তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার একমাস পার হলেও বহাল তবিয়তে অভিযুক্তরা
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : যমুনা অয়েলের গুপ্তখাল প্রধান ডিপো থেকে প্রায় ৭৮ হাজার লিটার তেল চুরির চেষ্টার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেয়ার এক মাসের বেশী সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। জানা গেছে, কোটি টাকার বেশী মূল্যের এই তেল চুরির চেষ্টার সাথে জড়িতদের বাঁচাতেই কর্তৃপক্ষ সময় ক্ষেপণ করছে। এদিকে মন্ত্রণালয় গঠিত আরেকটি কমিটির তদন্ত কার্যক্রমও চলছে ঢিলেঢালা ভাবে।
তদন্ত রিপোর্ট কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো: সামছুর রহমান সংগ্রামকে জানান, যেহেতু মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে তাই আমরা তাদের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। দুটো রিপোর্ট পেলে একসাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিপিসি একাই ব্যবস্থা নিতে পারে এটা ঠিক। তারপরও আমরা মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টের জণ্য অপেক্ষা করছি।
এদিকে যমুনা অয়েলের ৭৮ হাজার লিটার তেল চুরির চেষ্টার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপ- সচিব মো: ঈদতাজুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের চলমান তদন্তের সাথে বিপিসির রিপোর্ট প্রকাশ না করার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, তারা তাদের মতো করে তদন্ত করেছে। মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে তদন্ত করছে। রিপোর্ট জমাদানে বিলম্ব হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সরেজমিন তদন্তসহ এর সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছি। এখন শুধু তেল ট্রান্সপার করে (আইটিটি) পরীক্ষা করার অপেক্ষায় আছি। বন্দরে তেলবাহি জাহাজ আসলেই ইন্টারনাল ট্যাংক ট্রান্সফার করে আমার রিপোর্ট জমা দেব। কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দরে তেলবাহী জাহাজ আসবে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, গত ১০ আগস্ট যমুনা ডিপোর ডলফিন জেটিতে আসা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমটি পামির থেকে গুপ্তখাল ডিপোতে খালাসের পর প্রায় ৭৮ হাজার লিটার তেল বেড়ে গেলে তোলপাড় শুরু হয়। অভিযোগ ওঠে, বেড়ে যাওয়া ফার্নেস অয়েল চোরাইভাবে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিল একটি চক্র। এ নিয়ে বিপিসির দুই সদস্যের প্রাথমিক তদন্ত কমিটি পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান বরাবরে প্রতিবেদন জমা দেয়। বিপিসির প্রাথমিক তদন্ত কমিটির ২১ আগস্ট দেওয়া প্রতিবেদনে ৭৮ হাজার ৫৪৬ লিটার ফার্নেস অয়েল বেশি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তাতে তেল অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টির সাথে কেউকেউ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ২২ আগস্ট যমুনার প্রধান ডিপোর টার্মিনাল ম্যানেজার ডিজিএম (অপারেশন) জসিম উদ্দিন এবং ডেপুটি ম্যানেজার (বাল্ক) এ এইচ এম মনজুর কাদেরকে প্রত্যাহার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একইসাথে তেল অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অধিকতর তদন্ত ও পর্যালোচনার জন্য বিপিসির ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. আবু হানিফকে আহ্বায়ক করে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মো. আবু সালেহ ইকবাল, ইস্টার্ন রিফাইনারির মহাব্যবস্থাপক (ডেপেলভমেন্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল) মো. আনোয়ার সাদাত এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) শেখ আবদুল মতলেবকে সদস্য করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিপিসি।
