আলীকদমে মাতামুহুরী রেঞ্জে কাঠ ও বাঁশ পাচার
আলীকদম (বান্দরবান) সংবাদদাতা : লামা বন বিভাগের মাতামুহুরী রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কাঠ চোরাকারবারীদের সাথে আতাতের মাধ্যমে সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। গত ৭ অক্টোবর মাতামুহুরী রিজার্ভের সামাজিক বনায়নের অংশীদারি সদস্য ও এলাকার সচেতন মহলের স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত অভিযোগ বনমন্ত্রী, প্রধান বন সংরক্ষকসহ বিভিন্ন দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। সংরক্ষিত রিজার্ভ ভূমি থেকে অবৈধভাবে কর্তিত বাঁশ পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগে জানা যায়, মাতামুহুরী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তা যোগদানের পর থেকে সামাজিক বনায়নে বৃক্ষ নিধন ও পাচার চরমে পৌঁছেছে। তাদের যোগাসাজশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কাঠ চোরের দল। পাশাপাশি পাচার হচ্ছে মহালের বাঁশ। চলতি বছরের ৩১ মে বাঁশ মহালের মেয়াদ শেষ হলেও রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তার যোগসাজশে পাচারকারী চক্র অবাধে বাঁশ কর্তন ও পাচার করছে। দিনেরাতে ২-৩শ' রোহিঙ্গা ও স্থানীয় কাঠ ও বাঁশ শ্রমিক সরকারি সংরক্ষিত বনে সৃজিত সামাজিক বনায়ন ও বাঁশ বাগানে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।
অভিযোগে স্বাক্ষরকারী স্থানীয় উপজাতীয় নেতা চাহ্লামং মার্মা জানান, সরকারি বন থেকে অবৈধভাবে কাটা গাছ-বাঁশ মাতামুহুরী নদীপথে বাবু পাড়া বনফাঁড়ি দিয়ে পাচার হচ্ছে। ফুটপ্রতি কাঠ ও প্রতিশত বাঁশ থেকে উৎকোচ নিয়ে কাঠ-বাঁশ পাচারে সহযোগিতা করছে বনকর্মীরা। প্রতিরাতে বাবু পাড়া বন ফাঁড়িতে দায়িত্বরত ফরেস্টার ও বনকর্মীদের উৎকোচ দিয়ে লাখ লাখ টাকার বনজসম্পদ পাচার করা হচ্ছে। মাতামুহুরী রেঞ্জের মিরিংচর, কালাইয়ার চরা, জানালী পাড়া, খেদদিং পাড়ায় প্রতিদিন বেপরোয়াভাবে সামাজিক বনায়নের কাঠ নিধন হওয়ার বিষয়ে রেঞ্জার ও বিট কর্মকর্তাকে জানিয়েও সুরাহা না পেয়ে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে দাবি করেন চাকলাং মুরুং।
অভিযোগে স্বাক্ষরকারী পাচ্চ মুরুং ও খেদদিং মুরুং জানান, গাছ কাটার বিষয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর মাতামুহুরী রেঞ্জে একদল উপকারভোগী রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তার নিকট মৌখিক নালিশ করেন। সে সময় এ দু'জন বনকর্মকর্তা একটি সভার রেজুলেশনে উপকারভোগীদের স্বাক্ষর আদায় করেন। ঐদিন বন বিভাগের স্টাফ ও উপকারভোগীদের যৌথ প্রচেষ্টায় কাঠচোর ধরার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভার সিদ্ধান্তমতে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তিনদিনে চারজন কাঠ চোর আটক করা হয়। চাহ্লামং মার্মা জানান, কাঠচোরদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা না করে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে অভিযুক্তদের ছেড়ে দেন রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তা।
অভিযোগে দাবী করা হয়, রাতের অাঁধারে এ দু'জন কর্মকর্তার যোগসাজশে বনের গাছ কেটে স্থানীয় স'মিলে বিক্রিকালে তা আটক করে সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী সদস্য জাফর আলম, নুরুল ইসলাম ও আব্দুল হামিদসহ অন্যরা। পরে কাঠগুলো ইউএনও কর্তৃক জব্দও করা হয়। এ বিষয়ে পরদিন উপকারভোগী সদস্যরা এ দু'জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কাঠ পাচারের অভিযোগে ইউএনও'র নিকট লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু এ পর্যন্ত অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোন শুনানি না হওয়ায় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন এ দু'জন বন কর্মকর্তা।
