এক মিনিট নীরবতা ও সন্ত্রাস রুখে দেয়ার শপথ
কাজী খোরশেদ আলম: প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে সব ধরনের ‘সন্ত্রাস’ ও ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তি’ রুখে দেয়ার শপথ নিয়েছেন। গত ১৬ অক্টোবর-২০১৯ইং বুধবার বেলা সোয়া ১টায় বুয়েট মিলনায়তনে শপথ গ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। এই শপথ অনুষ্ঠানে বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর সাইফুল ইসলামসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও হলের প্রভোস্টরা অংশগ্রহণ করলেও দর্শক সারিতে উপস্থিত শিক্ষকরা অংশ নেননি। শপথ পড়ান ১৭তম ব্যাচের ছাত্রী রাফিয়া রিজওয়ানা। শপথ শুরুর আগে ছাত্রলীগের পিটুনিতে নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের স্মরণে ‘এক মিনিট’ নীরবতা পালন করা হয়। শপথবাক্যে তারা বলেন, ‘এ বিশ^বিদ্যালয়ে সকল প্রকার সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানকে আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দেব।’ এতে বলা হয়, ‘এই আঙ্গিনায় যেন আর কোন নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে না যায়, আর কোনো নিরাপরাধি অত্যাচারের শিকার না হয়, তা আমরা সবাই মিলে মিশে নিশ্চিত করব। নৈতিকতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব ধরণের বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আমরা সমূলে উৎপাটন করব। (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ অক্টোবর-২০১৯ইং)
এক. প্রথমে আসি সন্ত্রাস রুখে দেয়ার শপথ-এটা একটি ভালো উদ্যোগ। সন্ত্রাস মুক্ত শিক্ষাঙ্গন প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের একান্ত কাম্য। সবাই চায় তার সন্তানটি যেন ভালো ভাবে শিক্ষাঙ্গন থেকে বাসায় ফিরতে পারে। প্রতিটি প্রকৃত ছাত্র-ছাত্রী চাওয়া যেন, ত্রাস মুক্ত সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে শিক্ষার্জন করতে পারে। বিপদগামী ও বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারীদের দ্বারা যে অপকর্ম হয় এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট কর্মই ত্রাসের সৃষ্টি। তারাই সন্ত্রাসবাদকে লালনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপকর্ম করে সাধারণ মানুষের মনে ভয়-ভীতির সঞ্চার ঘটায়। সমাজ বা দেশে এদের সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য কিন্ত তাদের দাপট থাকে বেশি। কারণ তাদের পেছনে বৃহৎ শক্তি কাজ করে। সেই শক্তির ইন্ধনে তারা চোখে-মুখে কিছুই দেখে না; মন যা চায়-তাই করে বেড়ায়। তারা ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করে দাপটিয়ে বেড়ায়। তবে এই সন্ত্রাসবাদ নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। সন্ত্রাসকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। কোন ঘটনা ঘটলে তাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে তা নিয়েও বেশ দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে সন্ত্রাসবাদ শব্দটি বহুল আলোচিত হয় ওয়ান ইলেভেনের ঘটনার পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্টে বুশ সরকার‘ওয়ান অন টেরর’ ঘোষণা করে। কিন্ত সাম্প্রতিক সময়ে ‘জঙ্গিবাদ’ ও ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দ দু’টোর অর্থ ও ব্যবহার কোথায় ও কীভাবে হচ্ছে তা নিয়েও পরিষ্কার ধারণার অভাব রয়েছে।
সমাজ ও রাষ্টবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, জঙ্গিবাদ হলো এক ধরনের বিশ^াস ও মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য থেকে উৎসারিত, যা সমাজে প্রতিষ্ঠিত নয় এবং তার জন্য সহিংসতার পথ বেছে নেয়া হতে পারে। আর সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদের একটি পথ হতে পারে আবার আলাদা একটি আচরণ হতে পারে সেখানে মূল লক্ষ্য আতঙ্ক তৈরি। অপর দিকে গবেষক আটরান ও ম্যাক কলি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানসিক সমস্যা সন্ত্রাসবাদের কারণ নয়। মোঘাদাম ২০০৬ সালে তাঁর প্রকাশিত গবেষণায় লিখেছেন, “সন্ত্রাসীরা জন্মায় না, তারা তৈরি হয়। সামাজিক কারণেই সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি,ব্যক্তিগত কারণে নয়।”
পৃথিবীতে কেহই সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না। সমাজ, দেশ ও অপরাজনীতিই একজন মানুষকে সন্ত্রাসীরূপে আবির্ভাব ঘটায়। নেতারা তাদের নিজেদের বলয়কে টিকিয়ে রাখতে তাদেরকে ব্যবহার করে এবং তাদেরকে দুধ কলা দিয়ে লালন পালন করে থাকে। যখন তাদের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়-তখন একজনকে উৎপাটন করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আবার নতুন আরেকটি সন্ত্রাসের চারা রোপন করে। এতে করে অপরাজনীতির মার প্যাচে কত তাজা প্রাণ যে অকালে ঝড়ে যায়- তার হিসাব রাখে কে? কে বা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। একটু চিন্তা ভাবনা করলেই দেখা যায় যে, আমাদের দেশে বর্তমানে যারা বড় নেতা বা নেত্রী