৯% সুদ হারের নামে শুভঙ্করের ফাঁকি
এইচ এম আকতার : ব্যাংক ঋণের সুদ হার নিয়ে নয়-ছয় থেমে নেই। শিল্প ঋণের সুদ হার বেশ কয়েকটি ব্যাংক ৯ শতাংশ নিলেও অধিকাংশ ব্যাংকই ক্ষুদ্র, মাঝারি, গৃহায়ণ ঋণ এবং ক্রেডিট কার্ডের সুদ নিচ্ছে ১২-১৮ শতাংশ পর্যন্ত। আর হিডেন চার্জের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে করে কিছু সংখ্যা বড় ব্যবসায়ী শিল্প ঋনের নামে ৯ শতাংশ হারে বিনিয়োগ পেলেও বাকি সব ধরনের গ্রাহকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে ক্রমে ক্রমে এই সুদের হার কমানোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তাতে তেমন কাজে আসেনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুনে ২২টি ব্যাংকের তিন মাস বা তদূর্ধ্ব ছয় মাসের কম সময়ের মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ। আবার ৩৫টি ব্যাংকের সুদহার ৬ দশমিক ৫০ থেকে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ১৬টি ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ এবং ১৩টি ব্যাংকের ৯ থেকে ১৪ শতাংশ। ২৭টি ব্যাংকের সুদহার ৯ দশমিক ৫০ টাকা থেকে ১৭ শতাংশ। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে চলতি মূলধন ঋণের ক্ষেত্রে ১৫টি ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ এবং ১৩টি ব্যাংকের ৯ থেকে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২৮টি ব্যাংকের সুদহার ৯ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ শতাংশ।
ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমানো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবুল মাল আব্দুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কর্পোরেট সুদ হার কমায়। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ব্যাংক মালিকরা রাখেনি। কর্পোরট সুদ হার কমানোর পইে উল্টো বক্তব্য দিতে থাকেন মালিকরা। তারা বলেন, বেশি হারে আমানতের সুদ হার দিয়ে সিঙ্গেল সুদে ঋণ দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।
কিন্তু সরকারের অব্যাহত চাপে কয়েকটি ব্যাংক শিল্প ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ করলেও সব ধরনের ঋণের সুদ হার নিচ্ছে ৯- ১৮ শতাংশ পর্যন্ত। এতে করে হাতে গুণা কয়েক জন ব্যবসায়ী সিঙ্গেল ডিজেট সুদের সুবিধা পেলেও সব গ্রাহকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা উচ্চ সুদের ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। শিল্প ঋণের সুদ হার ৯-১০ শতাংশ হওয়ায় ক্ষুদ্র মাঝারি এমনকি গৃহায়ণ এবং ক্রেডিট কার্ডসহ অন্যসব ঋনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুদ নিচ্ছে। এতে করে নানা ভাবে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
তবে তারল্য সংকটের কারণেই এই অস্তিরতার সৃষ্টি হয়। বাজারে তারল্য সংকট সম্পর্কে অনেকে বলেন, দেশের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। এ দেশ থেকে কখনই বাংলাদেশী টাকা পাচার হয় না। কারণ বিদেশে বাংলাদেশী টাকা চলে না। তা ছাড়া বাংলাদেশী টাকা বিদেশ থেকে পাঠানো বা নিয়ে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশী কেউ বিদেশযাত্রাকালে তার সঙ্গে করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এই টাকা বিদেশে খরচ করার জন্য নয়। প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে নিজের বাড়িতে যাওয়ার কাজে ব্যবহারের জন্য। তা হলে বাংলাদেশী টাকা বিদেশে পাচার হয়নি। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ প্রদেয় বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিনতে গিয়ে টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ঢুকলে বাজারে এর ক্রয়ক্ষমতা শূন্য হয়ে যায়। বাইরে থাকা একটি টাকা বাজারে ১০ টাকার ক্ষমতা দেখাতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে গিয়ে ওই টাকাটিই যেন ঘুমিয়ে পড়ে। তাই বাজারে শুরু হয়েছে তারল্য সংকট।
অন্যদিকে সরকারের ছাড়া সঞ্চয়পত্রে সুদের হার এখনো দুই অঙ্কে বহাল আছে। অনেকে যুক্তি প্রদর্শন করেন, চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের অবসর-উত্তরপ্রাপ্ত টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সংসার চালান। এ জন্য এই খাতে সুদের হার কমানো যায় না। সরকার যদি অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কল্যাণের জন্য অধিক সুদ দিয়ে তাদের উপকার করতেই চায়, তা হলে সেটি অবসরে যাওয়া কর্মচারীদের পাওনাভিত্তিক প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে সীমিত আকারে গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারে।
আবার অবসরভাতা বা কল্যাণের নামে রাজকোষ থেকে যে কোনো পরিমাণ টাকা তাদের মাসে মাসে প্রদান করা যেতে পারে। কিন্তু অর্থবাজারে হুমকি বহাল রেখে সঞ্চয়পত্রে অবাধে আমানত সংগ্রহ করা যথাযথ হচ্ছে না। যারা সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখছেন, এ খাতে লাভজনক না হলে তারা নিশ্চয়ই নিজেরা ব্যবসা শুরু করতেন। এতে দেশে দেশে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বেড়ে যেত। এখন বিভিন্ন খাতের টাকা এসে ঢুকে যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রে। ফলে সরকার টার্গেটের চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা হাতে পাচ্ছে এবং অর্থবাজারের তারল্যে দৈন্যদশা শুরু হয়েছে।