অভিযোগে আরো প্রকাশ, বাবুপাড়া বনফাঁড়ি দিয়ে টাকার বিনিময়ে রিজার্ভের কাঠ ছেড়ে দিলে গত ঈদুল ফিতরের দিন রাতে ও পরে স্থানীয় যুবনেতা আবুল কালাম ও আনোয়ার জিহাদ দু'টি কাঠ বোঝাই জীপ ও পিকআপ (নং- ঢাকা-ল-২৯, ঢাকা-ল-২৩৬) আটক করেন। যা পরবর্তীতে উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম নিজেই অবৈধ কাঠবোঝাই গাড়ি দু'টি তৈন রেঞ্জকে হস্তান্তর করেন।
২০০২ সাল থেকে সামাজিক বনায়নের কাঠ পাচার হচ্ছে। বর্তমানে এ রেঞ্জের ধুংচি খাল, বুজিখাল, জানালী পাড়া, ঠান্ডা ঝিরি, মিরিংচর, মইশখাইল্যা ঝিরি, কালাইয়ারছড়া, বরভিলা, ছোটভিলা, রোয়াম্ভু, কচুর ছড়া, কুরপেপাতা, বাবু পাড়া, তুলাতলী, কুরুকপাতা, কচ্ছইপ্পা, হানতি, ছোট বেতী, বড় বেতী প্রভৃতি এলাকা থেকে নির্বিচারে কাঠ কাটা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের কারণে মাতামুহুরী রেঞ্জের প্রায় ১২শ' হেক্টরের সামাজিক বনায়ন হুমকির মুখে রয়েছে বলে দাবি করেন উপকারভোগী সদস্যরা।
এদিকে লামা বন বিভাগের আলীকদমস্থ মাতামুহুরী রেঞ্জের উপকারভোগী সদস্য ও বনকর্মীরা অভিযান চালিয়ে গত শুক্রবার ৩৪ টুকরা কাঠ ও সহস্রাধিক বাঁশ জব্দ করেছে। মাতামুহুরী নদীপথে বাঁশের চালির নীচে বেঁধে কৌশলে এসব কাঠ পাচার করা হচ্ছিল। সামাজিক বনায়ন থেকে কাঠ পাচারের অভিযোগ এনে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগপত্র পাঠানোর কয়েকদিনের মধ্যেই এসব কাঠ ও বাঁশ জব্দ করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে, মাতামুহুরী রেঞ্জ থেকে অবৈধভাবে বাঁশ ও সামাজিক বনায়নের কাঠ পাচার চলছে। কাঠ ও বাঁশ পাচারের বিষয়ে সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীরা বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ এনে সম্প্রতি একটি অভিযোগপত্র প্রধান বন সংরক্ষকের দফতরে পাঠিয়েছেন।
বিট কর্মকর্তা নিতিশ চক্রবর্তী জানান, শুক্রবার উপকারভোগী সদস্যদের নিয়ে মাতামুহুরী নদীতে অভিযান চালানোর হয়। বনকর্মী উথোয়াই মার্মা জানান, তাদের যৌথ অভিযানে তুলাতলী এলাকা থেকে বাঁশের চালির নীচে কৌশলে পাচারের সময় ৩৪ টুকরা সেগুন ও একাশিয়া কাঠ জব্দ করেছে। জব্দ করা গাছের পরিমাণ আনুমানিক ৫০ ঘনফুট হবে। তবে বাঁশ জব্দের বিষয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিবেন। অভিযান চলাকালে কোন পাচারকারীকেও আটক করা যায়নি।
সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী সদস্য কেংক মুরুং কার্বারী জানান, ব্যবসায়ীরা কৌশলে বাঁশের চালির নীচে কাঠ বেঁধে পাচার করছে।
এতে বনায়ন দিন দিন বিরান হতে চলেছে। বাবু পাড়া এলাকার একজন ব্যবসায়ী জানান, প্রতিরাতে যে হারে কাঠ ও বাঁশ পাচার হচ্ছে তাতে অচিরেই মাতামুহুরী রেঞ্জ বিরানভূমিতে পরিণত হবে।
স্থানীয় জন সংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক বাচিংনু মার্মা অভিযোগ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ রেঞ্জ থেকে সামাজিক বনায়নের ছোট ছোট গাছ কেটে লাকড়ির নাম দিয়ে পাচার করা হচ্ছে। মাতামুহুরী রেঞ্জের বাবু পাড়া বন ফাঁড়ি দিয়ে অর্থের বিনিময়ে লাকড়ি, বাঁশ ও কাঠ পাচারের সুযোগ দিচ্ছে বন বিভাগের কর্মীরা।