নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ আসামীর মৃত্যুদন্ড
তোফাজ্জল হোসেন কামাল, ঢাকা ও এম এ হায়দার, ফেনী : ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি। এক প্রতিবাদী নারী। মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত তারই প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলে যে প্রতিবাদের ধারা শুরু করেছিলেন, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সময় সে ধারাতেই নুসরাত দৃঢ় ছিলেন। শেষ বেলাতেও বলে গেছেন, ‘প্রতিবাদ করেই যাবেন’। তার প্রতিবাদের ধারাতেই দেশজুড়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল জনতা। তাদের জন্য স্বস্তির খবর দিয়েছে আদালত, তোলপাড় তোলা ওই ঘটনার উপযুক্ত রায় পেয়েছে প্রতিবাদীরা। এই রায় দেশের ইতিহাসে মাইলফলক। আদালত নুসরাতকে দিয়েছে বিশেষ চরিত্রের অধিকারী নারীর খেতাবও। অযুত-নিযুত চক্ষু যুগলের নজর যখন ফেনীর দিকে, তখন আদালতের বিচারকও তাদের হতাশ করেননি। তাদের তেষ্টা মিটিয়েছেন “আইনী”ভাবেই। মুখিয়ে থাকাদের মুখেও হাসি ফুটিয়েছেন বিজ্ঞ বিচারক।
দেশজুড়ে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস যখন ফেলছিলেন, তখন প্রিয় সন্তানহারা নুসরাতের পিতামাতাসহ স্বজনরাও ....।
এবার মূল প্রসঙ্গ।
প্রায় সাত মাস আগের তোলপাড় তোলা ঘটনা। অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ১৬ আসামীর সবাইকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া ওই হত্যাকা-ের সাত মাসের মাথায় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ গতকাল বৃহস্পতিবার জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন। দন্ডিত এই ১৬ আসামীর মধ্যে রয়েছেন নুসরাতের শিক্ষক- সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, যিনি এই হত্যাকান্ডের হুমুকদাতা। রয়েছেন মাদরাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন এবং সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম, যারা হত্যাকান্ড বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।
নুসরাতের তিন সহপাঠী কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন, যারা একইসঙ্গে আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন; নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর যারা ফের স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পরীক্ষার হলে বসেছিলেন, সেই সঙ্গে মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং অধ্যক্ষ সিরাজের কয়েকজন সহযোগী, যারা এই হত্যাকান্ডকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাদের সবার সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে আদালতে।
বিচারক তার রায়ে বলেছেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা ফেনী জেলার অন্যতম বড় বিদ্যাপীঠ। দুই হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী সেখানে পড়ছে। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকায় ‘কালিমা লিপ্তকারী’ এ ঘটনা ‘বিশ্ব বিবেককে’ নাড়া দিয়েছে।“নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজদ্বীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে ইতোমধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামীদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয় বিধায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামীদের প্রাপ্য।”
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ (১)/৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ১৬ আসামীর সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদন্ড দিয়েছেন বিচারক। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আসামীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দন্ডাদেশ কার্যকর করতে এবং জরিমানার অর্থ আদায় করে নুসরাতের বাবা-মাকে দিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।
এর আগে বেলা পৌনে ১১টার দিকে মামলার ১৬ আসামীকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রিজন ভ্যানে করে ফেনী জেলা কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ ১১টা ৭ মিনিটে আদালতে আসেন। তিনি ১২ মিনিটের বেশি সময় ধরে রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান। জনাকীর্ণ আদালতে এ সময় আইনজীবী, পুলিশ, পিবিআই, সাংবাদিকরা ছিলেন। বিচারক তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বিচারক ১৬ আসামীরই ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার পর বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ সব আসামীকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। কারাগারের দিকে যাওয়ার পথে স্বজনা আসামীদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে। অনেক স্বজনকে ভ্যানের পাশে ঝুলতে দেখা গেছে। অনেককে ভ্যানের পেছনে ছুটতেও দেখা গেছে।
নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত আসামীদের সাজা কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।
বাদীপক্ষের কৌঁসুলি এম শাহজাহান সাজু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই রায়কে বলেছেন ‘দৃষ্টান্তমূলক’। ৬২ কার্যদিবস শুনানির পর এই রায় দেওয়া হয়েছে, যাকে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’ বলেছেন।