সূত্র মতে, বিপিসির গঠিত এই কমিটির সদস্যরা যমুনা অয়েলের প্রধান ডিপো পরিদর্শন করার পাশাপাশি তদন্ত কমিটি ডিপোতে আসা লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ এমটি এনএস প্যারেড থেকে খালাস নেওয়া তেল আইটিটির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তারা সমপরিমাণ তেল নিয়ে আসা এমটি এনএস প্যারেড থেকে খালাস নেওয়ার পর আইটিটি করে মাত্র ২৮০ লিটারের মতো বেশি (গেইন) পায়। প্রায় এক মাস তদন্ত শেষে সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ বিপিসির তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়। যদিও সাত দিনের মধ্যে এই কমিটির তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। জানা গেছে, ৭৮ হাজার তেল চুরির চেষ্টার সাথে জড়িত যমুনার প্রধান ডিপোর টার্মিনাল ম্যানেজার ডিজিএম (অপারেশন) জসিম উদ্দিন এবং ডেপুটি ম্যানেজার (বাল্ক) এ এইচ এম মনজুর কাদেরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
রিপোর্ট জমাদানের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান বিপিসির ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. আবু হানিফ বলেন, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে সরেজমিনে তেল চুরির চেষ্টার বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আমরা রিপোর্টে সার্বিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। তিনি বলেন, এতদিনেও কেন রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে না সেটি বিপিসি ভালো জানেন। আমাদের কাজ যা ছিল তা আমরা করেছি। রিপোর্টে জড়িতদের বিরুদ্ধে কি ধরণের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক আগে রিপোর্ট জমা দিয়েছি, কি কি সুপারিশ করা হয়েছে সেটি মনে নেই।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, যমুনার তেল চুরির চেষ্টা ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর বিপিসির প্রাথমিক তদন্তে যমুনা অয়েল কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিপিসিকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের মে মাসের আগে আসা জাহাজগুলোর তেল আইটিটি করা হয়নি। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আসা বাহামার পতাকাবাহী এমটি স্ট্রোভোলস থেকে খালাস নেওয়া তেল গত ১০ মে আইটিটি করে এক লাখ ৬ হাজার ১৬৭ লিটার তেল গেইন পাওয়া যায়। এরপর ১১ জুলাই আসা লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এমটি ট্রয়িটস্কি ব্রিজ জাহাজের তেল গত ১৯ জুলাই আইটিটি করে ৪৭ হাজার ১১০ লিটার বেশি পান যমুনার প্রধান ডিপোর কর্মকর্তারা। সবাই বলছেন, গেল মাসে কয়েকটি জাহাজে তেলের অস্বাভাবিক গেইন (বেশি) দেখানোর পর বিপিসির তদন্ত কমিটি সর্বশেষ আসা জাহাজের তেলের পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার উল্টো চিত্র পেয়েছে। এতে সন্দেহ করা হচ্ছে, নানা সময়ে গেইন দেখিয়ে হাজার হাজার লিটার তেল পাচার করা হয়েছে।
যমনা অয়েল সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, বিপিসির কেউকেউ অভিযুক্তদের রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই তারা তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশ করছে না। এমনকি নানা সময়ে নানান বাহানা দিয়ে অভিযুক্তদের রক্ষা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও সূত্রে জানা গেছে।
