ্টনের ব্যবস্থা, সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন, ভারতের সঙ্গে করা দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি সব চুক্তি অবিলম্বে বাতিল এবং শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসন নিশ্চিত করতে ভিসিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির ওপর নয়, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে: বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তারা বলছে, বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির ওপর নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের পক্ষ থেকে এই দাবি জানানো হয়। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে জোটের কেন্দ্রীয় কমিটি এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রগতিশীল ছাত্রজোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সভাপতি আল কাদেরী জয়। সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ রানা, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি ইকবাল কবীর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এটি একটি ভয়ংকর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এবং সব ধরনের বিরোধী মত ও তার ভিত্তিতে সংগঠিত শক্তিকে দমনের হাতিয়ারমাত্র; এটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি প্রতারণাও বটে। আবরার ফাহাদ হত্যাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েটে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ছাত্রলীগের একচ্ছত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও দখলদারির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির প্রতি নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী বুয়েটে আগে থেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ আর গত এক দশকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতিই ছিল না। সেখানে রাজনীতির নামে ছিল ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকা- আর নির্যাতন। বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠন ওই ক্যাম্পাসে কাজ করতে গেলে নির্মমভাবে তাদের দমন করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নিহত আবরার ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, যা একটি রাজনৈতিক বিষয়। এই চুক্তির বিরোধিতা করা নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। এই অধিকার যারা দমন করে, তারাই আবরারের হত্যার জন্য দায়ী। সন্ত্রাসী কর্মকা- বা হত্যাকা-ের দায় ছাত্ররাজনীতির ওপর চাপিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের অসন্তোষকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বেশ কিছু পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ। কিন্তু তাতে কি সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের দৌরাত্ম্য কমেছে? তাৎক্ষণিকভাবে চমকপ্রদ মনে হলেও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এর আগেও বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন তকমা দিয়ে মারধর করা হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে বুয়েট প্রশাসন কখনোই ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের এই নির্লিপ্ততা প্রকারান্তরে পৃষ্ঠপোষকতারই নামান্তর। এখানে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এই ঘটনার মূল উৎস যে অগণতান্ত্রিক চর্চা, সেই চর্চাকেই আড়ালে আরও শক্তিশালী করার আয়োজন করেছে বুয়েট প্রশাসন। ইতিমধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৫৮টি টর্চার সেলের কথা পত্রিকায় এসেছে। এই টর্চার সেলগুলোয় অকথ্য ভাষায় গালাগালি এবং শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চলে। এর মাধ্যমে তারা একদল মৃত মানুষ তৈরি করতে চায়, একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখে, যাতে কেউ প্রতিবাদ না করতে পারে। শিক্ষার্থীদের এই ভয়ই ক্ষমতাসীনদের শক্তি ও লুটপাটের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে।
উল্লেখ্য, ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে গত রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরদিন সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ লাশের ময়নাতদন্ত করেন। তিনি বলেন, ছেলেটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামী করে পরদিন সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ্। আবরার হত্যাকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