অন্যদিকে আসামীপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট নন, রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। নিয়ম অনুযায়ী এই রায়ের বিরুদ্ধে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন তারা।
এ মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, “আমরা যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম সেটাই হয়েছে। আমরা পেশাদারিত্বের সাথে মেধা দিয়ে কাজ করেছি। প্রত্যেকের পরিবারে নুসরাত আছে, আমরা সে ভাবনা নিয়েই কাজ করেছি।”
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা মামলা করার পর গত ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে অধ্যক্ষ সিরাজকে। সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পক্ষে নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদরাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ।
এর মধ্যেই ৬ এপ্রিল পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষা কেন্দ্র সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে ঢাকায় এনে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল; টানা পাঁচ দিন যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।
নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দুদিন পর তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামী করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত হয়।
নুসরাতকে যখন ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছিল, তখনও তিনি বলছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করে যাবেন। প্রতিবাদী এই তরুণীর জন্য প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয় গোটা দেশজুড়ে।
৭ এপ্রিল নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দেন, যাতে তিনি অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যান।
নুসরাত হত্যার মামলটি তদন্ত প্রথমে করছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন; কিন্তু ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকান্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপর। পিবিআইর পরিদর্শক শাহ আলম এজহারভুক্ত আট আসামীর সঙ্গে আরও আটজনকে যুক্ত করে ১৬ জনকে আসামী করে গত ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
তার পরের মাসে ২০ জুন ১৬ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬ আসামীর বিচার। ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।
অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দী নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে আলাদা মামলা হয়েছে।
দ-িত ১৬ আসামী
অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আলম, সাইফুর রহমান, মো. জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, মো. আফসার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মো. শামীম, মাদরাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমিন ও মহিউদ্দিন শাকিল।
ঘটনাক্রম
২৭ মার্চ: নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা, অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার
৬ এপ্রিল: পরীক্ষার হল থেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন
৮ এপ্রিল: ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে নুসরাত, মামলা দায়ের
১০ এপ্রিল: নুসরাতের মৃত্যু, মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর
২৯ মে: ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬ জনকে আসামী করে অভিযোগপত্র দাখিল
৩০ মে: হাকিম আদালত থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর
১০ জুন: অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল, গ্রেপ্তার পাঁচজনকে অব্যাহতি
২০ জুন: ১৬ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
২৭ জুন: বাদীর সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু
৯ সেপ্টেম্বর: সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ
৩০ সেপ্টেম্বর: রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ
২৪ অক্টোবর: রায়ে ১৬ আসামীর সবার মৃত্যুদ-
যেভাবে নুসরাত হত্যা
নুসরাত জাহান রাফি তারই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেই চক্ষুশূল হয়েছিলেন আসামীদের। সাত মাস আগে সারাদেশে আলোড়ন তোলা সেই হত্যাকান্ডের মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নুসরাতের মায়ের করা মামলার পর থেকেই ক্ষিপ্ত হন আসামীরা। অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর আসামীদের কয়েকজন কারাগারে তার সঙ্গে দুই দফা দেখা করতে গিয়ে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা পেয়েই মাঠে নামেন। আর এই পরিকল্পনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগতরা, যাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ছাত্র, অধ্যক্ষের আত্মীয় এমনকি নুসরাতের সহপাঠীও ছিলেন।
পিবিআইয়ের ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে অধ্যক্ষ সিরাজকে এক নম্বর আসামী করা হয়। অভিযুক্ত ১৬ জন আসামীর মধ্যে ১২ জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।
