বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এই কী গণতান্ত্রিক শাসনের নমুনা?

কয়েকদিনের ব্যবধানে দেশে কয়েকটি হত্যাকান্ড ও দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুর বাবুকে দুষ্কৃতকারীরা প্রকাশ্যে পিটিয়ে পায়ের রগ কেটে হত্যা করেছে। এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে দেশের আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির একটা নাজুক প্রতিচ্ছবি পাওয়া গেছে। তবে এত বড়ো একটা লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের পর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার প্রশ্নে সরকারের অবস্থান ও তৎপরতা নিয়ে আমরা শুধু হতাশই নই রীতিমতো আতংকিত। বিশেষ করে এই হত্যাকান্ড নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় ও ঢংয়ে কথা বলেছেন, তাতে করে হত্যাকান্ড নিয়ে সরকার বিরোধী দলের প্রতি দোষ চাপানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক ইস্যুতে সংসদে, মাঠে-ময়দানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বহাস ও ব্লেইম গেমকে মেনে নেয়া গেলেও কারও হত্যাকান্ড নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মূল ও দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলার ফলে আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠায় মানুষের আস্থা বিপন্ন হয়, তা নয়। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির বিচারিক প্রজ্ঞা ও সাংবিধানিক দায়বহনের যোগ্যতা ও আন্তরিকতা নিয়েও যদি কেউ প্রশ্ন তুলতে চান, তাকে দোষ দেওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ভিডিও দেখে অপরাধী চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু বিরোধী দল বলছে, ভিডিও চিত্রে যেসব হত্যাকারীদের দেখা গেছে সরকার তাদের সবাইকে ধরছে না। যদিও ফৌজদারী দন্ডবিধি ও পুলিশের অপরাধী ধরার নিয়মে ভিডিও চিত্র দেখে অপরাধী ধরার বিষয়টি তেমন প্রচলিত নয়। পারিপার্শিবকতা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং সরেজমিন তদন্তই অপরাধী চিহ্নিত করার প্রধান ভিত্তি। তাছাড়া বাবু হত্যার মামলায় তার স্ত্রী বাদী হয়ে যাদেরকে আসামী করেছেন, তদন্তের আগেই তাদেরকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিরপরাধ সার্টিফিকেট দিয়ে সাফাই গাওয়ায় তদন্ত ও বিচার নিয়ে গুরুতর সন্দেহ তৈরী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রথমত: বলেছেন, বাবু হত্যা বিএনপি'র অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল। দ্বিতীয়ত: বাবু হত্যার প্রধান আসামী করে যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার পিতাকে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, এখন নিহত আওয়ামী লীগ নেতার পুত্রের বিরুদ্ধেও খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। তবে এই বক্তব্য সত্যি হলেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খুনের মামলার আসামীর পক্ষে সরাসরি সাফাই বক্তব্য নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থিত হলে আইনী প্রক্রিয়া যে থমকে যাবে, সেটা সবাই জানেন। তাছাড়া বাবু হত্যার প্রধান আসামীর পিতা যদি সত্যি অন্যায়ভাবে নিহত হন, তাহলে তার প্রতিশোধ নিতে সংশ্নিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাবু হত্যার মাধ্যমে কী তার প্রতিশোধ নিয়েছেন? তাহলেও তো বাবু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন আসামীর প্রতিশোধ গ্রহণের জিঘাংসা প্রমাণ হয়। আর এই জিঘাংসার অবসান ঘটানো হয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলার নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ বাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সাধারণ মানুষ যদি এধরনের কথায় বিশ্বাস করেন তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই দোষারোপের রাজনীতি সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতি এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অপমৃত্যু ঘটাতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছেই আমরা ইতিবাচক ভূমিকা আশা করবো। শাসকদল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে নৈবেক্তিক ও নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর সাংবিধানিক শপথের ওজন ও গুরুত্ব ভুলে হত্যাকান্ডকে নিয়ে রাজনৈতিক অভিযোগের পাল্টাপাল্টি দোষ চাপাচ্ছেন, তখন বাবু হত্যার তদন্ত আসামীদের গ্রেফতার যে রসাতলে যেতে বসেছে, তা নিয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ নেই। সরকারি দলের