অর্থবাজারে টাকা নেই। এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। যারা ব্যাংকে আমানত রাখেন অর্থাৎ যাদের হাতে টাকা আছে, তারা বেকুব ধরনের মানুষÑ এমনটি ভাবার কারণ নেই। বাজারে যখন টাকার চাহিদা বাড়বে, ব্যাংকের লোকজন হন্যে হয়ে আমানতের পেছনে ছুটে বেড়াবেÑ তখন তারা অধিক মূল্য হাঁকবেন। এটিই স্বাভাবিক। ফলে স্থায়ী আমানতের সুদহারে শতকরা ১১ বা এরও বেশি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
সরকার যখন ছয়-নয়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে চাপ দিল, তখন ব্যাংকের মালিকপক্ষ এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কমপক্ষে চারটি সুবিধা আদায় করে নিল। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো রেট কমানো ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা, সরকারি আমানতের শতকরা ৫০ ভাগ প্রাইভেট ব্যাংকে রাখা এবং মুনাফার ওপর কর কমানো। তড়িঘড়ি করে একটি হোটেলে রাতারাতি সভা করে এগুলো বাস্তবায়ন করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর প্রথমবারের মতো গিয়ে হাজির হলেন হোটেলে অনুষ্ঠিত ব্যাংক মালিকদের ওই সভায়। সেখানে বসেই ব্যাংক মালিকদের প্রস্তাব বা অনুরোধ কিংবা সিদ্ধান্তে তিনি সম্মতি দিলেন এবং পরদিন সার্কুলার জারি করলেন। কিন্তু বাজারে আমানত ও ঋণের সুদহার ছয়-নয় হলো না। হওয়ার কথাও নয়। সরকারি দপ্তরগুলো শতকরা ৬ টাকা হারে বিনিয়োগ করতে রাজি হচ্ছে না। তাদের কাছ থেকেও এফডিআর আনতে এখন শতকরা ৯ টাকা বা এরও বেশি দিতে হয় বলে শোনা যায়।
ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত আমানতের ব্যয় বর্তমানে কত? সরকার কি ভাবছে, এটা শতকরা ৬ টাকা? যদি তা-ই হতো, তা হলে শতকরা ৯ টাকায় ঋণ প্রদান করা হয়তো সম্ভব হতেও পারত। কিন্তু শতকরা ৯ থেকে ১২ টাকা দরে আমানত সংগ্রহ করে ওই টাকা তো আর শতকরা ৯ টাকা দরে খাটানো যায় না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুনে ২২টি ব্যাংকের তিন মাস বা তদূর্ধ্ব কিন্তু ছয় মাসের কম সময়ের মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ। আবার ৩৫টি ব্যাংকের সুদহার ৬ দশমিক ৫০ থেকে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ১৬টি ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ এবং ১৩টি ব্যাংকের ৯ থেকে ১৪ শতাংশ। ২৭টি ব্যাংকের সুদহার ৯ দশমিক ৫০ টাকা থেকে ১৭ শতাংশ। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে চলতি মূলধন ঋণের ক্ষেত্রে ১৫টি ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ এবং ১৩টি ব্যাংকের ৯ থেকে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২৮টি ব্যাংকের সুদহার ৯ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ শতাংশ।
ব্যাংকগুলোর এই হিসাব খুব সাদামাটাভাবে কাগজে ঘোষিত সুদহার বলেই বিবেচনা করা যায়। এসব ঋণের পেছনে আরও খরচ আছে- যেগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। এগুলোর কেতাবি নাম সার্ভিস চার্জ এবং আরও কিছু। তা হলে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন, তাদের স্বস্তির জায়গাটা কোথায়?
ঋণগ্রহীতাদের সংকট এখানেই শেষ নয়। ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়ার পর উদ্যোক্তারা তাদের ইকুইটির অংশ দিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেন। নিজের পকেটের টাকা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় ব্যাংকের দরজায় হানা দেওয়ার পালা। তারল্য সংকটের কথা বলে ব্যাংকগুলো তখন ঋণ বিতরণ স্থগিত রাখে, বাতিল করে দেয় বা আংশিক টাকা বিতরণ করে। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা তাদের প্রকল্প শেষ করতে এবং উৎপাদনে যেতে পারেন না। কিন্তু আংশিকভাবে বিতরণ করা ঋণের সুদ গুনতে শুরু করেন।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রধান বলেছেন, ঋণের সুদহার কমাতে হলে আগে ৬ শতাংশ হারে আমানত লাগবে। কথাটি যথার্থই সত্য। ব্যাংক অবশ্যই তার লাভের কথা ভাববে- যেহেতু এটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এবিবির মতে, বাজারে তারল্য সংকট অনেকটাই কমেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। ব্যাংকগুলোকে এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে না। সঞ্চয়পত্র কেনার বেলাতেও কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে।
এতে হয়তো ব্যাংকের আমানত বাড়বে। পর্যায়ক্রমে হয়তো তারা শতকরা ৯ টাকা হারে ঋণ দিতেও পারবেন। এখন কতদিনে তাদের এই আশাবাদ বাস্তবায়িত হয়, সেটিই দেখার বিষয়। যদি সবাই আন্তরিকতা নিয়ে অর্থবাজারকে সঠিক রাস্তায় আনতে চান, তা হলে নিশ্চয়ই দ্রত ছয়-নয় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে। যদি এটি কেবল কথার কথা হয়ে থাকে, তা হলে ছয়-নয় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘমেয়াদেই নয়-ছয় করে যেতে হবে। আর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার হয়তো পড়ে যাবে অকূল পাথারে। সরকারসহ আমরা কেউই তা চাই না।