মামলার অভিযোগপত্রে নুসরাতকে হত্যার সচিত্র ঘটনাপ্রবাহও তুলে ধরে পিবিআই।
মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে নুসরাতের মায়ের করা মামলার ভিত্তিতে অধ্যক্ষ সিরাজকে ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আর এরপরই সিরাজের পক্ষ নেয় স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদরাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ ছিল।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম (নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন), নূর উদ্দিন (অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ), ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের (নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু) ও ইফতেখার উদ্দিন রানা জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। তখনই অধ্যক্ষ তার মুক্তির চেষ্টা এবং মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে বলেন। হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর পরও মামলা না তোলায় আসামীরা আলোচনা করে ‘প্রয়োজনে যে কোনো কিছু’ করার পরিকল্পনা করে। ৩ এপ্রিল শামীম, নূর উদ্দিন, আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে আবার অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। সিরাজ তখন নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন আর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর নির্দেশ দেন। সেদিন বিকালে মাদরাসার পাশে একটি টিনশেড কক্ষে শামীম, নূর উদ্দিন, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (নুসরাতের সহপাঠী), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি ও নুসরাতের সহপাঠী) ও কামরুন নাহার মনি (আসামী শামীমের দূরসম্পর্কের ভাগ্নি, নুসরাতের সহপাঠী) ও আরও কয়েকজন বৈঠক করে। নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় ওই বৈঠকেই ।
অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তির দাবিতে পালিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে মদদ দেওয়া সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম হত্যাকান্ড ঘটাতে শামীমকে ১০ হাজার টাকা দেন। সেখান থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে কামরুন নাহার মনি দুটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনেন।
৪ এপ্রিল রাতে মাদরাসার ছাত্র হোস্টেলে বসে আবারও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন আসামীরা। পরদিন ভূইয়া বাজার থেকে এক লিটার কেরোসিন কিনে নিজের কাছে রেখে দেন শামীম। ৬ এপ্রিল সকাল ৭টার পর মাদরাসা প্রাঙ্গণে যান শামীম, নূর উদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদের। সকাল সোয়া ৯টার মধ্যে আসামীরা পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার অবস্থানে চলে যান। শামীম পলিথিনে করে আনা কেরোসিন অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাসে নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেন। আর মনির কেনা দুটি এবং বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি বোরখা এবং চার জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় রাখা হয়। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরখা ও হাতমোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান নেন।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপি তাকে মিথ্যা কথা বলে ছাদে নিয়ে আসেন। নুসরাতকে বলা হয়, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে কারা যেন মারছে। নুসরাত ছাদে যাওয়ার সময় পপি তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। নুসরাত তাতে রাজি না হয়ে ছাদে উঠে যান। মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদও সে সময় নুসরাতের পিছু পিছু ছাদে যান।
ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেন এবং কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে শামীম বাঁ হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরেন এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছনে নিয়ে আসেন। পপি তখন নুসরাতের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দেন। জোবায়ের ওড়না দুই ভাগ করে ফেলেন। পপি ও মনি ওড়নার একাংশ দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে বেঁধে ফেলেন। অন্য অংশ দিয়ে নুসরাতের পা বেঁধে ফেলেন জোবায়ের। জাবেদ পায়ে গিট দেন। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ওপর শুইয়ে ফেলেন। শাহাদাত তখন নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখেন। নুসরাতের বুকের ওপর চেপে ধরেন মনি। পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। এক আসামী নুসরাতের হাত-মুখ, আরেকজন তার পা, অন্যজন তার বুকে চেপে বসে।