লোকদের কোন অপরাধ নেই, হত্যার অভিযোগ থেকেও তারা ইনডেমনিটি পেয়ে যাবেন, তাহলে আইন কী শুধু বিরোধী দলের জন্য? যদিও দীর্ঘ দুতিন দশক পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতার হত্যার বিচারের জন্য ইনডেমনিটি আইন প্রত্যাহার করে বিচারকে বাধামুক্ত করেছিলেন। তারা এও বলেছিলেন, মুজিব হত্যার বিচার করে তারা দেশকে কলঙ্কমুক্ত করবেন। পাবনায় প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ওপর আওয়ামী লীগ যুবলীগের ক্যাডারদের হামলার পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে বসেই বলেছিলেন যে, একহাতে তালি বাজেনি। ১৯৯৬-২০০১ পর্বে ক্ষমতায় থাকতে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে গিয়ে কর্মীদের বলেছিলেন ‘একটা লাশের বদলে দশটা লাশ ফেলে' দিতে। এদিকে নাটোরে গামা হত্যা মামলার বিচারে ফাঁসীর দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেওয়ার বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে সমর্থ করে প্রধানমন্ত্রী বিচারপ্রক্রিয়াকে তুলোধুনো করেছেন। যদিও গামা হত্যার মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল। আদালতের বিচারের ওপর কারও অনাস্থা না থাকলেও তা নিরসনের জন্য আদালতই হচ্ছে নাগরিকের ভরসা। আদালতের বিচারিক রায় বা বিচার প্রক্রিয়া নির্বাহী আদেশ দিয়ে বা সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতায় বাতিল বা মার্জনা করে দিলে সেটা বিচার বিভাগের ওপর যেমন নির্বাহী বিভাগের নগ্ন হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়, তেমনি এতে আদালত অবমাননারও মন্দ নজীর তৈরী হয়। দেশে আদালত অবমাননার অভিযোগে বেশ কিছু বিচার হয়েছে। কিন্তু সরকারের শাসন ক্ষমতার উচ্চাসনে বসে যারা আদালতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন, আদলত তাদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেবেন? সিরাজগঞ্জে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জনসভায় আগত ৫/৬জন শ্রোতা দ্রুতগামী রেলে কাটা পরে নিহত হয়েছেন। এরপর জনসভায় আগত উত্তেজিত লোকজন ট্রেনে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে এবং আগুন লাগিয়ে ট্রেনটি জ্বালিয়ে দেয়। এতে যাত্রীদের প্রচুর মালামাল খোয়া গেছে, অনেকে আহত হয়েছেন এবং রেলওয়ের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই পুরো ঘটনাটিই অনাকাঙ্ক্ষিত, মর্মান্তিক। বিরোধী দলীয় নেত্রী বলেছেন, তার জনসভা বানচাল করতে সরকার এজেন্সীর মাধ্যমে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এর পাল্টা অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী যমুনা রিসোর্টে বসে লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এসব রাজনৈতিক বক্তব্য নিহত মানুষ ও তাদের স্বজনদের জন্য উপহাসের সামিল। বিরোধী দলীয় নেত্রী সত্যি যদি লাশ বানিয়ে রাজনীতি করার কৌশল অবলম্বন করে থাকেন, আর এ নিয়ে সরকার যদি নিশ্চিত থাকে, তাহলে কাউকে যাতে লাশ হতে না হয়, সরকারকে তা নিশ্চিত করা দরকার ছিল। নাটোরে বাবু হত্যার সাথে যদি বিরোধী দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল জড়িত থাকে, তাতে বরং ঐ হত্যাকান্ড যাতে না ঘটে, সরকারকে তার প্রটেকশনে দায়িত্বশীল হবার কথা। প্রশাসন ও রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই বিরোধী দল সিরাজগঞ্জে রেললাইন ঘেঁষা উন্মুক্ত চত্বরে জনসভা করেছে। সরকারি দলের দখলবাজির জন্য বিরোধী দল উল্লাপাড়ায় তাদের জনসভা করতে পারেনি বলেই বিকল্প জায়গায় জনসভা করেছে। দ্রুতগামী ট্রেনের চালক বলেছেন, তাকে দুর্ঘটনাস্থলে গাড়ি থামানো বা গতি কমানোর কোন নির্দোশ দেওয়া হয়নি। এত বড়ো একটা জনসভার সময় ট্রেনের গতি কমানোর সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারেননি, ৫ টি মানুষের মৃত্যুর দায় কী তাদের ওপর বর্তায় না? তাছাড়া দুর্ঘটনার ২০০ গজ দূরে গিয়ে ট্রেনটি থামানোকে অনেকে উত্তেজিত জনতার দ্বারা ট্রেন আক্রান্ত হবার সুযোগ দেয়া হয়েছে কিনা, এ প্রশ্নও তুলেছেন। যেভাবে ট্রেনটি ২০০ গজ দূরে গিয়ে থামলো, তাতে দুর্ঘটনাস্থলের ২০০ গজ আগেও থামতে পারতো। প্রকৃত ঘটনা কী এবং কারা এরজন্য দায়ী, তা কেবল সুষ্ঠু তদন্তেই প্রমাণ হবে। কিন্তু সরকার বিরোধী দলীয় নেত্রী সহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এনিয়ে মামলা দিয়ে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাইছে। বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার এই প্রবৃত্তি গণতান্ত্রিক শাসনকে প্রহসনে পরিণত করবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