তাদের ছেলে-মেয়েরা রাজনীতির ময়দানে আছে কি-না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে গুটি কয়েক জনের ছেলে-মেয়ে রাজনীতির মাঠে ময়দানে আছে। আর বাকিদের ছেলে- মেয়েরা বিভিন্ন উন্নত দেশের নামী-দামি বিদ্যা পিঠে লেখা পড়া করছে। আর নেতা বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের সন্তানদেরকে তিলে তিলে সন্ত্রাসীতে পরিণত করে। এই যে সন্ত্রাস তৈরি রাজনীতি এদেশ থেকে কখনো কি বিদায় হবে? আজ একদল সন্ত্রাসীর বিদায় হলে কাল আরেক দল সন্ত্রাসীর আবির্ভাব হয়; নতুন করে আরেক গ্রুপের জন্ম হয়। আজ যারা বুয়েটে সন্ত্রাস রুখে দেওয়ার শপথ করেছে। আগামীকাল দেখব তাদের মধ্যে থেকে নতুন করে আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসী বন্ধ করতে হলে: প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। নেতা-নেত্রী, এমপি-মন্ত্রী, শিক্ষক,ছাত্র,কৃষক-শ্রমিক সবাইকে সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করতে হবে। সবাইকে আইনের শাসন মানার মতো মানসিকতা অর্জন করতে হবে। আইনের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করতে শিখতে হবে। আইন জানলে বা আইন তৈরি করলে কোন লাভ হবে না,সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
দুই. আমাদের দেশের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে একটি চিত্র খুব পরিলক্ষিত হয় আর তা হলো কোন মৃত্যু ব্যক্তির স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা। এই এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে মৃত্যু ব্যক্তির কি ফায়দা হাসিল হয় তা বুঝতে পারছি না। আমাদের শিক্ষিত ও ভদ্র সমাজ এবং সু-শীল ব্যক্তিরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এক মিনিট নীরবতা পালন করে থাকে। কিন্ত কোথায় থেকে এক মিনিট নীরবতা পালনের প্রথা চলে আসছে, তা অনেককে প্রশ্ন করলে উত্তর হয়তো দিতে পারবে না। অন্য একজন করল তার সাথে সাথে আমিও করলাম। এতে মৃত্যু ব্যক্তির আত্মা শান্তি পাক আর না পাক তাতে কিছু আসে যায় না। গ্রাম্য একটি প্রবাদ আছে-মুর্দ্দা জান্নাতে যাক না জাহান্নামে যাক-খয়রাতের চাল মাপ নেই। আজকের ভদ্র ও সভ্য মানুষের সভা-সমাবেশেও তাই দেখতে পাচ্ছি। মৃত্যু কেন্দ্র করে স্মরণ সভা করেও দেখি এক মিনিট নীরবতা পালন করতে। আমার এক সহকর্মী তার পত্রিকার সম্পাদক মৃত্যুবরণ করায় তার রুহের মাগফেরাতের জন্য একটি এতিমখানায় দোয়ার আয়োজন করেন। সেই সভায়ও দেখলাম মুনাজাত পরিচালনার পূর্বে মরহুম সম্পাদক সাহেবের সম্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো: তারপর সূরা কেরাত পাঠ করে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এতিমখানার হাফেজ সাহেব মুনাজাতের মাধ্যমে দোয়া করলেন।
মূল কথা হলো দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করার যে প্রথা নতুন করে চালু হচ্ছে এটা মূলতঃ পশ্চিমা ইহুদী খিৃষ্টানদের তৈরী করা নিয়ম-নীতি। যা পশ্চিমা ইহুদী-খৃষ্টানরা তাদের মৃতদের সম্মানে নীরবতা পালনের এমন সংস্কৃতি চর্চা করে।
বর্তমানে আমরা হতভাগা মুসলমানরা না জেনে না বুঝে ফযিলত ও কল্যাণ কর ইসালে ছাওয়াবের ব্যবস্থাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ইহুদি-খৃষ্টানদের অপসংস্কৃতি এক মিনিট নীরবতা অর্থ্যাৎ বোবা সংস্কৃতির চর্চা শুরু করে দিয়েছি। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে কোনটি সংস্কৃতি আর কোনটি অপসংস্কৃতি তা নির্ধারণ করতেই ভুলে গেছি। আর এই সুযোগে দেদারছে অপসংস্কৃতি আমাদের মূল সংস্কৃতির মধ্যে প্রবেশ করে ফেলছে। তাই আমার পরবর্তী প্রজন্ম বা আমরা অপসংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতি মনে করে খুব গুরুত্বসহকারে পালন করছি। এক শ্রেণীর শিক্ষিত ও সুশীল সম্প্রদায় মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আয়োজিত কোন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে তার সম্মানার্থে এক যোগে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন এবং অন্যদেরকেও দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করতে উৎসাহিত করেন কোন কোন সময় বাধ্য করেন। মৃত্য ব্যক্তির সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের এ রেওয়াজটি খৃষ্টানদের থেকে পাওয়া এক শ্রেণীর মানুষের মিরাছী সম্পদ। তাদের ধারণা মতে কোন মৃত ব্যক্তির স্মরণে ও সম্মানার্থে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলে সেই নীরব পরিবেশে যিশু খ্রিষ্ট আগমন করেন এবং সে নীরব প্রার্থনা কবুল করেন নেন আর মৃত ব্যক্তির নাজাতের ব্যবস্থা করে দেন। এই আকীদা মতে মৃতের জন্য নীরবতা পালন কালে হযরত ঈসা আঃ পৃথিবীতে অবতরণ করেন।
আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে নিজেদের সংস্কৃতি সর্ম্পকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং হৃদয়ে লালন করতে হবে। আসুন অপসংস্কৃতি থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করি এবং সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসের পৃষ্টপোষকদের বয়কট করি।