জাবেদ বাথরুমের পাশে গ্লাসে রাখা কেরোসিন এনে ঢেলে দেন নুসরাতের গায়ে। শামীমের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ জ্বেলে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুন ধরানোর পর প্রথমে ছাদ থেকে নামেন জোবায়ের। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী মনি ‘চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে পপিকে নিচে নিয়ে যান। তারা নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান। জাবেদ ও শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলেন। তারপর জাবেদও পরীক্ষার হলে ঢুকে যান। শামীম তার বোরখা ফেলে দেন মাদরাসার পুকুরে। জোবায়ের মাদরাসার মূল গেইট দিয়ে বের হয়ে যান এবং বোরখা ও হাতমোজা ফেলে দেন সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে। হত্যাকান্ড শেষ করে আসামীরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন।
এদিকে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত নিচে নেমে এলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নেভায়। নূর উদ্দিনও ওই সময় নুসরাতের গায়ে পানি দেন। আর হাফেজ আব্দুল কাদের ফোন করে নুসরাতের ভাই নোমানকে জানান, তার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
দেহের ৮০ শতাংশজুড়ে আগুনের ক্ষত নিয়ে নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে ঘটনা একইভাবে বর্ণনা করেন বলে অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে।
আসামীদের কার কী ভূমিকা
নুসরাত জাহান রাফিকে তারই মাদরাসার অধ্যক্ষের নির্দেশে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। মামলার তদন্তে এসেছে, আসামীরা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার অনুগত ছিলেন। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় তারা নুসরাতের ওপর ক্ষিপ্ত হন। যার ফলশ্রুতিতে প্রাণ দিতে হয় নুসরাতকে।
মামলার অভিযোগপত্রে নুসরাত হত্যায় আসামীদের কার কী ভূমিকা ছিল তা তুলে ধরা হল-
অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা: সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলা হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও নির্দেশ দিয়েছেন বলে অভিযোগ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, তাতে কাজ না হওয়ায় ভয়-ভীতি দেখানো এবং পরে নুসরাতকে হত্যার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন তিনি।
নূর উদ্দিন: নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নূর উদ্দিনের। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার আগে রেকি করা ছিল তার দায়িত্ব। আর ভবনের ছাদে আগুন দেওয়ার সময় নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকি করা ছিল তার দায়িত্ব।
শাহাদাত হোসেন শামীম: নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন শামীম। সেজন্য ছিল তার ক্ষোভ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হত্যাকান্ড বাস্তবায়নে কার কী ভূমিকা হবে সেই পরিকল্পনা সাজান শামীম। কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি তার বোরখা ও কেরোসিন কেনার ব্যবস্থা করেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় তিনি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাসটি উদ্ধার করে পিবিআই।
কাউন্সিলর মাকসুদ আলম: অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রেপ্তার হলে ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, বোরখা ও কেরোসিন কেনার জন্য তিনিই ১০ হাজার টাকা দেন। পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনার আগাগোড়াই তিনি জানতেন।
সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের: বোরখা ও হাতমোজা পরে সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগ জোবায়েরের বিরুদ্ধে। নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে দুই ভাগ করে পা বাঁধা এবং কেরোসিন ঢালার পর ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর কাজটি তিনিই করেন বলে তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য।
জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ: বোরখা পরে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার অভিযোগ জাবেদের বিরুদ্ধে। পা বাঁধা হলে পলিথিন থেকে কেরোসিন গ্লাসে ঢেলে তিনি নুসরাতের গায়ে ছিটিয়ে দেন এবং সব কাজ শেষে বোরখা খুলে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান বলে অভিযোগপত্রে উরেøখ আছে।
হাফেজ আব্দুল কাদের: নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু কাদের সেদিন মাদরাসার মূল ফটকে পাহারায় ছিলেন বলে অভিযোগ। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হলে দুই মিনিট পরে তিনিই ফোন করে নোমানকে বলেছিলেন, তার বোন গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
আবছার উদ্দিন: ঘটনার সময় তিনি গেইটে ছিলেন পাহারায়। মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়াও তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ।
কামরুন নাহার মনি: আসামী শামীমের দূর সম্পর্কে ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনি ২ হাজার টাকা নিয়ে দুটি বোরখা ও হাতমোজা কেনেন। হত্যাকান্ডে তিনি সরাসরি অংশ নেন বলে অভিযোগ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ছাদের ওপর নুসরাতের হাত বাঁধা হলে তাকে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর চেপে ধরেন মনি। আগুন দেওয়া হলে নিচে নেমে এসে আলিম পরীক্ষায় বসেন।