অয়েলের গুপ্তখাল প্রধান ডিপোর কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, গত ২৬ আগস্ট নতুন একটি জাহাজ এমটি এনএস প্যারেড ফার্নেস অয়েল নিয়ে ডিপোর টার্মিনালে আসে। ২৯ আগস্ট জাহাজ থেকে তেল খালাস সম্পন্ন হয়। এর পরের দিন শুক্রবার সকালে বিপিসির তদন্ত দল ডিপোতে আসে। তদন্ত দলের নির্দেশে আগে থেকেই খালাস নেওয়া জাহাজের তেল ১ নং ট্যাংকে রাখা হয়। তদন্ত দলের উপস্থিতিতে শুক্রবার আইটিটি করে মাত্র ২৮০ লিটার গেইন (বেশি) পাওয়া গেছে। তবে তদন্ত দলের নিজস্ব তথ্য সম্পর্কে ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়নি। তদন্তে অংশ নেওয়া ও সহযোগিতা করা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০ আগস্ট সকালে তদন্ত দল যমুনা ডিপোতে গিয়ে নানা ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে। এরপর দুপুর দুটার দিকে ১ নং ট্যাংক থেকে ৭ নং ট্যাংকে প্রায় ২ লাখ লিটার তেল আইটিটি করে। তখন ট্যাংকের তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আইটিটির পর হিসেব করে দেখা ২৬০ লিটার লস (কম) হয়েছে। এরপর দুপুর আড়াইটায় ১ নং ট্যাংক থেকে ৮ নং ট্যাংকে প্রায় ২ লাখ লিটার তেল আইটিটি করা হয়। তখন ট্যাংকের তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে আইটিটির পর হিসেব করে ২৮০ লিটার তেল গেইন (বেশি) পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এমটি এনএস প্যারেডে আসা ২৭ হাজার ৪৫১ লিটার তেলের আইটিটি হিসেব করে প্রায় ১৪০ লিটারের মতো গেইন হয়েছে; যা স্বাভাবিক হিসেবে উল্লেখ করেন তদন্তে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
অথচ এইভাবে গত ১০ আগস্ট যমুনা ডিপোর ডলফিন জেটিতে আসা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমটি পামির থেকে গুপ্তখাল ডিপোতে খালাসের পর প্রায় ৭৮ হাজার লিটার তেল বেড়ে গেলে তোলপাড় শুরু হয়। যমুনা কোম্পানির মূল ডিপোতে অতিরিক্ত তেল জমিয়ে রাখা হয়েছে- গত ১৬ আগস্ট এমন খবর পাওয়ার পর সেখানে অভিযান চালায় বিপিসি। বিপিসির জিএম (অপারেশন) আবু হানিফের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম ঝটিকা অভিযান চালিয়ে যমুনার পতেঙ্গা গুপ্তখালে প্রধান ডিপোর ট্যাঙ্কগুলো পরিমাপ করে। এতে বাড়তি তেল পাওয়া যায়। কোম্পানির ১, ৭ ও ৮ নম্বর ট্যাঙ্কে পরিমাপ করে বাড়তি এই তেলের সন্ধান মেলে। তিনটি ট্যাঙ্কে অতিরিক্ত তেল ৭৮ হাজার ৫৪৬ লিটার। যদিও ডিপোর সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বাড়তি পাওয়া তেল তাপমাত্রাজনিত কারণে গেইন (অর্জিত) থেকে পাওয়া বলে দাবি করছেন। কিন্তু এ দাবি গ্রহণ করতে নারাজ বিপিসি। কারণ এর আগে তাপমাত্রাজনিত কারণে এত তেল একসঙ্গে ‘গেইন’ হওয়ার রেকর্ড নেই। ফলে ডিপো ইনচার্জসহ কর্মকর্তাদের এমন দাবিকে যুক্তিহীন বলে মনে করছে বিপিসি। বিপণন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে, তেল হয়তো অন্য কোনো উৎস থেকে সংগৃহীত নতুবা তাপমাত্রাজনিত কারসাজিতে চুরি করে জমিয়ে রাখা। যে পদ্ধতিতেই তেল জমিয়ে রাখা হোক না কেন, দুটিই গুরুতর অপরাধ বলে মনে করেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমটি পবির জাহাজটি রিলিজের পরে টার্মিনাল ম্যানেজারের ভ্রাপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকা উপ মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) জসিমউদ্দিন ও বি ও হিসেবে দায়িত্বে থাকা মঞ্জুর কাদের গং শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ৭৮ হাজার লিটার ফার্নিস তেল আইটিটিতে গেইন দেখায়। নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে ৭৮ হাজার লিটার তেল গেইন হয়েছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা। এমটি পবির জাহাজ খালাসের পর ট্যাংক নং ০১ এ ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড় করা হয়। ট্যাংক নং ৭ এ পূর্বের রেকর্ড় ছিল ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মাত্র ৪ ডিগ্রির ব্যবধানে ২১৮৩৩৪ লিটার তেল আই টি টিতে বৃদ্ধি হওয়ার কথা আনুমানিক ৫৩২ লিটার। কিন্তু ৭৮ হাজার লিটার তেল কিভাবে ট্যাংক নং ০১ থেকে ট্যাংক নং ৭ এ উদ্ধিৃত হলো সেটিই বড় প্রশ্ন।
জানা গেছে, তেল অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেয়ার পরও বিপিসি জড়িতদের বিুরদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে যমুনা অয়েল কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝেও।