বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত ১৬ ॥ আহত ৫৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুর্ঘটনা কবলিত উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন

মো. আকরাম হোসেন, কসবা থেকে ফিরে : ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রীসহ ১৬ জন নিহত এবং অর্ধ শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। নিহত ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা মহিলার লাশ কুমিল্লার সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ভোররাত পৌনে ৩টার দিকে কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে চান্দখোলা নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাত পৌনে তিনটা থেকে গতকাল মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিলো। আখাউড়া থেকে রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌছে লাইন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বগী অপসারণের পর বেলা পৌনে ১১টায় রেল চলাচল পুনরায় শুরু হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামতের কাজ চলছিল।
খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান রাতেই ঘটনাস্থল পৌছে উদ্ধার কাজ তদারকি করেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এবং সকাল ১০টায় রেলওয়ে মন্ত্রাণালয়ের সচিব মোফাজ্জল হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য পৃথক ৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তৃর্ণ নিশিথা ট্রেনের চালক তাছের উদ্দিন ও সহকারি চালক অনুপ দেবকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন, চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম রাজারগাঁওয়ের আবদুল জলিলের ছেলে মজিবুর রহমান (৫৫), একই জেলার মাইনুদ্দিনের স্ত্রী কাকলী (৩২), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বুল্লা গ্রামের ইয়াছির আরাফাত (১২), হবিগঞ্জ জেলার গোয়াইনঘাট এলাকার রিপন মিয়া (২২), অজ্ঞাতনামা মহিলা (৪১), হবিগঞ্জ উপজেলার চুনারুঘাট উপজেলার তিরেরগাঁও’র মৃত আবদুল হাশেমের ছেলে সুজন আহমেদ (২৪), মৌলভী বাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার গাজীপুরের মুসলিম মিয়ার স্ত্রী জাহেদা খাতুন (৩০), চাদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম রাজার গাওয়ের মুজিবুর রহমানের স্ত্রী কুলসুম বেগম (৩০), হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মদনমোড়ক গ্রামের আইয়ূব হোসেনের ছেলে মোঃ আল-আমিন (৩০), হবিগঞ্জ জেলার পৌর এলাকার আলী মোহাম্মদ ইউছুফ (৩২), চাদপুর জেলার বিল্লাল মিয়ার স্ত্রী ফারজানা বেগম (৪১), বানিয়াচংয়ের সোহেল মিয়ার কন্যা আদিবা (২), হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট এলাকার আবদুস সালামের স্ত্রী পেয়ারা বেগম (৪৮), নোয়াখালী জেলার মাইজদির শংকর হরিজনের ছেলে রনি হরিজন (৩৫) হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বড় বাজার এলাকার সোহেল মিয়ার শিশুকন্যা সোহামনি (৪) ও চাদপুর জেলার জাহাঙ্গীরের কন্যা মরিয়ম বেগম (৪)।
মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, সিলেট থেকে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি ১ নম্বর লাইনে ঢুকছিল। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে আসা ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে আউটারে থাকার সিগন্যাল দেয়া হয়। কিন্তু তৃর্ণা নিশিথার চালক সিগন্যাল অমান্য করে মূল লাইনে ঢুকে পড়ে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের তিনটি বগীতে ধাক্কা  দেয়। এতে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগী দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ট্রেন দুর্ঘটনার সাথে সাথেই ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তিনি জানান, তূর্ণার চালক তথা লোকো মাস্টারকে, ট্রেন থামানোর জন্য আউটার ও হোম দুই স্থানেই লাল বাতি সংকেত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চালক ট্রেন দাঁড় করাননি বলেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় বিকট শব্দে ও যাত্রীদের আহাজারি শুনতে পেয়ে এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে পৌছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। পরে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌছে আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠাতে থাকে। তিনি বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান,কসবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদুল আলম ঘটনাস্থলে পৌছে আহতদের উদ্ধার কাজ তদারকি শুরু করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী চান্দখলা গ্রামের আবু তাহের জানান, ঘুমে ছিলাম। বিকট শব্দে আমার বিল্ডিং কেঁপে উঠে। আমিসহ এলাকাবাসী দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করি। ৭টি পিকআপ ভ্যানে করে হতাহতদের হাসপাতালে পাঠাই। অনেকেরই হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একই গ্রামের জহির মিয়া জানান, ঘুম থেকে লোকজনের আহাজারি শুনে ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেই। ঘটনার ভয়াবহতা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
সরজমিনে দেখা গেছে, ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায় দুইশত ফুট রেললাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উদয়ন ট্রেনের ৩টি বগী দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এর মধ্যে দুইটি বগীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এদিকে এ ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য পৃথক ৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ে মন্ত্রণায়ল থেকে একটি, রেলপথ বিভাগ থেকে তিনটি এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ১টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এ ঘটনায় তৃর্ণা নিশিথা ট্রেনের চালক তাছের উদ্দিন ও সহকারি চালক অনুপ দেবকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তৃর্ণা নিশীথার চালকের সিগন্যাল অমান্য করার জন্যই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পৃথক ৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। রেল মন্ত্রণালয় থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ টাকা করে এবং আহত প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। তিনি বলেন, তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিগুলোকে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি সিগন্যাল অমান্য করে লাইনে ঢুকে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে ধাক্কা দিয়েছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিতু মরিয়মকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করে প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়ে মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি আহতের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ শামসুজ্জামান বলেছেন, নিহত ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা মহিলার লাশ কুমিল্লার সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে ৪১ জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতালে আহত অলিউল্লাহ (৩৬) জানান, তার বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। তিনি নোয়াখালীতে টেইলারিংয়ের কাজ করেন। সোমবার রাতে তিনি উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে হবিগঞ্জ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে আহত হন। তিনি বলেন, তিনি ট্রেনে দাঁড়ানো ছিলেন। হঠাৎ করে একটি আওয়াজ শুনতে পান। এর পর তিনি ট্রেনের ভেতর পড়ে যান। আর কিছু মনে নেই।
হাসপাতালে আহত বোরহান উদ্দিন জানান, তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে মাস্টার্সে পড়েন। তিনি বলেন, তিনি উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল থেকে কুমিল্লা যাচ্ছিলেন। ট্রেন তিনি দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রেনটি গভীর রাতে কসবার মন্দভাগ এলাকায় পৌছলে হঠাৎ বিকট শব্দ পান। সাথে সাথে তিনি ট্রেনের মধ্যে পড়ে যান। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে।
এ ব্যাপারে ২৫০ শষ্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ শওকত হোসেন জানান, তিনি গভীর রাতে ট্রেন দূর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখেন। তিনি বলেন, ভোর রাত সাড়ে চারটা থেকে আহত রোগীরা হাসপাতালে আসতে থাকেন।  বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ হাসপাতালে মোট ৪১ জন রোগী ভর্তি হন। এদের বেশীর ভাগেরই হাত, পা ভাঙ্গা এবং মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তিনি বলেন, রোগীরা আসতে থাকার আগেই তিনি হাসপাতালের জরুরী বিভাগ, সার্জারী ওয়ার্ড, অর্থোপেডিক ওয়ার্ডসহ প্রস্তুতসহ রোগীদের ভর্তির সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
ডাঃ শওকত হোসেন আরো বলেন, হাসপাতালে দুটি লাশ আছে। এদেরকে মৃতই আনা হয়েছিলো। এরা হচ্ছেন নোয়াখালী জেলার মাইজদির শংকর হরিজনের ছেলে রনি হরিজন (৩৫) এবং হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বড় বাজার এলাকার সোহেল মিয়ার শিশুকন্যা সোহামনি (৪)। তাদের লাশ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ শাহআলম জানান, ট্রেন দূর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসার জন্য কসবা উপজেলার বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প চালু করেছেন। এছাড়া জেলায় ৫টি মেডিকেল টীম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে দুইটি মেডিকেল টীম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে, একটি মেডিকেল টীম কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, একটি মেডিকেল টীম আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং একটি মেডিকেল টীম সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন এবং ৫৫ জন রোগী জেলা সদর হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, কসবা উপজেলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প থেকেই নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