উম্মে সুলতানা ওরফে পপি: অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি সেদিন নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যান। পরে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। তাতে রাজি না হওয়ার নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে পা চেপে ধরেন বলে অভিযোগ।
আব্দুর রহিম শরীফ: ঘটনার সময় তিনি মাদরাসার ফটকে পাহারায় ছিলেন। পরে তিনি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালান।
ইফতেখার উদ্দিন রানা: মাদরাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।
ইমরান হোসেন ওরফে মামুন: মাদরাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।
মোহাম্মদ শামীম: সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন। কেউ যেন ওই সময় ছাদে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ।
রুহুল আমীন: মাদরাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় ছিলেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাতেও তার ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।
মহিউদ্দিন শাকিল: ঘটনার সময় সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন।
রায় শুনে আসামীদের কান্না, কেউ দিলেন গালাগাল
নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা উপলক্ষে আসামীদের আদালতে তোলার সময় প্রধান আসামী নুসরাতের অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে হাসিখুশি দেখা গেলেও রায়ের পর কাঁদতে কাঁদতে কারাগারে গেছেন।
শুধু সিরাজই নন, সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামীদের সঙ্গে তাদের স্বজনদেরও কাঁদতে দেখা গেছে আদালত প্রাঙ্গণে। এছাড়া নুসরাতের পরিবারকে গালাগাল করেছেন কেউ কেউ; বিচারকের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো আসামীর স্বজনরা। আসামীদের কয়েকজন আইনজীবী ন্যায়বিচার পাননি দাবি করে অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন।গতকাল বৃহস্পতিবার রায়ের পর পুলিশ আসামীদের এজলাস থেকে নিয়ে কারাগারের পথে রওনা হয়। সে আসামী জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদের মা লায়লী আক্তার বিলাপ করে বলেন, “ও হুতরে তোরে আঁর বুকের তুন কাড়ি লই যায়।“তুই তো কোনো দোষ করস নো। আঁই কেন্নে তোরে বাঁচাইতাম। তোরে যারা হাসাইছে (ফাঁসিয়েছে) আল্লাহ হেতেগো বিচার করইবো।”
বোরখা পরে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার অভিযোগ জাবেদের বিরুদ্ধে। নুসরাতের পা বাঁধা হলে পলিথিন থেকে কেরোসিন গ্লাসে ঢেলে তিনি নুসরাতের গায়ে ছিটিয়ে দেন এবং সব কাজ শেষে বোরখা খুলে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান বলে মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
আসামী ইমরান হোসেন ওরফে মামুনের বোন রিনা আক্তার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “নুসরাত আত্মহত্যা করেছে। তাকে কেউ হত্যা করেনি। আমার ভাই নির্দোষ। মামুন রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে।”
হত্যাকান্ডের সময় মামুন মাদরাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
আসামী কামরুন নাহার মনির কোলে ছিল তার মাসখানেক বয়সী মেয়ে। রায় ঘোষণার পর শিশুটিকে কারারক্ষীদের কোলে দেখা গেছে। এ সময় সাংবাদিকরা মা-মেয়ের ছবি তুলতে গেলে মনি সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ হন। কারাবন্দী থাকার সময়ই গত ২১ সেপ্টেম্বর মা হন মনি।
আদালতের রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসামী রুহুল আমীনের আইনজীবী নাসির উদ্দিন বাহার বলেন, ‘সমাজের অসুস্থ রাজনীতির প্রতিহিংসার’ শিকার হয়েছেন তার মক্কেল। তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। রুহুল আমীন ফেনীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি। এই মাদরাসার ছাত্রী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। রুহুল আমীন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় ছিলেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। হত্যাকান্ডের পর মামলার আরেক আসামী শামীমের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাতেও তার ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।
আসামী আবছার উদ্দিনের আইনজীবী কামরুল হাসান বলেন, “আমার মক্কেল নুসরাত হত্যায় জড়িত ছিলেন না। কোনো সাক্ষী তাদের সাক্ষ্যে আবছারের নাম বলেনি। তারপরও রায় আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে গেছে। আমি সুবিচার পাইনি।”
ওই মাদরাসার শিক্ষক আবছার উদ্দিন ঘটনার সময় গেইটে পাহারায় ছিলেন। মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়াও তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ।
এদিকে রায় ঘোষাণার সময় বা পরও আদালত প্রাঙ্গণে দেখা যায়নি মামলার প্রধান আসামী অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার আইনজীবী ফরিদ উদ্দিন খান নয়নকে। আসামীপক্ষের আইনজীবী আহসান কবির বেঙ্গলসহ অনেকে এদিন আদালতে আসেননি।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আকরামুজ্জামন রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে নুসরাতকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আসামীদের সাজা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করছে।”